এম ওয়াহেদুর রহমান
বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় বিশ্বনন্দিত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য সম্ভার বহুল তথা বৈচিত্র্যময়। তিনি ‘ গুরুদেব ‘ ‘ কবিগুরু ‘ কিংবা ‘ বিশ্বকবি ‘ অভিধায় ভূষিত।সাহিত্যের এমন কোন ধারনা নেই যেখানে রবীন্দ্রনাথের ছোঁয়া লাগেনি।আজকের পৃথিবীতে যে শোষণ, নিপীড়ন, হিংসা , বিদ্বেষ , অসহনশীলতা , ক্ষমতার দম্ভ , প্রাচুর্যের অশ্লীল প্রদর্শন,আর পৃথিবীব্যাপী যে বহুধা বিভক্ত শক্তির প্রদর্শনী এ - সব কিছুর ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের মানবধর্মের চাইতে বেশি প্রাসঙ্গিক আর কি কিছু হতে পারে ?তাঁর অবদানে বাংলা সাহিত্য সর্বোপরি ভারতীয় সাহিত্য সমৃদ্ধ। তিনি শুধু বাঙালির নন, সকল ভারতীয়দের নিকটে গর্বের। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য যুগে যুগে প্রাসঙ্গিক, কেননা তাঁর সাহিত্য মানুষের জীবনের গভীরতা, সৌন্দর্য, জটিলতাকে তুলে ধরে এবং মানবতা ও বিশ্বজনীনতার প্রতি গভীর মনোযোগ দেয়। মনুষ্যত্ববোধের উৎকর্ষ সাধনই ছিল তাঁর সাহিত্যের মূলমন্ত্র। আসলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টিকর্ম তাঁর রচিত কাব্য, উপন্যাস,গল্প,নাট্য সাহিত্য, প্রবন্ধ, চিত্রকলা ও সঙ্গীতের মধ্যে ছড়িয়ে রয়েছে।
রবীন্দ্র সাহিত্যের কেন্দ্রে রয়েছে মানুষ।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য মানবজীবনের গভীরতা, সৌন্দর্য এবং জটিলতাকে তুলে ধরে। তাঁর কবিতা, গান, উপন্যাস এবং নাটক আজকের দিনে ও মানুষের মনের গহীনে গভীর প্রভাব ফেলে।তাই তো তাঁর সাহিত্য কালের পথ পরিক্রমা করে নতুনত্বের আঙ্গিকে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠে। তিনি শিক্ষা, ভাষা,শিল্প, জীবন চর্চার নানান গুরুত্বপূর্ণ খুঁটিনাটি বিষয়ে লেখনী চালিয়ে, কর্মযজ্ঞে যুক্ত হয়ে আগামী প্রজন্মের মানবিক গুনসম্পন্ন সৃজনশীল মানুষ তৈরির ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ব্রিটিশ ভারতে বাঙালি জাতির জাতীয়তাবাদের উত্থানে , তাঁর চিন্তা, চেতনা, দর্শন, কবিতা,নাটক, উপন্যাস যেমন অগ্ৰণী ভূমিকা পালন করেছিল তেমনি তা আজ ও স্বাধীন ভারতে সমভাবে বাঙালি জাতিকে উজ্জ্বীবিত করে। তবে তাঁর স্বদেশ ভাবনার মৌলিকতা কেবল দেশের স্বাধীনতার মধ্যে নিহিত ছিল না বরং ঔপনিবেশিক শাসনে জন্ম নেওয়া কবির পক্ষে স্বাধীনতার আকাঙ্খা ছিল প্রবল।আর তারই ধারাবাহিকতায় বাক স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, ব্যক্তির স্বাধীনতা, সমাজের স্বাধীনতা ও জাতীয় স্বাধীনতা সম্পর্কিত ভাবনা এবং বাঙালি জাতীয়তার পথ নির্দেশনা ও আমরা তাঁর লেখনীতে পাই ।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়ে তাঁর লেখা স্বদেশ পর্যায়ের গান কেবল ‘ দ্রোহের গান ‘ বা ‘ স্বাধীনতার গান ‘ নয় বরং তা আত্মবিশ্লেষণের,আত্মজাগরণের ও আত্মশুদ্ধির, যা আজও প্রাসঙ্গিক। তিনি রাখী বন্ধন উৎসবের মধ্য দিয়ে যে সম্প্রীতির বার্তা গড়েছিলেন আজ ও তা সমাহারে প্রাসঙ্গিক। তবে তিনি কখনোই উগ্ৰ জাতীয়তাবাদকে স্বীকার কিংবা সমর্থন করেন নি ।মানবপ্রেম, সহানুভূতি এবং মানুষের প্রতি গভীর মনোযোগের জন্য আজ ও মানুষের মনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা তাঁর সাহিত্য বিশেষ স্থান করে নিয়েছে। কেননা তাঁর সাহিত্যে জীবনের বিভিন্ন দিক যেমন প্রেম, সম্পর্ক,দু:খ ,আনন্দ সর্বোপরি মানুষের মানসিক ও আধ্যাত্মিক বিষয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে। তিনি ছিলেন মূলত বিশ্বকবি,তাই তাঁর সাহিত্য বিশ্বজুড়ে মানুষের মন জয় করে নিয়েছে । তাঁর রচনাগুলো কেবলমাত্র বাংলা ভাষার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না বরং বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের নিকটে পৌঁছেছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সময়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পরিবর্তনশীলতার ক্ষেত্রে ও গভীর মনোনিবেশ করেছিলেন। তাঁর সাহিত্য সময়ের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটকে উপস্থাপন করে এবং মানুষের জীবন যাত্রার পরিবর্তনশীলতাকে প্রতিফলিত করে। তিনি একদিকে আধুনিকতা এবং বিজ্ঞানকে গ্ৰহন করেছিলেন, অন্যদিকে ভারতের সংস্কৃতি তথা ঐতিহ্যের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তবে তিনি শুধু সাহিত্য ক্ষেত্রে নয়, শিক্ষা, দর্শনে , সমাজ সংস্কার আন্দোলনে ,মানবতাবাদ প্রকাশে ,প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে মেলবন্ধন ঘটাতে সঙ্গীত জগতে, শিল্পকলা প্রদর্শনে তাঁর অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। তাঁর আলোয় আলোকিত সাহিত্য সম্ভার। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একাধারে প্রকৃতি প্রেমিক, রোমান্টিক, আধ্যাত্মিক, চেতনাবাদী, স্বদেশী চিন্তনে বিশ্বাসী , বহির্বিশ্বের শিক্ষা - সংস্কৃতির মেলবন্ধন কারী । তাঁর এই বহুমুখী প্রতিভা বাংলা সাহিত্যের বৈচিত্র্যময় ধারাকে করেছে সমৃদ্ধশালী। আর এই জন্যই তিনি কিংবা তাঁর সাহিত্য যুগসন্ধিক্ষণে ও প্রাসঙ্গিক। রবীন্দ্রনাথ শুধু সমকাল কিংবা আধুনিক নন , তিনি একেবারেই চিরকালের ।তাই তিনি প্রাসঙ্গিক। তাঁর প্রয়োজন কখনও ফুরাতে পারে না। জাতির সংকটে , উৎসবে কিংবা অপার আনন্দে ও রবীন্দ্রনাথ আমাদের প্রতিদিনের প্রতিমুহূর্তের অনুপ্রেরণা। যতই দিন যাচ্ছে ততই তাঁর রচনার নান্দনিক, দার্শনিক, কাঠামোগত,আন্ত: সাংস্কৃতিক, পারিবেশিক এবং মানবতাবাদী চেতনার উত্তরোত্তর পুনর্বীক্ষণ ও পুনর্মূল্যায়ন হয়ে চলেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তিনি ক্রমাগত নন্দিত, পঠিত ও বিবেচিত হওয়ার কারণে তাঁর উপস্থিতি সর্বত্রই অনিবার্য হয়ে উঠেছে।তাই তো তিনি বাংলাভাষার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct