শিক্ষা ও সমাজ অগ্রগতির প্রেক্ষাপটে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০
সজল মজুমদার
শিক্ষা হলো ব্যক্তির জীবনব্যাপী ক্রম বিকাশের এক ছেদহীন প্রক্রিয়া যা নিত্যনতুন অভিজ্ঞতা অবচেতনভাবে অর্জনের মাধ্যমে তাকে পরিবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গে সুষ্ঠ ও সার্থক সংগতিবিধানে এবং সমাজের বহুমুখী দায়িত্ব পালনে সক্ষম করে তোলে। প্রসঙ্গত স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিভিন্ন সময়ে পরিমার্জিত, পরিবর্ধিত, ও সমৃদ্ধ করে তোলার জন্য বিভিন্ন শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছিল। ১৯৪৮-৪৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশন, ১৯৫২-৫৩ সালে মাধ্যমিক শিক্ষা কমিশন, ১৯৬৪-৬৬ সালে গঠিত কোঠারি কমিশন, পরবর্তী সময়ে ১৯৮৬ সালে গৃহীত জাতীয় শিক্ষানীতি, এছাড়া ভারতীয় সংবিধানের শিক্ষা সংক্রান্ত নানান বিধি ও ধারাতেও শিক্ষার যাবতীয় বিষয় বিশদে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তবে শিক্ষাক্ষেত্রে জাতীয় শিক্ষানীতি ১৯৮৬ একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। সাধারণ শিক্ষা কাঠামো, জাতীয় কোর পাঠক্রম, উপযুক্ত ভাষা নীতি, উচ্চশিক্ষা ও বিদ্যালয় শিক্ষার সার্বজনীনতা, অর্থপূর্ণ অংশীদারিত্ব, জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে শক্তিশালী করা, বিদ্যালয় স্তরে অপারেশন ব্ল্যাকবোর্ড কর্মসূচি, মুক্ত শিক্ষা ও দূর শিক্ষার বিকাশ সাধন এগুলো উক্ত শিক্ষা নীতির অন্যতম অংশ। অন্যদিকে সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ এর ধরন ধারণ সমীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায় তার নির্যাস অনেকটাই পরিশোধিত ও সমৃদ্ধ। এই শিক্ষা নীতির কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য সমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য যেগুলো হলো ১০+২ শিক্ষা কাঠামো পরিবর্তন করে ৫+৩+৩+৪ আঙ্গিকে আনার কথা বলা হয়েছে। আরো একধাপ এগিয়ে ৩-১৮ বছর পর্যন্ত বাধ্যতামূলক শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। প্রাক প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর অবধি শিক্ষাদানের পর্ব কে তিনটি ভাগে বয়স হিসেবে বিভক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি আগামীতে স্কুল শিক্ষায় চালু হতে পারে মাল্টিডিসিপ্লিনারি কোর্স। মানে কলা,বিজ্ঞান,বাণিজ্য বিভাগের শৃঙ্খলা ভেঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের যে কোন বিষয় নির্বাচনের স্বাধীনতা দেওয়া হবে। তবে এই কোর্স নিয়ে গভীরভাবে ভাবলে শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে সেটি ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক হবে সেটা সময়ই বলবে। ত্রি ভাষা সূত্রকে গুরুত্ব দিয়ে আদি ভাষা সংস্কৃত এবং জাতীয় ভাষা হিন্দিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। তথাপি নিজ নিজ ক্ষেত্রে মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের কথারও উল্লেখ রয়েছে। প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি বুনিয়াদি শিক্ষাকে আরো শক্তিশালী করে তোলার জন্য বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে আরো আধুনিকভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছে। স্কুল কমপ্লেক্স গঠনের কথা বলা হয়েছে। এই স্কুল কমপ্লেক্স একটা প্রশাসনিক ইউনিটের মতো কাজ করবে। উচ্চ শিক্ষাকে সমৃদ্ধ করে তোলার জন্য গঠন করা হয়েছে হায়ার এডুকেশন কাউন্সিল ওফ ইন্ডিয়া। প্রবেশিকা পরীক্ষার ধরন ধারণ পরিবর্তন করবার কথা বলা হয়েছে। সর্বোপরি নতুন জাতীয় শিক্ষা নীতিতে যে বিষয়টিতে আলোকপাত করা হয়েছে তা হলো ৪০ শতাংশ অনলাইন শিক্ষা এবং ৬০ শতাংশ অফলাইন শিক্ষার ব্যবস্থাপনা। অনলাইন শিক্ষার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষাদানের ভিডিও রেকর্ডিং, নোটস, মেটেরিয়ালস, ওয়েবিনার, ই কনফারেন্স, ইত্যাদি। পক্ষান্তরে ৬০ শতাংশ অফলাইন শিক্ষার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ১০ থেকে ১৫ মিনিটের শর্ট লেকচার ফেস টু ফেস মোড পদ্ধতি, লাইব্রেরী ভিজিট, ফিল্ড ভিজিট, স্পোর্ট স, ফিজিক্যাল ট্রেনিং, অ্যাপ্রেন্টিসশিপ ইত্যাদি। পাশাপাশি নতুন শিক্ষা নীতিতে গবেষণার ক্ষেত্রে ন্যাশনাল রিসার্চ ফাউন্ডেশন গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। দেশের জাতীয় প্রয়োজনকে গবেষণার ক্ষেত্রে অনুমোদন করবে এই NRF। এছাড়াও আরো বিভিন্ন আনুষাঙ্গিক বিস্তৃত অংশ রয়েছে জাতীয় শিক্ষা নীতিতে। তথাপি জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ শিক্ষা ও সমাজ অগ্রগতির পক্ষে প্রকৃতভাবে কতটা কার্যকরী হতে চলেছে তা আগামী সময়ই জানান দিবে। সর্বোপরি ভারতীয় শিক্ষার সার্বিক বিকাশে একটা বিরাট সময়ের ব্যবধানে শিক্ষা ব্যবস্থাকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে মনোগ্রাহী করে তোলবার ক্ষেত্রে তথা শিক্ষার গুণগত ও ধারণাগত পরিবর্তন, পরিবর্ধনে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা কমিশন ,এবং জাতীয় শিক্ষানীতি সমূহ এক অসামান্য অবদান রেখে চলেছে।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct