পাশারুল আলম, আপনজন: বর্তমান বিশ্বে ভুল তথ্য এবং বিভ্রান্তি ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়েছে, যা ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে নানা ধরনের সমস্যা তৈরি করছে। ডিজিটাল মাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ প্ল্যাটফর্মের সহজ লভ্যতার ফলে এখন সত্য এবং মিথ্যা তথ্যের মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন হয়ে গেছে। এ বিষয়ে উত্তর দিনাজপুর জেলার ইসলামপুর মহকুমা প্রেসক্লাবের উদ্যোগে এক কর্মশালা আয়োজন করা হয়েছিল। এই কর্মশালায় উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট গবেষক সুমিতা যশওয়াল । এই আলোচনায় তিনি হাতে কলমে উপস্থিত ব্যক্তিদের ভুল তথ্য ও বিভ্রান্তি মূলক সংবাদ বিষয়ে আলোচনা, মিথ্যা ও ভুল তথ্য পরীক্ষা করার প্রন্থা দেখান এবং এর প্রতিকার কিভাবে করা সম্ভব সে বিষয়ে আলোচনা করেন।
প্রতিনিয়ত আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে নানান ধরনের ভুল তথ্য ও মিথ্যা সংবাদ ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ ধরনের ভুল তথ্যের কারণে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এবং বৃহত্তর সমাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সঠিকভাবে এই সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে এবং মোকাবিলা করতে, আমাদের প্রযুক্তিগত সরঞ্জাম ও সমালোচনামূলক চিন্তার দক্ষতা থাকা জরুরি। আসলেই ভুল তথ্য এবং বিভ্রান্তি ছড়ানো উদ্দেশ্যে সৃষ্ট সংবাদ ও তথ্যের মধ্যে মৌলিক তফাৎ রয়েছে। ভুল তথ্য হল এমন তথ্য যা ভুল হলেও ইচ্ছাকৃতভাবে ছড়ানো হয়নি, মানে এটি শেয়ারকারী হয়তো জানেই না যে এটি ভুল। অন্যদিকে, বিভ্রান্তি ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর জন্য তৈরি করা হয়, যা অনেক সময় রাজনৈতিক বা আর্থিক লাভের জন্য করা হয়। এই মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দল দোকান খুলে বসে আছে। এই আইটি সেল গুলি মিথ্যা কনটেন্ট তৈরি করে এবং জনগণের কাছে এই মিথ্যা তথ্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য একটি আইটি সেল তৈরি করে। মুহূর্তের মধ্যে মিথ্যা তথ্যটি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। এবং এতে সমাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অনেক গবেষণা দেখিয়েছে যে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুল তথ্য সত্য খবরের চেয়ে দ্রুত ছড়ায় কারণ এটি প্রায়শই মানুষের আবেগকে উত্তেজিত করতে পারে। যেমন, রাজনৈতিক বিভ্রান্তি সমাজে বিভাজন বাড়ায় এবং নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে।
এছাড়া রয়েছে ভিজ্যুয়াল বিভ্রান্তি যা ফটোশপ ও অপটিক্যাল ইলিউশনের প্রভাব সমাজে ব্যাপক আকারে পড়ে। ছবি ও ভিডিওতে ব্যবহৃত ভিজ্যুয়াল ম্যানিপুলেশন মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য সহজেই ব্যবহার করা যায়। ফটোশপ বা অন্যান্য সফটওয়্যারের মাধ্যমে ছবি পরিবর্তন করে মিথ্যা প্রমাণ উপস্থাপন করা যায়। এতে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে ভুল ধারণা পোষণ করতে পারে। এই ছবি ও ভিডিও মেডিকুলেশন করার জন্য সহজলভ্য অ্যাপসগুলি সকলে ব্যবহার করতে পারে। যারা একটু সিদ্ধহস্ত তারা দ্রুত এই কাজটি করে সমাজের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ায়। একদিকে বিভিন্ন অ্যাপসের সহযোগিতা অন্যদিকে এ আই প্রদত্ত কৌশল দিয়ে মিথ্যাকে সত্য প্রমাণিত করার যে প্রচেষ্টা চলছে, সেই প্রচেষ্টায় দেশের ও দেশবাসীর ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। একটি বিখ্যাত উদাহরণ হল “Müller-Lyer illusion”, যেখানে দুটি লাইন একই দৈর্ঘ্যের হলেও ভিন্ন মনে হয়। এমন বিভ্রম মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে সহজেই প্রতারিত করে। ম্যানিপুলেটেড ছবি বা ভিডিওও আমাদের চোখকে এভাবেই বিভ্রান্ত করতে পারে। ভিজ্যুয়াল বিভ্রান্তি চিহ্নিত করার বিভিন্ন সরঞ্জাম রয়েছে। বিভ্রান্তিকর ছবি চিহ্নিত করার জন্য কিছু প্রযুক্তিগত সরঞ্জাম খুবই কার্যকর। গুগল লেন্স বা ইয়ানডেক্সের মতো রিভার্স ইমেজ সার্চ টুল ব্যবহার করে একটি ছবির আসল উৎস বের করা যায়। এছাড়া remove.bg ব্যাকগ্রাউন্ড পরিবর্তনের মতো চিত্রের ম্যানিপুলেশন বুঝতে সাহায্য করে। যেই মোবাইল দিয়ে ম্যালেপুলেশন সংবাদ ছড়ানো হয়, সেই মোবাইলেই এই সমস্ত মিথ্যা ছবি ও ভিডিও কে যাচাই করার জন্য অ্যাপস গুলি বর্তমান। এইগুলি দিয়ে আমরা সত্য মিথ্যা যাচাই করার প্রাথমিক কাজটুকু করতে পারি। এছাড়া আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম হল InVID, যা ভিডিও ও ছবি যাচাই করার জন্য তৈরি করা হয়েছে। এটি ভিডিও বা ছবির মেটাডেটা পরীক্ষা করে এবং প্রকৃত সত্যতা যাচাইয়ে সহায়তা করে। এই টুলগুলো ব্যবহার করে, বিভ্রান্তি ছড়ানোর উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত চিত্র শনাক্ত করা সহজ হয়।
এই সমস্ত অ্যাপসের বাইরেও সমালোচনামূলক চিন্তা এবং সচেতনতা ভুল তথ্য শনাক্ত করতে আমাদের সাহায্য করে। এক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত সরঞ্জামই নয়, বরং সমালোচনামূলক চিন্তারও প্রয়োজন। “মনোযোগ সহকারে শোনা” এবং তথ্যের উৎস ও প্রেক্ষাপট যাচাই করা মিথ্যা তথ্য বুঝতে সাহায্য করে। ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থাগুলি মানুষকে উৎস যাচাই করতে এবং আবেগপ্রবণ ভাষা থেকে সাবধান থাকতে উৎসাহিত করে, যা প্রায়ই যাচাই ছাড়াই মানুষের আবেগকে উত্তেজিত করে। আজকাল তো সত্য অপেক্ষা মিথ্যার প্রচলন এত ব্যাপক হয়েছে যে, এ বিষয়ে জাতীয় স্তরে রাজ্য স্তরে এমনকি আঞ্চলিক স্তরে একটি করে সংস্থা খোলা আবশ্যিক হয়ে উঠেছে। যদিও মোঃ জুবের ও বিভিন্ন বড় বড় সংবাদ মাধ্যম এই ব্যবস্থা রেখেছে কিন্তু ভাইরাল হওয়া বিষয়গুলির উপরে তাদের গুরুত্ব থাকে কিন্তু স্থানীয়ভাবে যখন কোন বিষয় ছড়িয়ে পড়ে তার ওপর তেমন তাদের নজর পড়ে না। তাই স্থানীয়ভাবে এই উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে ধীরে ধীরে মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন এক সময় আটকে যেতে পারে। এই কাজে বিভিন্ন প্রেসক্লাব গুলি অগ্রণী ভূমিকা নিতে পারে এবং মিথ্যা সংবাদ এর কাউন্টার করে সত্য খবর জনসম্মুখে তুলে ধরতে সহায়ক ভূমিকা নিতে পারে।
রাজনৈতিক বিভ্রান্তি আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াগুলিকে প্রভাবিত করে। মিথ্যা খবর বা ম্যানিপুলেটেড ছবি ভোটারদের মতামতকে প্রভাবিত করে এবং নিজেদের পক্ষে টানার চেষ্টা করে। শুধু তাই নয়, এই বিভ্রান্তি গুলি সমাজে বিভাজন তৈরি করে। এ ধরনের বিভ্রান্তি প্রতিরোধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, যেমন, ভুল তথ্যের পতাকা দেওয়া বা অপসারণ করা। তবে, এটি সম্পূর্ণ সমাধান নয়। রাজনৈতিক বিভ্রান্তি ঠেকাতে সচেতনতার গুরুত্ব অপরিসীম।
এই বিষয়ে আলোচনা করার সময় আরেকটি বিষয় জনসম্মুখে তুলে ধরা বিশেষ প্রয়োজন। তা হল - আজকাল প্রায় বিভিন্ন ব্যক্তির মোবাইলে এসএমএস করা হয়। এতে বিভিন্ন রকমের প্রলোভন দেওয়া হয়। যেমন, ঋণ সংক্রান্ত, ব্যাংক সংক্রান্ত, আর্থিক সহায়তা সংক্রান্ত কিংবা লটারি সংক্রান্ত। এই ধরনের নানা প্রলোভনের সাথে সাথে বিভিন্ন ধরনের অ্যাপস ডাউনলোড করার জন্য আবেদন করা হয়। শুধু তাই নয়, সরকারিভাবে সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্য প্রলোভন দিয়ে লিংক সরবরাহ করা হয়। এইগুলি মানুষকে বহু ক্ষেত্রে সর্বশান্ত করে দেয়। তাই জেনুইন অ্যাপস ছাড়া অন্য কিছু ডাউনলোড করা অনুচিত। প্রতারকরা বহু সময় ওটিপি চেয়ে বসে কিংবা ডিজিটাল এরেস্ট করার ভয় দেখিয়ে মানুষকে প্রতারণা করে। এগুলি বিষয়েও সাধারণ মানুষকেই সতর্ক থাকা উচিত। ভুল তথ্য, বিভ্রান্তি ও প্রতারণা প্রতিরোধে শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ। গণমাধ্যম বিষয়ে দক্ষতা বাড়ানো এবং যাচাই করণের সরঞ্জাম সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা। এই প্রচেষ্টায় মানুষকে বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করবে। বিভিন্ন রকম কর্মশালার মধ্য দিয়ে ডিজিটাল যুগে ভুল তথ্য ও বিভ্রান্তি প্রতিরোধে আমাদের প্রযুক্তিগত জ্ঞান এবং সমালোচনামূলক চিন্তার বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করবে। যা একটি সচেতন ও স্থিতিশীল সমাজ গড়ে তুলতে সহায়ক হবে।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct