বসন্তের ছোঁয়া
সনাতন পাল
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘পূরবী ‘কাব্যগ্রন্থে লিখেছেন-” তোমার কাননতলে ফাল্গুন আসিবে বারম্বার, তাহারি একটি মাগি আমি দুয়ারে তোমার। বেলা গিয়াছে বৃথাই এতকাল ভুলে ছিনু তাই। “প্রতি বারের ন্যায় এবারেও ফাল্গুন এসেছে। দুয়ারে বসন্ত হাজির হয়েছে লাল টুকটুকে পলাশের ডালি নিয়ে । তার স্পর্শ লেগেছে বাংলার প্রকৃতির গায়ে এবং আমাদের হৃদয় মাঝারে। রাঙামাটির পথ বেয়ে বসন্তের অপরূপ সৌন্দর্যের টানে পর্যটকরা আপন মনের হরষে চলেছেন রবি ঠাকুরের সেই শান্তি নিকেতনে। পাশেই বসেছে সেই হাতছানি দিয়ে ডাকা সোনাঝুড়ির হাট। যেখানে ভাবের মাঝেই চলছে বেচাকেনা। ফুঁটে উঠেছে প্রকৃতির মন কাড়া মাধুর্য। যার স্পর্শে হৃদয়ে বেজে ওঠে প্রেমের মাদল। গাছের আগায় থোকা থোকা ফুঠেছে লাল টুকটুকে পলাশ। এ যে বাংলা সাহিত্যের সোনাঝোড়া দিন। দৃশ্যপট দেখেই মনে জাগে রবি ঠাকুরের সেই গান-” ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান.....তোমার অশোকে কিংশুকে অলক্ষে রং লাগল আমার অকারণের সুখে ...”। শীত বিদায় নিচ্ছে । কনকনে ঠান্ডা আর নেই। ঠান্ডা থেকে আমরা গরমের দিকে প্রবেশ করছি। শরীর সেটা জানান দিচ্ছে। সকাল-সন্ধ্যা ঠান্ডা কিন্তু দুপুর হলেই চড়া রোদের গরম। ঠান্ডা-গরমের ফলে-জ্বর- সর্দি-কাশির হাতছানি আর গলা ব্যথার সাথে সাথে গলা বসে যাওয়া। আর তার সঙ্গে হোমিওপ্যাথি ডাক্তার বাবুদের ব্রায়োনিয়া নামক ঔষধটি নিয়ে নাড়াচাড়া এবং এলোপ্যাথি ডাক্তার বাবুদের কলমের খোঁচায় এন্টাবায়োটিকের ছড়াছড়ি। কাজ না হলে চলছে তার দেদার বদল । কে আর কাকে বলে, কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল! আমরা হয়তো ভাবি ডিগ্রির কলম দিয়ে প্যাডে যেটা লেখা পড়ছে,সেটাই বুঝি ঠিক।
ঐ দিকে আবার পাহাড়ে বরফ গলতে শুরু করেছে। পর্যটকরা ভিড় জমিয়েছে শৈল শহরে । ডুয়ার্সের চা গাছ গুলো নিজেকে যেন একটু মেলে ধরতে শুরু করেছে। হাতির পাল গুলো অজানা কারণে মাঝে মাঝেই লোকালয়ে এসে হাজির হচ্ছে । চোখে পড়ছে ডুয়ার্সে পেখম তোলা ময়ূরের ঝাঁক। দার্জিলিংয়ের বাগানে কমলা লেবু গুলো প্রায় শেষ । আমরা একটু একটু করে বসন্তের স্পর্শ অনুভব করতে শুরু করেছি। ভাবনার জগতে উঁকি মারছে সেই পুরনো দিনের স্মৃতি। কখনও একটু মন খারাপে আনমনা হয়ে উঠা। কখনও আবার কাউকে কাউকে বিষণ্ণতা গ্রাস করা। তারই মাঝে আবার ভালো স্মৃতি মনে এলেই নিজে নিজেই আপন মনে ফিক করে এক গাল হেসে দেওয়া। প্রকৃতি যেন আবার নতুন ভাবে সেজে উঠেছে। লাল টুক টুকে পলাশের ঘনঘটার সাথে সাথে দিকে দিকে পত্র-বিহীন শিমূল গাছের আগায় শিমূল ফুলের পাপড়ি মেলে ধরা। অন্য দিকে আমের বনে স্বল্প স্বল্প করে মুকুলের আগমন। গাছপালা লতা-পাতা নতুন পত্র- পল্লবে নতুন সাজে সুসজ্জিত। তারই মাঝে হৃদয়ে একটু খানি প্রেমের দোলা দেওয়া। এ দোলায় যেমন প্রেম থাকে তেমন বিরহ বেদনাও থাকে। একথা তো আমরা ভুলে যাই বিরহ না থাকলে প্রেমের স্বাদ জুটবে কিসে! কিন্তু বসন্ত সে কথা আমাদের মনে করিয়ে দেয়। এরই মাঝে আবার একটু মন খারাপ করা খবর- হিমঘরের অভাবে উত্তরবঙ্গের আলুরা আজ আশ্রয়হীন,গরীব আলুচাষিরা দিশে হারা । চাষীদের মাথায় হাত। আকাশ ছোঁয়া সারের দামে চারিদিকে হাহুতাশ। তবে মন ভরিয়ে দেওয়া হলুদ শর্ষের ফুলেও ঢেকে রয়েছে বিঘার পর বিঘা জমি। ধূ ধূ মাঠে এ যেন এক অপরূপ লাস্যময়ী ষোড়শী রূপবতী নারীর রূপসজ্জা। একদিকে অনেকটা স্থান জুড়েই হলুদ শর্ষের ফুল- তারপরেই শুরু হয়েছে সবুজ বোরো ধানের চারা। এ যেন তাঁতে বোনা হলুদ রঙের সবুজ পাড়ের শাড়ি। এরই মাঝে আবার কোথাও এটাও চোখে পড়ছে- মাঠে গরু চড়ছে। ঘাসের খুব অভাব। তবুও ক্ষুধার্ত গোরু গুলো মাটি ঘেঁষে ঘাস গুলোকে কামড়ে ধরছে। হয়তো পেটে খুব কমই পৌঁছাচ্ছে তবুও ক্ষুধার জ্বালায় পেট ভরানোর তাড়া। একটু হাঁপিয়ে গেলেই মাঝে মাঝে একটু- ‘হাম্বা’ ডাক। গ্রামের মেঠো পথ বেয়ে চলেছে গোরুর গাড়ি। চলতে চলতে মাটি ক্ষয় হয়ে গর্ত তৈরি হয়েছে ।সেই গর্ত আবার ধূলো-তে ভর্তি! গ্রাম বাংলার গাছে গাছে কোকিল প্রস্তুতি নিচ্ছে তার মধূর কন্ঠ স্বরে গানে কেমন করে মুখরিত করবে গ্রাম বাংলার মানুষ কে। প্রকৃতির বৈচিত্র্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের মাঝে আসছে নানা ধর্মীয় আচার- বিচারের ঘনঘটা, মসজিদের আজান থেকে অষ্টপ্রহরের গান। দুইয়ের মিলিত রূপ যেন এক সম্প্রীতির ছন্দ। দিকে দিকে নানা রঙের পাখিদের আগমন বাংলায় বসন্তকে আরও মুখরিত করে তুলেছে। বাংলার বসন্ত মানেই আবীরের গন্ধ আর প্রেমে দোলা দেওয়া যৌবনে হৃদয়ে নীলকন্ঠ পাখির নাচের ছন্দ। বহু ভেঙে যাওয়া প্রেম কাহিনী স্মরণে নয়ন ছলছল করা আর মেঘে ঢাকা তারাদের মতো প্রেমিক- প্রেমিকার কথা হৃদয় মাঝে উঁকিঝুঁকি মারা। ছোটো ছোটো কথা অল্প অপ্ল ব্যথা সবই তো হৃদয়কে স্পর্শ করে এই নব ফাল্গুনের দিনে। ছেলে বেলার হারিয়ে যাওয়া কত প্রেম যৌবনে জেগে ওঠে বসন্তের আনমনা দিনে। কখনও তো মনে হয়,দৌড়ে গিয়ে ঝাপটে ধরি তারে। কিন্তু কোথায় গেলে পাবো তারে! কেউ সন্ধান পায়, কেউ পায় না। যত সব মনে জাগে এই নব ফাগুনের দিনে আর ঝাউ বনে মরমরিয়ে ওঠে দুঃখ সুখের গান।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct