সেলাই দিদিমণি
তাপস কুমার বর
মিথিলা, এখনো সেই সেলাই মেশিনে নিজের স্বপ্নের স্মৃতিগুলো আগুনের লাভায় বিসর্জন দিয়ে দিয়েছে। কখন যে,আবির মাখা রং রক্তের শিরা-উপশিরায় বসে গেছে, মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে মিথিলা কিছু ভাবে,... “হয়তো, তুমি সেদিন ছুটে আসতে বার বার কাছে। আজ তুমি অন্য আবিরের সংসার বানিয়ে ফেলেছো নিজের স্মৃতি চূর্ণবিচূর্ণ করে”। - সেলাই মেশিন এখন মিথিলার বাঁচার একমাত্র পথ, সারাদিন সেলাই কাজে নিজেকে ব্যস্ত করে ফেলে। মিথিলার বাবা ও মা আজ থেকে দশ বছর আগে ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা গেছে। দিন কুলে আর কেউ নেই মিথিলার। মা সারদা দেবী অনাথাশ্রমে মিথিলা নিজের জীবন সমর্পিত করেছে। সেই ছোট্ট অনাথাশ্রমকে আজ সকলে একডাকে চেনে “সেলাই দিদিমণির নামে”! জীবন এখনো ধুঁকছে, সম্বলগুলো যদি দূরে সরে যায়। মিথিলার জীবনে ও প্রেম এসেছিল। সেটা বাস্তব না অ-বাস্তব মিথিলা এখনো তার উত্তর খুঁজে যাচ্ছে। মহেশপুর গ্রামে “জুনিয়র শিক্ষানিকেতন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের” শিক্ষক সমরেশ ভট্টাচার্য মিথিলাদের আশ্রমের পাশের বাড়িতে তিনি ভাড়াটে থাকতেন। সময়ক্রমানুসারে মিথিলা ও সমরেশ নিজেদের ভালোবেসে ফেলেছে, দু’জনের মনের গভীরে একে অপরের প্রতি একটা জিজ্ঞাসা বার বারে মনের গভীরে এসে মুখের ভাষা মুখেই থমকে যায়। মিথিলা অনাথাশ্রমকে নিজের মায়ের মতো করে স্নেহ করে। সারাদিন, রান্না করা, অনাথ শিশুদের পড়ানো, এবং সময় পেলে সেলাই কাজে নিজেকে ব্যস্ত করে তোলে। স্কুল ছুটি হলে, সমরেশ বাড়ি ফেরার পথে, প্রতিদিন একবার মিথিলা সঙ্গে দেখা করে যেতো। এইভাবে তাদের গভীরতা বাড়তে থাকলো,...“সেদিন দূরে দাঁড়িয়ে সমরেশ, মিথিলাকে বার বার বলছে, আমার জন্য একটা রুমাল বানিয়ে দেবে”!মিথিলা সেদিন সেলাই মেশিনে, নিজের সর্বস্ব দিয়ে রুমালের কারুকার্যে লিখে দিয়েছিল “তোমাকে দিলাম উপহার”! সমরেশ সেই রুমাল পেয়ে মিথিলাকে বলেছিল,...“অনেক ভালোবাসো আমায়, তাই না মিথিলা, আমি ও তোমায় ভীষণ ভালোবাসি”। - সেদিন লজ্জায় মিথিলা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। আজ কোথায় সমরেশ? তিনবছর আগে যে সমরেশ মিথিলার জন্য, বার বার ছুটে আসতো আশ্রমে, আজ সে বদলে গেছে। তাদের গ্রামের “জুনিয়র শিক্ষানিকেতন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের” স্কুল থেকে তিনবছর আগে ট্রান্সফার হয়ে গেছে দার্জিলিং- এ। শুনেছি নতুন সংসার করেছে। আজ মিথিলা, সেলাই মেশিনের শব্দে সমরেশের প্রতিধ্বনিগুলো এখনো মনে পড়ে। প্রায়, সাতবছর পর, সমরেশ মহেশপুর গ্রামের “জুনিয়র শিক্ষানিকেতন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। সঙ্গে সমরেশের স্ত্রী মণিমালা। সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ভবানী চ্যাটার্জী “শিক্ষক সমরেশ” কে কাছে পেয়ে বললো,.....
“সমরেশ তোমার জন্য এখনো স্কুলের দেওয়াল গুলো নির্জনে কাঁদে, তুমি এই গ্রামকে কত ভালোবাসতে”। - সমরেশ ভবানী চ্যাটার্জীর সঙ্গে দেখা করে। সারদা দেবী অনাথাশ্রমে যায়। কিছুটা দূরে সমরেশ সেই সেলাই মেশিনের শব্দ শুনতে পেয়ে নিজেকে চঞ্চল করে তোলে। একটা পরিচিত দৃষ্টি। মিথিলা সেদিন সমরেশকে সামনে দেখে অবাক হয়েছিল। এখনো তাদের সেই ভালোবাসা অন্তরের গভীরে ক্ষত হয়ে থেকে গেছে। সমরেশ বললো, চিনতে পারছো মিথিলা? মিথিলা মুচকি হাসলো, সমরেশ। মিথিলা বললো সামনে কে? সমরেশ বললো আমার স্ত্রী মণিমালা। মিথিলা দুজনকে আশ্রমে ডেকে অতিথি আপ্যায়নে তাদের মন ভরিয়ে দিয়েছিল। হয়তো, একটা আঘাত “সমরেশ ও জানতো, নীরব শব্দ গুলো বার বার সমরেশের বুকের ভেতরে স্বার্থপরের মতো আঘাত করছে”। সেদিন বিদায়ের পথে মিথিলার চোখে জল এসে গিয়েছিল। মণিমালা বললো, “দিদি আমরা আবার আসবো”। মণিমালা কি জানতো? তার চোখের এক একটা ফোঁটা প্রতিক্ষার যন্ত্রণা। সেদিন সমরেশ মিথিলার চোখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি,.....“ভাষার শব্দজালে বলেছিল কথা, মিথিলা একটা স্বার্থপরকে ক্ষমা করোনা, যে তোমাকে কষ্ট দিয়েছে, তোমার স্বপ্নগুলোকে ভেঙেছে। তাকে অপরাধী বানিয়ে রেখো!”- মণিমালা এই কথার অর্থগুলো বোঝেনি। মিথিলা বুঝেছিল। বিদায়ের শেষবেলাতে,...“সমরেশ ও মিথিলার চোখের দৃষ্টিতে ফোঁটা ফোঁটা জলকোণা মিশ্রিত হয়ে গিয়েছিল। ”- সেই রুমালটা এখনো সমরেশ যত্ন করে রেখেছে কাছে। বিদায় বেলায়,পরপর তাদের পথ অস্পষ্ট হয়ে গেলো দূরের লোকালয়ের ভিড়ে। মিথিলা এখন সেই সেলাই দিদিমণি, পাড়ায় তাকে সকলে “সেলাই দিদিমণি” বলে ডাকে। বুকের ক্ষতগুলো জমাট বেঁধে বেঁধে সাগর থেকে,সে আজ দুখের মহাসাগরে ডুবে গেছে। আশ্রমটা এখন তার মা শেষ জীবনে একমাত্র বাঁচার অবলম্বন। নিশুতি রাতে ঘরে পায় চারি করতে করতে নিজেকে অনমনা করে মিথিলা যেন কিভাবে,.....“তুমি হয়তো, অনেক দূরে, আজও তুমি আমার অন্তরে, আমি ও থেকে গেছি তোমার অন্তরে”!- আশ্রমের দেওয়ালে দেওয়ালে একটা বোবাশব্দ কাঁদছে সেলাইয়ের শব্দগুলো নীরব থেকে গেছে,....“ওই রুমালের স্পর্শগুলো আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে”।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct