মানুষ মাতৃক্রোড়ে যে ভাষা শিক্ষা করে সে ভাষাতেই সে আপনার সুখ-দুঃখ জ্ঞাপন করে। বলেছিলেন বিজ্ঞানাচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু। আজ তাঁর ১৬৬-তম জন্মদিনে শিক্ষা নিয়ে তাঁর প্রদর্শিত পথে আরও একবার স্মরণ করলেন শিক্ষক নায়ীমুল হক।
আপনজন: ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ। জগদীশ চন্দ্র বসু লিখছেন, প্রায় ত্রিশ বৎসর পূর্ব্বে আমার বৈজ্ঞানিক ও অন্যান্য কয়েকটি প্রবন্ধ মাতৃভাষাতেই লিখিত হইয়াছিল। তাহার পর বিদ্যুৎ-তরঙ্গ ও জীবন সম্বন্ধে অনুসন্ধান আরম্ভ করিয়াছিলাম। আসলে প্রকৃতিতেই সমস্ত শিক্ষা আমাদের জন্য বিদ্যমান। বার বার বলিতেছি প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করো। তোমরা কি অঙ্কুর উঠিতে দেখিয়াছ? একটা বীজ হাতে ধরে নিয়ে দেখো তার অঙ্কুর বের হয় কীভাবে।
১০০ বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে তাঁর কথার। হায়, আজও আমরা পারিনি বইয়ের পৃষ্ঠার বাইরে শিশুদের নিয়ে যেতে!
‘উদ্ভিদের জন্ম ও মৃত্যু’-তে তিনি বলছেন, মৃত্তিকার নীচে অনেক দিন বীজ লুকাইয়া থাকে। মাসের পর মাস এইরূপে কাটিয়া গেল। শীতের পর বসন্ত আসিল। তারপর বর্ষার আরম্ভে দুই-এক দিন বৃষ্টি হইল। এখন আর লুকাইয়া থাকিবার প্রয়োজন নাই। বাহির হইতে কে যেন শিশুকে ডাকিয়া বলিতেছে, ‘‘আর ঘুমাইও না, উপরে উঠিয়া আইস, সূর্য্যের আলো দেখিবে।” আস্তে আস্তে বীজের ঢাক্নাটি খসিয়া পড়িল, দুইটি কোমল পাতার মধ্য হইতে অঙ্কুর বাহির হইল। অঙ্কুরের এক অংশ নীচের দিকে গিয়া দৃঢ়রূপে মাটি ধরিয়া রহিল, আর এক অংশ মাটি ভেদ করিয়া উপরে উঠিল। তোমরা কি অঙ্কুর উঠিতে দেখিয়াছ? মনে হয় শিশুটি যেন ছোট মাথা তুলিয়া আশ্চর্য্যের সহিত নূতন দেশ দেখিতেছে।
বুঝিতে পারিতেছ, আলোই জীবনের মূল। সূর্য্যের কিরণ শরীরে ধারণ করিয়াই গাছ বাড়িতে থাকে। গাছের শরীরে সূর্য্যের কিরণ আবদ্ধ হইয়া আছে। কাঠে আগুন ধরাইয়া দিলে যে আলো ও তাপ বাহির হয়, তাহা সূর্য্যেরই তেজ। গাছ ও তাহার শস্য আলো ধরিবার ফাঁদ। জন্তুরা গাছ খাইয়া প্রাণ ধারণ করে; গাছের যে সূর্য্যের তেজ আছে তাহা এই প্রকারে আবার জন্তুর শরীরে প্রবেশ করে। শস্য আহার না করিলে আমরাও বাঁচিতে পারিতাম না। ভাবিয়া দেখিতে গেলে আমরাও আলো আহার করিয়া বাঁচিয়া আছি।
গাছ ফুলের মধ্যে মধু সঞ্চয় করিয়া রাখে। মৌমাছি ও প্রজাপতি সেই মধু পান করিয়া যায়। মৌমাছি আসে বলিয়া গাছেরও উপকার হয়। ফুলে তোমরা রেণু দেখিয়া থাকিবে। মৌমাছিরা এক ফুলের রেণু অন্য ফুলে লইয়া যায়। রেণু ভিন্ন বীজ পাকিতে পারে না।
এইরূপে ফুলের মধ্যে বীজ পাকিয়া থাকে। শরীরের রস দিয়া গাছ বীজগুলিকে লালন পালন করিতে থাকে। নিজের জীবনের জন্য এখন আর মায়া করে না। তিল তিল করিয়া সন্তানের জন্য সমস্ত বিলাইয়া দেয়। যে শরীর কিছু দিন পূর্বে সতেজ ছিল, এখন তাহা একেবারে শুকাইয়া যাইতে থাকে। শরীরের ভার বহন করিবারও আর শক্তি থাকে না। আগে বাতাস হু হু করিয়া পাতা নড়াইয়া চলিয়া যাইত। পাতাগুলি বাতাসের সঙ্গে খেলা করিত, ছোট ডালগুলি তালে তালে নাচিত। এখন শুষ্ক গাছটি বাতাসের ভর সহিতে পারে না। বাতাসের এক একটি ঝাপটা লাগিলে গাছটি থর-থর করিয়া কাঁপিতে থাকে। একটি একটি করিয়া ডালগুলি ভাঙ্গিয়া পড়িতে থাকে। শেষে একদিন হঠাৎ গোড়া ভাঙ্গিয়া গাছ মাটিতে পড়িয়া যায়।
এইরূপে সন্তানের জন্য নিজের জীবন দিয়া গাছ মরিয়া যায়।
নয়া প্রজন্মের শিক্ষার ভিত গড়তে আমরা কোন পথ আজ এক্তিয়ার করব, ভাববার দিন কিন্তু এসে গিয়েছে। কালক্ষেপণের বিন্দুমাত্র সময় নেই। পিঠ যে দেওয়ালে ঠেকে গিয়েছে!
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct