একালের অন্যতম প্রগতিশীল, প্রতিবাদী মুসলিম নারী মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ বেগম সুফিয়া কামাল। ১৯৪৭ সালে ‘বেগম’ পত্রিকার সম্পাদিকা সাড়া জাাগনো বেগম সুফিয়া কামালের বিশেষ অবদান রয়েছে দুই বাংলায়। আজ ২০ নভেম্বর, তাঁর প্রয়াণ দিবসে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করলেন হিঙ্গলগঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষ শেখ কামাল উদ্দীন।
কথামুখ
‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর।অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।।’এই সত্য উপলব্ধি করে, স্বীকার করে স্বীকৃতি দিতে অনেকেই পারেন নি। কবি কাজী নজরুল ইসলাম পেরেছিলেন। ব্যক্তি জীবনে, সাহিত্য সৃষ্টিতেও। তবে কাজটি ছিল কঠিন। পারিবারিক, সামাজিক প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে মুসলিম নারীদের ক্ষেত্রে তা ছিল কঠিনতর। যাঁরা পেরেছিলেন সেইরকম কয়েকজন নারীর মধ্যে অন্যতম বেগম সুফিয়া কামাল।
পারিবারিক পরিচয়ঃ:
পূর্বতন অবিভক্ত বাংলা, বর্তমান বাংলাদেশের বরিশাল সদর উপজেলায় পিতা সৈয়দ আব্দুল বারী ও মা সাবেরা বানুর সন্তান সুফিয়া কামালের জন্ম ১৯১১-র ২০ জুন। মাত্র ১১ বছর বয়সে ১৯২২-এ মামাতো ভাই সৈয়দ নেহাল হোসেনের সঙ্গে বিবাবসূত্রে আবদ্ধ হন। তাঁদের দাম্পত্য জীবন ছিল মাত্র ১০ বছরের। ১৯৩২-এর ১৯ ডিসেম্বর ক্ষয় রোগে সৈয়দ নেহাল হোসেনের মৃত্যু হয়। তাঁদের একমাত্র কন্যা আমেনা আক্তার। ১৯৩৯-এর ৮ এপ্রিল চট্টগ্রামের কামালউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে তাঁর দ্বিতীয়বার বিবাহ হয়। পরিচিত হন সৈয়দ সুফিয়া কামাল নামে। ১৯৪১-এ মা সৈয়দা সাবেরা খাতুনের মৃত্যু হয়। ১৯৬৩ সালে তাঁর এক পুত্র আহমেদ কামাল দুষ্কৃতীদের হাতে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৭৭ সালের ৩ অক্টোবর তাঁর স্বামী কামালউদ্দিনও প্রয়াত হন। তাঁদের সন্তানেরা হলেন সুলতানা কামাল, সাঈদা কামাল, শাহেদ কামাল ও সাজেদ কামাল। তাঁর প্রাপ্ত পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’ (১৯৬২), ‘একুশে পদক’ (১৯৭৬) ও ‘স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার’ (১৯৭৭)। বিদেশ থেকেও তিনি পুরস্কৃত হন। ১৯৭০ সালে ‘সোভিয়েত লেলিন পুরস্কার’, ১৯৮১ সালে চেকোশ্লাভাকিয়া থেকে ‘সংগ্ৰামী নারী পুরস্কার’ পান। ৮৮ বছর বয়সে ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর ঢাকায় প্রয়াত হন এই মহীয়সী মুসলিম রমণী। তিনিই বাংলাদেশের প্রথম মহিলা যাঁকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়।
শিক্ষাজীবন
যে বংশে সুফিয়া কামালের জন্ম হয় সেই অভিজাত জমিদার বাড়িতে নারী শিক্ষার চল ছিল না। তাঁর পিতা ছিলেন উকিল। নানা ম্যাজিস্ট্রেট। বাড়িতে উর্দু ছিল কথ্য ভাষা। পাশাপাশি আরবি, ফারসির চল থাকলেও বাংলা ভাষার চল ছিল না। বাড়িতেই শিক্ষারম্ভ হয়। মূলত মায়ের কাছেই তিনি বাংলা শেখেন। ১৯১৮ সালে স্বামী আধুনিকমনস্ক সৈয়দ নেহাল হোসেনের সঙ্গে কলকাতায় এলে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। রোকেয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ তাঁর জীবনকে অনেকাংশে পাল্টে দেয়। পত্রপত্রিকা পড়তে শুরু করেন। সঙ্গে লেখা। ক্রমশ পরিচিত হন কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। সামাজিক কাজকর্মের সঙ্গেও ক্রমশ নিজেকে সংযুক্ত করেন।
সাহিত্য জীবন
কাজী নজরুল ইসলামের ‘হেনা’ গল্প পড়ে গদ্য সাহিত্যের প্রতি তাঁর আগ্রহ সৃষ্টি হয়। তারপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় মুগ্ধ হয়ে কবিতা রচনার প্রতি আগ্ৰহ তৈরি হয়। এছাড়াও তিনি লক্ষ্য করেন বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, বেগম সারা তাইফুর, বেগম মোতাহেরা বানু প্রমুখ মুসলিম নারীরা গল্প, কবিতা লিখছেন। তাঁদের দ্বারাও তিনি প্রভাবিত হন। ১৯২৬ সালে সাপ্তাহিক সাওগাতে তাঁর প্রথম কবিতা ‘বাসন্তী’ প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রথম গল্প সংকলন ‘কেয়ার কাঁটা’ প্রকাশিত হয় ১৯৩৭ সালে। ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সাঁঝের মায়া’-র ভূমিকা লিখে দেন কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর কবিতা অন্যান্য বিদ্বজ্জনদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও প্রশংসা আদায় করে নেয়। ১৯২৯ সালে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমন্ত্রণে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে যান এবং স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে উপহার হিসেবে ‘গোরা’ উপন্যাস তাঁর হাতে তুলে দেন। ১৯৩০ সালে ‘মহিলা সওগাত’-এ সুফিয়া কামালের ‘বিড়ম্বিতা’ কবিতাটি তাঁর ছবিসহ প্রকাশিত হয়। ১৯৪৭ এর ২০ জুলাই কলকাতা থেকে প্রথম ‘সাপ্তাহিক বেগম’ প্রকাশিত হলে সুফিয়া কামাল তার প্রথম সম্পাদিকা মনোনীত হয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদিকা ছিলেন সওগাত-সম্পাদক মোঃ নাসিরউদ্দিন কন্যা নূরজাহান বেগম। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সাঁঝের মায়া’ ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে মস্কো থেকে রুশ ভাষায় অনূদিত হয়ে ‘বলশেভনী সুমের্কী’ নামে প্রকাশিত হয়। ১৯৮৯ সালে তাঁর স্মৃতিকথা ‘একাত্তরের ডায়েরী’ প্রকাশিত হয়। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হলো- ‘মায়া কাজল’, ‘মন ও জীবন’ ইত্যাদি। এছাড়াও তিনি ‘সোভিয়েতে দিনগুলি’ নামে একটি ভ্রমণকাহিনী, ‘একালে আমাদের কাল’ নামে আত্মজীবনীও লেখেন।
ভাষা আন্দোলন ও বেগম সুফিয়া কামাল
১৯৪৭-এ দেশ বিভাগের পর সুফিয়া কামাল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে চলে যান। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে সে নিয়ে যে আন্দোলন শুরু হয় সেই আন্দোলনে তিনি যোগ দেন। বাংলা ভাষার পক্ষে তিনি জোরদার সওয়াল করেন। ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তিনি অনেকগুলি কবিতা লেখেন। স্বাধীন বাংলাদেশে ‘বাংলা একাডেমী’ থেকে ‘একুশের সংকলন: গ্রন্থপঞ্জি’- তে তাঁর রচিত ৬৫ টি কবিতার উল্লেখ পাওয়া যায়।
স্বাধীন বাংলাদেশে বেগম সুফিয়া কামালের কর্মকাণ্ড
স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হলে তিনি বিভিন্ন গণসংগঠন তৈরি করেন। বহু সংগঠনের দায়িত্বশীল পদে নিযুক্ত হন। ১৯৫৬ সালে তিনি তৈরি করেন শিশুদের সংগঠন ‘কচিকাঁচার মেলা’। ওই বছর দিল্লির সাহিত্য সম্মেলনেও তিনি অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭০ সালে তৈরি করেন ‘মহিলা পরিষদ’। প্রচন্ড ভয়ের পরিবেশে ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ পালিত হয়। রবীন্দ্র জন্মোৎসব পালনের পর ঢাকার অদূরে জয়দেবপুরে একটি বনভোজনের আয়োজন করা হয়। সেখানে ‘ছায়ানট’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠার কথা হয়। বেগম সুফিয়া কামালকে উক্ত ‘ছায়ানট’ সংস্থার প্রথম সভাপতি ও ফরিদা হাসানকে সম্পাদক নির্বাচিত করে প্রথম কমিটি গঠিত হয়। ১৯৬৫ সালে তিনি ‘পাক-সোভিয়েত মৈত্রী সমিতি’-র সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে তিনি ‘আন্তর্জাতিক নারী উৎসব’-এ যোগদানের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নে গমন করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি ‘মহিলা সংগ্ৰাম কমিটি’-র সভাপতি পদে আসীন হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের জন্য যে ছাত্রী আবাস তৈরি হয় তার নামকরণ যাতে বেগম রোকেয়ার নামে হয় তার জন্যও তিনি ‘বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত স্মৃতি কমিটি’-র নেত্রী হিসেবে দরবার করেন। ১৯৭২ সালে তিনি বুলগেরিয়া, জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়নও ভ্রমণ করেন। ১৯৮২ সালে তিনি রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলন পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮৮ সালে তিনি বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভানেত্রী নির্বাচিত হন। বাংলাদেশে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের তিনি ছিলেন অন্যতম মুখ। মুক্ত চিন্তার পক্ষে ও মৌলবাদের বিপক্ষে প্রতিটি প্রগতিশীল কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তিনি আমৃত্যু নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর শনিবার সকালে তিনি বার্ধক্য জনিত রোগে প্রয়াত হন।
শেষ কথা
আজও নারীরা সর্বত্র পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। সংসারে, সমাজে আজও নারীরা সমানাধিকার পান নি। যুদ্ধ বা সন্ত্রাসের পরোক্ষ বলি শিশু ও নারীরা। আমাদের দেশে নারীদের একসময় সহমরণ প্রথা পালন করতে হতো। স্বামীরা বহুবিবাহ করতে পারতেন। সেই স্বামীদের মঙ্গলার্থেই নারীরা নানা রকম ব্রত পালন করতেন, আজও করেন। অথচ আমাদের দেশেই জন্মেছিলেন অপলা, ঘোষা, লক্ষ্মীবাঈ, রিজিয়া সুলতানার মতো মহীয়সী মহিলারা। দেশকে স্বাধীন করার লড়াইতে নেমেছিলেন মাতঙ্গিনী হাজরা, বীণা দাস, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদাররা। আমাদের দেশে লৌহমানবী ইন্দিরা গান্ধী শুধু দেশই নয়, পৃথিবীতে মুক্তির আলো ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। আমাদের রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির পদক্ষেপে ‘কন্যাশ্রী’র মতো প্রকল্প গৃহীত হয়েছে, যা সারা বিশ্বে আজ প্রশংসিত। কিন্তু বেগম সুফিয়া কামাল যে প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও সামনে থেকে মেয়েদের জন্য লড়াই আন্দোলন করেছিলেন, সাহস জুগিয়েছিলেন সামনে থেকে, যে নারীরাও পারে, তাঁকে আলাদা করে সাবাস জানাতেই হয়।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct