কেন্দ্রের মসনদে দ্বিতীয়বারের মতো ‘সম্রাটের’ ভূমিকায় নরেন্দ্র মোদি। তার শাসনামলে দেশের মুদ্রাস্ফীতি তলানিতে, বৃদ্ধি পেয়েছে বিদ্বেষের মাত্রা। যদিও নির্বাচনে ডাক দিয়েছিলেন ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’। বাস্তবে তার যথার্থ প্রতিফলন না ঘটলেও প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসে নিজের ইমেজ তৈরি করতে সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছেন। তা নিয়ে আলোকপাত করেছেন ড. দিলীপ মজুমদার।
গোলওয়ালকর বেশ কয়েকটি বই লিখলেও তাঁর খ্যাতি ‘উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইনড ‘ এবং ‘বাঞ্চ অব থটস’কে ঘিরে। বইদুটি থেকে আমরা তাঁর কিছু বক্তব্য পরিবেশন করব, যা প্রমাণ করবে কিভাবে গোলওয়ালকর হিন্দুত্ববাদের রাজনৈতিক রূপ দিয়েছিলেন। গোলওয়ালকরের সেই সব বক্তব্যের সূত্র ধরে বর্তমানকালের বিজেপি তাদের কর্মপদ্ধতি তৈরি করেছে।
১] ভারত হিন্দুদেরই দেশ। শিখ, জৈন, বৌদ্ধ কিংবা আদিবাসীদের নিয়ে ভারতের সমস্যা নেই । ভারতের সমস্যার মূলে আছে মুসলমান ও খ্রিস্টানরা। এদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের ক্ষমাহীন যুদ্ধ।
২] যারা বলে ‘হিন্দ মুসলমান ঐক্য ছাড়া স্বরাজ সম্ভব নয়’, তারা দেশদ্রোহিতার অপরাধে অপরাধী।
৪] হিন্দু ভারতে সমতা বা সম-অধিকারের ভিত্তিতে মুসলমানদের স্থান থাকবে না। মুসলমানরা নিজেদের মতো উপাসনা করতে পারবে, তবে হিন্দুদের সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্বের কাছে মাথা নত করলে তারা ভারতে থাকার অধিকার লাভ করবে, তার আগে নয়।
৫] হিন্দু মানসে অক্ষমতার বীজ বপনের জন্য দায়ী নেতৃবৃন্দ। যে জাতি শিবাজির মতো বীরের জন্ম দিয়েছে, তাদেরকে অক্ষম বলে তাদের স্পিরিট নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। যদুনাথ সরকার ঠিকই বলেছেন –’ সারা দুনিয়ার কাছে প্রমাণিত হয়েছে যে হিন্দুরা অমরত্বের ঝরনা থেকে পান করেছে মৃতসঞ্জীবনী।‘
৬]মুসলমানরা অস্পৃশ্য, বহিরাগত লুঠেরা।
৭] নিজেদের জীবন রক্ষার্থে অথবা স্বার্থলোভে হিন্দুরা মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করেছে। এই দুর্বলচেতা ধর্মান্তরিত হিন্দুদের বংশধর বা তাদের পরবর্তী প্রজন্ম হচ্ছে এখনকার মুসলমান। এদের রাষ্ট্রীয়ভাবে কনসেশন দেওয়া উচিত নয়।
৮] আওরঙ্গজেব এক কুখ্যাত হিন্দু-ইরোধী ফ্যানাটিক। তার যে সব হিন্দু জেনারেল ছিল তারা আসলে গদ্দার। মানসিংহ আকবরের হয়ে ধাওয়া করেছিল রানা প্রতাপকে, তেমনি রাজা জয় সিং, যশোবন্ত সিং আওরঙ্গজেবের হয়ে তাড়া করেছিল শিবাজিকে। দেশের মানুষ হয়ে যারা দেশের মানুষকে আক্রমণ করে তারা গদ্দার ছাড়া আর কিছুই নয়। এইজন্য গীতায় বলা হয়েছে –‘আমরাই আমাদের বন্ধু এবং আমরাই আমাদের শত্রু’।
৯] বখতিয়ার খিলজি এক রক্তপিপাসু মানুষ। সে রক্তের নদী বইয়ে দিয়ে গেছে, মাস কনভারশন করিয়েছে, নারী অপহরণ করেছে, মন্দির ধ্বংস করেছে, নালন্দা বিহারের হাজার হাজার ছাত্র ও শিক্ষককে কসাইএর মতো জবাই করেছে, শহরের জনগণের শিরচ্ছেদ করেছে, গ্রন্থাগারে আগুন দিয়ে হাজার হাজার বছরের জ্ঞানসাধনার ক্ষেত্রকে বনফায়ার বানিয়েছে।
১০] হিন্দুদের মারাত্মক দুর্বলতার ফলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে।
১১] পাঞ্জাব আর বাংলা হল বেদের জন্মস্থান। এখানে ছিলেন সাধু, কবি আর বিপ্লবীরা। এই পাঞ্জাব আর বাংলার অর্ধেক অংশ হস্তগত হয়েছে হিন্দুর শত্রু মুসলমানদের।
১২] তাজমহল নিয়ে গর্ব করে না এমন হিন্দু দুর্লভ। তাদের মনোভাব এমন যে ইসলামি স্থাপত্য যেন ভারতের অংশ, ভারতীয় গর্বের প্রতীক, অথচ যাদের হাতে এসব প্রতিষ্ঠিত তারা ইসলামের অনুসারী ; সেই মুসলিমরা হাজার বছর ভারতে বাস করলেও আসলে তারা বহিরাগত।
১৩] ভারতের ইতিহাসকে বিকৃত করা হচ্ছে। হিন্দুদের স্বর্ণযুগ রামায়ণ মহাভারতের সময়কালকে উল্টে-পাল্টে দেওয়া হচ্ছে ; এসবকে মাইথলজি, গল্পগাথা আর অন্ধকার যুগ বলা হচ্ছে। হিন্দুদের ইতিহাস সোনার অক্ষরে লেখা হলেও তাকে অন্ধকার যুগ বলা হচ্ছে।
১৪]ভারতে হিন্দুজাতি ছাড়া অন্য কোন জাতির গৌরবগাথা থাকতে পারে না। ভারতের আদিতেও হিন্দু আর অন্ত্যেও হিন্দু, মাঝামাঝি আর কিছু নেই।
১৫] খ্রিস্টান কনভেন্টগুলি এ দেশের হিন্দুদের মগজ ধোলাই করছে।
১৬] ইংরেজি শিক্ষিত হিন্দুরা অতীতের হিন্দুযুগকে অজ্ঞতা আর অন্ধকারের যুগ বলে মনে করছে। এটা তাদের মগজ ধোলাইএর ফলেই হয়েছে।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে গোলওয়ালকরের এই সব বক্তব্য সাম্প্রতিককালের বিজেপি নেতাদের কণ্ঠ থেকেও উচ্চারিত হচ্ছে। গোল্পয়ালকর যে বাস্তবিক তাঁদের ‘গুরুজি’ সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এবার ভারতীয় রাজনীতিতে এই হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতি কিভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠল, সে বিষয়ে আমরা আলোকপাত করব। এই বিষয়ের কারিগর অটলবিহারী বাজপেয়ী ও লালকৃষ্ণ আদবানি।১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। বাজপেয়ীস্হ বহু বিরোধী নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই সময়ে আর এস এসএর সর্বক্ষণের কর্মী বা প্রচারকরা গোপনে গোপনে কগজপত্র বিলি করছিলেন, কোথাও কোথাও আইন অমান্য করছিলেন। অটলবিহারী বছরখানেকের মধ্যে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে একটি মোর্চা গঠনে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন। সেই মোর্চার নাম ‘জনতা পার্টি’। এই মোর্চার মধ্যে বিজেপির পূর্বসূরী জনসংঘও ছিল। সংসদের মোট ৫৪২টি আসনের মধ্যে জনতা পার্টি মোট ২৯৮ টি আসনে জয়লাভ করে। জনসংঘের আসন ছিল ৯০টি। প্রধানমন্ত্রী হবার দাবি অটলবিহারী জানাতে পারতেন, কিন্তু বয়েসের কারণে (তখন তাঁর বয়েস ছিল ৫২ বৎসর ) সে দাবি জানান নি। প্রধানমন্ত্রী হন মোরারজি দেশাই। জনসংঘের থেকে ৩জনকে মন্ত্রী করা হয়। ভারতের রাজনীতিতে হিন্দুত্ববাদীদের এভাবেই উথ্থান ঘটে। ১৯৮০ সালে জনতা পার্টির পতন হলে বাজপেয়ী প্রস্তাব করেন যে জনসংঘকে নতুন মোড়কে একটি মূলধারার রাজনৈতিক দলে পরিণত করতে হবে। এভাবেই জন্ম হল বিজেপির। ১৯৮৪ সালের নির্বাচনে সংসদে বিজেপি লাভ করেছিল মাত্র ২টি আসন।এই পরিস্থিতিতে বিজেপি রামজন্মভূমি আন্দোলনকে হাতিয়ার করে। রামরথযাত্রা পরিচালনা করে। হিন্দু ভোট ব্যাঙ্কের দিকে বিশেষ লক্ষ্য ছিল তাঁদের।১৯৯০ সালের ৩০ অক্টোবর রথযাত্রার কর্মসূচি শুরু হয়। ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জয়পুরে বিজেপির কর্মসমিতির বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়। ১৯৯২ সালের ৫ ডিসেম্বর বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সাধুরা এক সভায় মিলিত হন। শুরু হয়ে যায় করসেবকদের কাজ। ১৯৯২ সালের ৫ ডিসেম্বর বাবরি ধ্বংসের মহড়া দেওয়া হয়েছিল বলে সাংবাদিক প্রভিন জৈন জানিয়েছেন। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর আর এস এস ও তার সহযোগী সংগঠন অযোধ্যায় এক শোভাযাত্রার আয়োজন করে। পুলিশ থাকলেও উন্মত্ত জনতাকে প্রতিরোধ করতে কিন্তু সক্ষম হয় নি। আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক সঞ্জয় শিকদার লিখেছেন, “ ৬ ডিসেম্বর সকালে অযোধ্যায় সাজ-সাজ রব। পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। প্রশাসন ঘোষণা করল: বাবরি মসজিদের কাছে ঘেঁষতে দেওয়া হবে না। যথারীতি মসজিদ ঘিরে রেখেছিল অসংখ্য পুলিশ। হিন্দি বলয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতায় জানা ছিল, উত্তরপ্রদেশের পুলিশ ও প্রভিন্সিয়াল আর্মড কনস্টেবুলারি-এর মধ্যে জাতপাত ও সম্প্রদায়গত বিদ্বেষ যথেষ্ট।ফলে প্রশাসনের গোপন বরাভয়ে পুলিশের একাংশ লোকদেখানো ভূমিকা পালন করেছিল। অচিরেই হাজার হাজার করসেবক মসজিদে চড়ে বসলেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ধ্বংস হয়ে গেল ষোড়শ শতকের প্রাচীন মসজিদ।“ সংগঠিত পরিকল্পনা এবং নিঁখুত দক্ষতা ছাড়া এটা কি সম্ভব? সত্যই কি আদবানি কিছু জানতেন না? না কি তাঁর বিষণ্ণতা ছিল সামগ্রিক পরিকল্পনার অঙ্গ?”ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদন এই রকম, “ ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর। সকালবেলা। শীতের শান্ত সকাল। বাবরি মসজিদের সামনে জড়ো হয়েছেন হাজার হাজার করসেবক। একটা ঘরের ছাদ থেকে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছেন বিজেপি ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতারা। উত্তেজনার পারদ চড়ছে। বাবরি মসজিদের লঘু নিরাপত্তা বলয় ভেদ করে একদল করসেবক উঠে গেলেন মসজিদের কেন্দ্রীয় গম্বুজের উপরে। কাছেই দাঁড়িয়েছিলেন সরকারনিযুক্ত পুরোহিত সত্যেন্দ্র দাস।তিনি রামলালার মূর্তি রক্ষার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। করসেবকরা তখন শাবল, হাতুড়ি, কোদাল নিয়ে মসজিদ ভাঙার কাজ শুরু করে দিয়েছেন। অমিত উৎসাহ তাঁদের। কলের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে দেখছেন প্যারা মিলিটারি সৈন্য । “
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct