আপনজন: কর্নেল সুফিয়া কুরেশি। এই নামটির সঙ্গে এখন পরিচিত গোটা দেশবাসী। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ‘অপারেশন সিঁদুর’ চালিয়ে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন এই সেনা নায়িকা। তার অপারেশনে গর্বিত গোটা সেনাবাহিনী। এই ধরনের একটি অপারেশনে তিনি নেতৃত্ব দিয়ে মিশনকে পুরোপুরি সফলতা এনে নিজে কতটা সামরিক দক্ষ সেই পরিচয় শুধু দেননি, বরং প্রমাণ করে দিলেন মাতৃভূমির জন্য ধর্ম, জাত, লিঙ্গ এসব কোন ফ্যাক্টর নয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর এই গর্বিত সাহসিনী সেনা নায়িকাকে সকলে মনে রাখবেন চিরকাল। তিনি আদ্যপাদ্য একজন ভারতীয় মুসলিম মহিলা। ক্রোপস অফ সিগন্যালসের অফিসার। তার শিক্ষাগত পড়াশোনা পোস্ট গ্রাজুয়েট। বিষয় বায়ো কেমিস্ট্রি। পরিবার সূত্রে তার ঠাকুরদাও ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। যারা ভারতীয় মুসলিমদের কথায় কথায় পাকিস্তানের চলে যেতে নিদান দেন, পাসপোর্ট ধরিয়ে দেওয়ার কথা বলেন, যারা সংখ্যালঘুদের দেশপ্রেমকে সন্দেহ করেন যারা ভাবেন মুসলমান মানেই সন্ত্রাসবাদী তাদের কাছে কিন্তু সুফিয়া কুরেশি এক বড় নিদর্শন। পাকিস্তানের মধ্যে মুসলমান মানেই সন্ত্রাসী, সন্ত্রাসীদের ধর্ম ইসলাম এই প্রতিষ্ঠা করার লড়াইয়ে যারা থাকেন তাদের গালে সপাটে চর কষিয়েছেন সুফিয়া কুরেশি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাতের অন্ধকারে মাত্র ৫৮ মিনিটের মধ্যে অপারেশন চালিয়ে তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন দেশ বড়। শত্রুর কোনও ধর্ম জাত পরিচয় কিছু হয় না। সেনাবাহিনীর একটাই মিশন থাকে, তা হল খতম করো দুশমনকো। আগামী দিন সুফিয়া কুরেশিকে দেখে হয়তো আরো হাজার হাজার বাংলার ঘরের ফাতেমা খাতুনরা এগিয়ে আসবেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে। মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষজন মনে করেন যারা সত্যিই আল্লাহকে মানেন যারা কোরানকে বিশ্বাস করেন, তাদের কাছে ‘হুববাল ওয়াতান মিনাল ঈমান’। অর্থাৎ দেশকে ভালোবাসা ঈমানের অঙ্গ।
উল্লেখ্য, পাকিস্তানকে একাধিকবার ভারত সাবধান করেছিল। জঙ্গিদের ঘাঁটি খতম করার জন্য বার্তা দিয়েছিল। কিন্তু সেই বার্তায় সাড়া না দাওয়াই পহেলগাঁও হামলার ১৫ দিন পর পাক মাটিতে ভারত প্রত্যাঘাত করতে বাধ্য হয়। জঙ্গিদের আঁতুড়ঘরকে ধ্বংস করে পাকিস্তানকে কম্পন ধরিয়ে, সন্ত্রাসী শাহবাজের পরিবারের সদস্যদের মেরে মুরিদ, শিয়ালকোট, কোটালিতে হিজবুলের জঙ্গি ঘাটি ধ্বংস করে ভারত এটাই প্রমাণ করলো জঙ্গিদের লজিস্টিক হাফ ভারতের অনেক আগেই নজরে ছিল। মাসুদের ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিয়ে ভারত বুঝিয়ে দিল সুফিয়া কুরেশিরা দেশের অমর্যাদা হলে ভারতীয় মহিলারা তার বদলা নিতে পারে।
মঙ্গলবার গভীর রাতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দুই ভারতীয় সেনা নায়িকা নিখুঁত অপারেশন চালিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিল নারী ক্ষমতা সবার উপরে। দেশের মাথাকে উঁচু করে জঙ্গি ক্যাম্প গোলপুর থেকে শুরু করে একাধিক জায়গায় আক্রমণ চালিয়ে সন্ত্রাসবাদকে কিভাবে খতম করতে হয় তা বুঝিয়ে দেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাহসিনী সেনা নায়িকারা।
ভারতীয় সময় আজ বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার পর ইন্টারনেটে সবচেয়ে বেশি খোঁজ হয়েছে যে নারীর, তিনি কর্নেল সুফিয়া কুরেশি। ‘অপারেশন সিঁদুর’ নিয়ে ভারতের সরকারি ব্রিফিংয়ে প্রতিরক্ষা বাহিনীর যে দুই নারী অংশ নেন, সুফিয়া কুরেশি তাঁদের একজন। অন্যজন উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিং। কীভাবে কখন পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর ও পাকিস্তানে ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠী’র ঘাঁটি ভারতীয় বাহিনী গুঁড়িয়ে দেয়, সুফিয়া ও ব্যোমিকা তার বিবরণ দেন। সেই থেকে সৃষ্টি কৌতূহলের। এই দুই নারীর পরিচয় জানতে আগ্রহ দেখা যায় সর্বত্র।
কর্নেল সুফিয়া কুরেশি ভারতীয় সেনাবাহিনীর সামরিক যোগাযোগ ও ইলেকট্রনিকস অভিযান সহায়ক শাখা সিগন্যাল কোরের অন্যতম শীর্ষ কর্মকর্তা। একাধিক যুগান্তকারী সাফল্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁর নাম। ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ২০২০ সালে এক বার্তায় সুফিয়া সম্পর্কে জানিয়েছিল, ২০১৬ সালে তিনি ১৮টি দেশের উপস্থিতিতে সামরিক মহড়া ‘এক্সারসাইজ ফোর্স ১৮’–এ ৪০ সদস্যের ভারতীয় বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তখন তিনি ছিলেন লে. কর্নেল পদমর্যাদার সেনা কর্মকর্তা। বহুজাতিক মহড়ার ভারতীয় দলের নেতৃত্ব দেওয়া প্রথম নারী কর্মকর্তা তিনিই।
মহারাষ্ট্রের পুনেতে অনুষ্ঠিত সেই মহড়ায় অংশ নিয়েছিল চীন, জাপান, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ। সেই মহড়ায় অন্য কোনো দেশের নেতৃত্বে কোনো নারী ছিলেন না।
শান্তিরক্ষার কাজে নিযুক্তির অভিজ্ঞতাও রয়েছে সুফিয়ার। ২০০৬ সালে কঙ্গোয় জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা অভিযানে তিনি সামরিক পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
সুফিয়া কুরেশি ভারতের গুজরাত রাজ্যের বাসিন্দা। বায়োকেমিস্ট্রি নিয়ে এমএ পাস করার পর তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৯৯ সালে অফিসার্স ট্রেনিং অ্যাকাডেমি থেকে উত্তীর্ণ হন তিনি। কাউন্টার ইনসার্জেন্সিসহ বহু অভিযানে অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে সুফিয়ার পরিবারের সম্পর্ক বহুদিনের। সুফিয়ার দাদা ও বাবা দুজনেই সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন। সুফিয়ার স্বামীও সেনা কর্মকর্তা। তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেকানাইজড ইনফ্যান্ট্রি অফিসার।
আজ বুধবারের আনুষ্ঠানিক ব্রিফিংয়ে সুফিয়ার সঙ্গী ছিলেন উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিং। ব্যোম শব্দের অর্থ মহাশূন্য। ব্যোমিকা নামের অর্থ আকাশকন্যা। আকাশকন্যা যে মহাশূন্য–বিহারী হবেন তাতে আশ্চর্য কী?
ছোট থেকে সেই স্বপ্নই দেখে এসেছেন ব্যোমিকা। স্বপ্ন সার্থকও হয়েছে। স্কুলের পাঠ চুকিয়ে প্রকৌশলে স্নাতক হয়ে যোগ দেন ভারতীয় বিমানবাহিনীতে। বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার পাইলট হিসেবে কাজে যোগ দিয়ে ২০১৭ সালে উইং কমান্ডার হন।
উঁচু ও ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ি এলাকায় আড়াই হাজার ঘণ্টারও বেশি ওড়ার অভিজ্ঞতা আছে ব্যোমিকার। পর্বতারোহণও তাঁর শখ। ২০২১ সালে ২১ হাজার ৬৫০ ফুট উঁচু মাউন্ট মনিরং অভিযানে ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর তিন শাখার নারী প্রতিনিধিরা অংশ নিয়েছিলেন। ব্যোমিকা ছিলেন তাঁদের অন্যতম।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct