দীর্ঘকাল ধরে দুই মহা শক্তিধর দেশ এবং তাদের মিত্র জোট অত্যন্ত সুকৌশলের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য কে তাদের স্নায়ু যুদ্ধের ব্যাটেলফিল্ড হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এর ফলে সেখানকার বিরাট অংশের বেসামরিক নাগরিকদের জীবনহানি হওয়া বা বারবার তাদের ভবিষ্যৎকে যে অনিশ্চিতার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়েছে সে সম্পর্কে উনাদের কোন মাথাব্যথা আছে কি? লিখেছেন চামেলী খাতুন...
“এত বড় মাপের এত ভয়ঙ্কর আঘাত আমি কখনও দেখিনি। ”
গাজায় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করা ৯৯ জন মার্কিন চিকিৎসকদের একটি দল, অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ এবং যুদ্ধবিরতির দাবি জানিয়ে হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট বাইডেন এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস কে খোলা চিঠি দিয়ে লিখছেন,
“এত বড় মাপের এত ভয়ঙ্কর আঘাত আমি কখনও দেখিনি। আমাদের বোমা হাজার হাজার নারী ও শিশুকে হত্যা করছে। তাদের বিকৃত লাশ নিষ্ঠুরতার স্মারক। ”
লিখেছেন ডাঃ ফিরোজ সিধওয়া, ক্যালিফোর্নিয়ার স্টকটনের সান জোয়াকিন জেনারেল হাসপাতালের ট্রমা এবং ক্রিটিক্যাল কেয়ার সার্জন। যিনি দক্ষিণ গাজার শহর খান ইউনিসে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাটিয়েছেন। ১৯ বছরের ফুটফুটে তরুণ শাবান আল-দালুর অগ্নিদগ্ধ শরীর নৃশংসতার স্মারক বইকি।
বড় ধরনের অভিযানের অংশ হিসেবে এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে গাজার উত্তরাঞ্চলে হামলা আরো জোরদার করেছে ইসরায়েল। বেইত হানৌন, জাবালিয়া ও বেইত লাহিয়ার অধিবাসীরা গাজা শহর থেকে ইতিমধ্যে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সিভিল ডিফেন্সের একজন মুখপাত্র বলেছেন আল মুফতি স্কুলে শত শত বাস্তুহারা মানুষ অবস্থান করছিলো বিমান হামলায় সেখানে এক ডজনের বেশি মানুষ নিহিত হয়েছে। আল শাতি শিবিরেও রাস্তায় খেলাধুলার সময় বিমান হামলায় নিহত হয়েছে ৫ জন শিশু। গত ৬ই অক্টোবর ইসরায়েল যে দেইলে এলবালাহ এর মসজিদে বিমান হামলা চালিয়েছে, সেখানেও আশ্রয় নিয়েছিল বাস্তুচ্যুত প্যালেস্টাইনিরা এতেও ২৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই হতাহতের মাঝেই গত ১৬ ই অক্টোবর দক্ষিণ গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনী অপ্রত্যাশিত ভাবে হামাস প্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ারের মুখোমুখি হয় এবং তাকে হত্যা করে। ইসরায়েলের হাতে প্রতিরোধ গোষ্ঠীর পলিটব্যুরোর প্রধান ইসমাইল হানিয়াহের হত্যার পর হামাসের শীর্ষ নেতৃত্বে নির্বাচিত হয়েছিলেন সিনওয়ার। যাকে ইহুদিবাদী রাষ্ট্রের ‘পহেলা নম্বর শত্রু’ বলে মনে করা হয়েছিল। সিনওয়ারের হত্যা ইসরায়েলের তরফ থেকে সামরিক বিজয় বলে দাবি করা হলেও এই হত্যাকাণ্ড ইসরায়েলের পক্ষে বছরব্যাপী যুদ্ধের গতিপথ পরিবর্তন করেছে কিনা তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞ মহল। ‘পাওয়ার কাপল: রাশিয়ান-ইরানিয়ান অ্যালাইনমেন্ট ইন দ্য মিডল ইস্ট’ বইয়ের লেখক ঘোঞ্চেহ তাজমিনি মনে করেন, হামাসের মতো সংগঠনগুলি আদর্শিকভাবে চালিত। তাই মূল নেতাদের সরিয়ে দেওয়া হলেও তাদের পতন সু নিশ্চিত করা সম্ভব না। ঠিক যেমন ইসমাইল হানিয়াহের হত্যা হামাসের সামগ্রিক অপারেশনকে দুর্বল করতে সক্ষম হয়নি। তেমনই সিনওয়ারের হত্যাকাণ্ড ইসরায়েলের জন্য ভিন্ন কোনো পরিণতি বয়ে আনবে না।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপের প্যালেস্টাইনের সিনিয়র বিশ্লেষক তাহানি মুস্তাফার মতে, হয় খলিল আল-হায়া বা খালেদ মেশাল হামাসের শীর্ষ পদে আসতে চলেছেন। খালেদ মেশাল হলেন হামাসের সেই নেতা যাকে ১৯৯৭ সালে জর্ডানে ইসরায়েল তার গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ দ্বারা বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছিল। মোসাদের এজেন্টরা ধরা পড়ে যাওয়ায় ইসরাইলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বা বর্তমানের এই বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে প্রতিষেধক সরবরাহ করতে বাধ্য করা হয়। ফলে সে যাত্রায় খালেদ মেশালের জীবন রক্ষা পায়। আর খলিল আল-হায়া, হলেন গাজায় হামাসের বর্তমান ডেপুটি লিডার এবং সিনওয়ারের সম্ভাব্য উত্তরসূরি। তিনি বর্তমানে কাতারে যুদ্ধবিরতি আলোচনার নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সুতরাং হামাস যেহেতু কোন ব্যক্তি কেন্দ্রিক সংগঠন নয় এবং খালেদ মিশেল কিংবা খলিল আল-হায়ার মতো নেতাদের উপস্থিতি প্যালেস্টাইনি প্রতিরোধ গোষ্ঠীতে নেতৃত্বের সংকট বা নেতৃত্বে শূন্যতা তৈরি করবে না। বরং হামাস বা অন্যান্য গোষ্ঠীর সম্ভাব্য প্রতিশোধমূলক হামলার সাথে ইসরায়েলের সামগ্রিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ মহল। এখনো পর্যন্ত গাজার এই নজিরবিহীন হামলার ৪১ হাজারেরও বেশি নিহতদেরমধ্যে ১৬ হাজারেরও বেশি শিশু। নিউ হিউম্যানটেরিয়ান এর তথ্য অনুযায়ী এর মধ্যে ৩০৬ জন মানবিক সহায়তা কর্মী, , ৯০০জন চিকিৎসা কর্মী এবং১৩০ জন সাংবাদিক। আরএফএস এর তথ্য অনুযায়ী ৩২ জন সাংবাদিককে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে টার্গেট করে হত্যা করেছে। অবশ্য সংবাদমাধ্যমের উপর ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর হামলা এই প্রথম নয়। আরব বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিকদের মধ্যে একজন শিরিন আবু আকলেহ, যিনি ছিলেন প্যালেস্টাইনি- মার্কিন নাগরিক। ২০২২ সালের ১১ মে প্যালেস্টাইনে পশ্চিম তীরে জেনিন শরনার্থী শিবিরে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী অভিযান পরিচালনা করার সময় তাকে গুলি করে হত্যা করেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গত সপ্তাহে বলেছেন, যুদ্ধরত হাসপাতাল থেকে আহত ব্যক্তিদের সরিয়ে দক্ষিণে নিয়ে যাওয়ার এরকম সাতটি মিশনকে ইসরায়েলি বাহিনী ব্যর্থ করেছে। এই সুপরিকল্পিত এবং সুসংগঠিত গণহত্যার উদ্দেশ্য স্পষ্ট নয় কি - হয় ভূমি ছাড়ো, না হয় মরো?গত এক বছর ধরে গাজায় নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালানোর পর রক্তচক্ষুর নজর এবার লেবাননের উপর। গত ২৩শে সেপ্টেম্বর ধরে লেবাননে হিজবুল্লাহকে লক্ষ্যবস্তু করে চলছে নির্বিচারে বিমান হামলা। বাদ দেওয়া হচ্ছে না মেডিকেল টিম সহ বেসামরিক অবকাঠামো গুলি। এমন কি ছাড় পাচ্ছেন না জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীও। এযাবৎ হামলায় ১৪৩৭ জনের বেশি মানুষ নিহত এবং ৪১২৩ জনেরও বেশি মানুষ আহত হয়েছে। এছাড়া, প্রায় ১৩ লক্ষ লেবাননের নাগরিক বাস্তুচ্যুত হয়ে মানবিক সংকটে পড়েছেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন, ধ্বংসস্তূপ মধ্যপ্রাচ্যের প্যালেস্টাইন ও লেবানন, বাংলাদেশ এবং সুদান সহ বেশ কয়েকটি দেশ গৃহযুদ্ধের কবলে। মানবিক বিপর্যয়ের এই মুহূর্তে নোবেল পুরস্কার কমিটি শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করলেন ‘নিহন হিদানকায়ো’ নামক জাপানি পরমাণু অস্ত্র বিরোধী সংগঠনকে। জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকির পারমানবিক হামলার পীড়িতদের নিয়ে পরমাণু অস্ত্র মুক্ত পৃথিবী গড়ে তোলার পক্ষে এই সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে জোরালো প্রচার চালাচ্ছেন। তাই পারমানবিক অস্ত্র মুক্ত বিশ্ব গড়ার উদ্যোগ এবং প্রচারণার স্বীকৃতি স্বরূপ পুরস্কৃত করে নোবেল কমিটি উল্লেখ করেন, তারা হিরোশিমা ও নাগাসাকির পারমাণবিক বোমার বিপর্যয়কে নিজের চোখে দেখে আসা প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান সবার সামনে তুলে ধরেছেন। যা থেকে বিশ্ববাসী বুঝতে পেরেছে, এ ধরনের অস্ত্র আর কখনোই ব্যবহার করা উচিত হবে না। বিশৃঙ্খলা পূর্ণ অশান্ত যুদ্ধকালীন আবহাওয়ায় নোবেল পুরস্কার কমিটি এই ধরনের একটি সংগঠনকে পুরস্কৃত করে সমগ্র বিশ্বকে যে বার্তা দিতে চাইলেন, সে বার্তায় কি কর্ণপাত করছেন সদা পারমাণবিক দাঁত ফটাতে চাওয়া পশ্চিমা শিবির?হলোকাস্টের মায়ায় পশ্চিমা শিবির এতটাই আচ্ছাদিত যে গত এক বছর ধরে চলা গণহত্যাই তাদের অবস্থার কিঞ্চিৎ মাত্র পরিবর্তন হয়নি। ইসরায়েলের প্রতি তাদের অবস্থান যেন ঐশ্বরিক নির্দেশের সমতুল্য। স্বাভাবতই ইরানের মিসাইল তেল অভীবের সীমানায় দেখা দেওয়া মাত্রই কিয়ার স্টারমার বা ইমানুয়েল মাখোঁ দের ঘুম উড়ে যায়। লক্ষণীয় যে, ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অফ রেড ক্রস (ICRC) ক্রমবর্ধমান সহিংসতা নিয়ে যেখানে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন সেখানে পশ্চিমা শাসকেরা যুদ্ধ বিরতির কোন প্রস্তাবই গ্রহণ করছেন না। উপরন্ত ইসরায়েলের অমানবিক কর্মকান্ডকে দৃঢ় ভাবে সমর্থন করে যাচ্ছেন এবং অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রেখেছেন। সভ্য পশ্চিমা শাসকেরা অমানবিক কর্মকান্ডকে প্রশ্রয় দেন না। কিন্তু অমানবিক কর্মকান্ডকে জিয়ে রাখতে অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রাখতেই পারেন। তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলিকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখতে চাওয়া বর্ণবাদী, বৈষম্যবাদী, সাম্রাজ্যবাদী, লুণ্ঠনকারীদের থেকে আর কি বা আশা করা যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসলীলার পরে বিশ্বে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে আন্তর্জাতিক আইন ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার কাঠামো তৈরি হলো। জন্ম নিল মানবতা বিরোধী অপরাধের ধারণা। মানুষের জীবন এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার মত সার্বজনীন অধিকার সমুন্নত রাখতে আন্তর্জাতিক আইন তৈরি করা হলো। তবে কি তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলির ক্ষেত্রে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ গুলির ক্ষেত্রে এই গুলি প্রযোজ্য নয় ? আন্তর্জাতিক আইন শুধু কি তৃতীয় বিশ্ব দেশগুলোই মানতে বাধ্য? যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার বেসামরিক নাগরিকদের ওপর অবরোধের মাধ্যমে খাদ্য, জল, বিদ্যুৎ ও প্রয়োজনীয় ঔষধি পত্র বন্ধ করে তাদের নরকীয় যন্ত্রণার দিকে ঠেলে দেওয়া মানবতা বিরোধী অপরাধ নয়? আন্তর্জাতিক আইনের চোখে যুদ্ধাপরাধী হয়েও কেন বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে আন্তর্জাতিক বিচারের আওতায় আনা যাচ্ছে না ? কোন রাঘব বোয়ালদের হস্তক্ষেপেই বা নুরেমবার্গ ট্রায়ালের ন্যায় গাজা ট্রায়াল বসানো সম্ভব হচ্ছে না? কোন ঔদ্ধত্য বশত ইসরাইল জাতিসংঘের মহাসচিবকেই ‘পার্সোনা নন গ্রাটা’ ঘোষণা করেন ? এবং লেবানন থেকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীদের তুলে নিতে রীতিমতো হুমকি দিতে থাকেন। তবে কি আন্তর্জাতিক আইন এবং বিধি-নিষেধ গুলিকে পশ্চিমা শিবির নিজেদের সুবিধার্থে ব্যবহার করে পশ্চিম এশিয়া সহ সমগ্র তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির ওপর নতুন করে ছড়ি ঘোরাতে চাইছেন?গত দুই দশক ধরে গাজাবাসীদের অবরোধের মাধ্যমে বহিঃ বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে আপন ভূমিতে নির্বাসনী জীবন অতিবাহিত করতে বাধ্য করা হয়েছে। গত ৭৫ বছর ধরে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে আঘাত হানা, বিনা কারণে আটক করা, জমি থেকে উৎখাত করা, তার ওপর পশ্চিমাদের কপটমূলক আচরণ এই সবকিছুই কি তাদের তরুণদের ইন্ধন জুগিয়ে মরিয়া করে তুলছিল না বেপরোয়া কোন পদক্ষেপ নিতে?শরণার্থী শিবির গুলিতেও বিমান হামলা, স্বাস্থ্য ভবন সহ বেসামরিক অবকাঠামো গুলি ধ্বংস করে দেওয়া, সংবাদ মাধ্যমের দরজায় আইনি নোটিশ ঝুলিয়ে দেওয়া এসবই যদি পশ্চিমাদের এবং ভারতীয় কিছু সংখ্যক ভক্ত কূলের চোখে তথাকথিত ‘আত্মরক্ষা’ হয়। তবে আয়াতুল্লা থেমেইনি মত ধর্মীয় নেতার চোখে ৭ই অক্টোবর ‘বৈধ’ বা ‘ন্যায্য’ হবে এবং প্যালেস্টাইনি দের কাছে হামাস কিংবা হিজবুল্লাহ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচিত হবে এটা সমালোচনা করার মতো কোনো বিষয় না। ৭ই অক্টোবর যে প্রারম্ভ নয় তা পশ্চিমা মিডিয়া বা গোদি মিডিয়া মানতে না চাইলে প্যালেস্টাইনিদের যেমন কিছু করার থাকতে পারে না। তেমন মুসলিম নেট নাগরিকদের ট্রেন্ডিং এর মুখ্য বিষয় যদি ‘ফ্রি গাজা’ বা ‘’স্টপ জিনোসাইড’ না হয়ে ‘কোল্ড প্লে কনসার্ট’ হয় এতে আমার বা আপনারও কিছু করার থাকতে পারে না। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের ওয়েস্ট মিনিস্টার মিউজিক কনসার্ট ট্যুরে মশগুল থাকা সুন্নি দেশ, সৌদি আরবের নির্দেশিত পথ ধরে যে বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম সমাজ এতদিন শিয়া সম্প্রদায়কে নিজেদের থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছিলেন আজ এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে শিয়া সম্প্রদায়ের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা প্রয়োজন নয় কি? নাকি গুরুত্ব নেই মধ্যপ্রাচ্যের সাধারণ নাগরিকদের সামরিক প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তাটা?সময় এসেছে মৌলবাদী গোঁয়ার্তুমি ছেড়ে নারী পুরুষ নির্বিশেষে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের বিশেষ করে প্যালেস্টাইনের নাগরিকদের প্রয়োজন বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ। এছাড়াও মুসলিম দেশগুলোর প্রয়োজন নিজেদের মধ্যকার শিয়া সুন্নি অন্ত কলহ বিবাদের নিষ্পত্তি ঘটিয়ে ঐক্যবদ্ধ হাওয়া। অন্যথায় অদূর ভবিষ্যতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি গুলির প্রকোপ তাদের নিজেদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলবে।
দীর্ঘকাল ধরে দুই মহা শক্তিধর দেশ এবং তাদের মিত্র জোট অত্যন্ত সুকৌশলের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য কে তাদের স্নায়ু যুদ্ধের ব্যাটেলফিল্ড হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এর ফলে সেখানকার বিরাট অংশের বেসামরিক নাগরিকদের জীবনহানি হওয়া বা বারবার তাদের ভবিষ্যৎকে যে অনিশ্চিতার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়েছে সে সম্পর্কে উনাদের কোন মাথাব্যথা আছে কি? দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক সংকট এবং তুমুল যুদ্ধ আতঙ্কের ফলে মধ্যপ্রাচ্যের বিরাট অংকের শিশুরা যে সাইকোলজিক্যাল ট্রোমার মধ্যে ভুগছেন তার দায় বা কে নেবেন? যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদ দমন নামক আগ্রাসন মূলক নীতির মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির উপর যে ভয়াবহ তান্ডব লীলা চালিয়েছিলেন সেটাকে রাষ্ট্রীয় দ্বারা পরিচালিত সন্ত্রাসবাদ বলা ভুল হবে না। তাদের সেই তথাকথিত ‘সন্ত্রাস বাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ছিল বিভ্রান্তিমূলক এবং ভয়ানক রকমের স্ববিরোধী। ৯/১১ হামলার পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র আল কায়দার মত সশস্ত্র সংগঠনগুলিকে জব্দ করতে আফগানিস্তানের উপর আগ্রাসনমূলক অভিযান শুরু করেন। অথচ এই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই তৎকালীন আফগানিস্তানের রুশ অনুগ্রহ ভজন সরকারকে চাপে ফেলতে এই সমস্ত সশস্ত্র সংগঠন গুলির হাতে অস্ত্র তুলে দেন। এই একই রকম পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি লক্ষ্য করা যায় সিরিয়া যুদ্ধের সময়। ইরাকের সশস্ত্র সংগঠন আইএসআইএস এর মসুল দখলের আগে ইউরোপীয় বিমানগুলি তাদের বাগদাদ অভিযান স্থগিত রাখে এই আশঙ্কায় যে, আইএস আইএস এর কাছে সেই আধুনিক বিমান বিধ্বংসী মিসাইল আছে যা রুশ বা ইরান মদত পুষ্ট সিরিয়ার শাসক বাশার আল আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে যুক্তরাষ্ট্র স্থানীয় সশস্ত্র সংগঠনগুলির হাতে তুলে দিয়েছিলেন। দুই দশক ধরে আফগানিস্তানের মাটিতে সামরিক ঘাঁটি গেরে আপন স্বার্থ চরিতার্থ করতে সেখানকার বেসামরিক নাগরিকদের গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ও নারী স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখাতেও যেমন ছাড়েনা। তেমনই নিজ স্বার্থ ফুরিয়ে গেলে তাদের হিংস্র তালিবানিদের মুখে ফেলে আপন জান বাঁচা নামক ‘কাতার শান্তি চুক্তি’র মাধ্যমে লেজ গুটিয়ে প্রত্যাবর্তন করতে ও পিছুপা হয় না। শুধুমাত্র সন্দেহের বসে ‘অপারেশন ইরাকি ফ্রিডম’ চালিয়ে বেসামরিক নাগরিকদের মাটির সঙ্গে গুঁড়িয়ে, শাসক কে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে সমগ্র দেশ কে দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়া বা সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে নিজেদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে তাকে আন্তর্জাতিক যুদ্ধের রুপ দেওয়া। এসবই যুক্তরাষ্ট্রের কৃতিত্ব। এত সব কিছুর পরেও তারা ক্ষুন্ন ভাবমূর্তি আর কফিন বন্দী সেনাদের মরদেহ ছাড়া আর কিছুই দেশে নিয়ে যেতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক সাদ্দাম হোসেনের ফাঁসি সমগ্র বিশ্বের মুসলিম জন সমাজে এক গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। সিরিয়া যুদ্ধ এবং প্যালেস্টাইনের গণহত্যা হলো সেই ক্ষতের উপর নুনের ছিটার সমতুল্য। যা ঘটছে এবং আগামীদিনে যা ঘটতে চলেছে তার দায় থেকে যুক্তরাষ্ট্র অব্যাহতি পেতে পারেনা। জাতিসংঘ গাজার গণহত্যা এবং লেবাননের ওয়াকিটকি বিস্ফোরনে মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করার অভিযোগ করলেও পশ্চিমা শক্তি গুলি সে অভিযোগ কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ইসরায়েলকে দিয়ে যাচ্ছেন পূর্ণ সমর্থন। এমনটা হবারই কথা কারণ মার্কিন কংগ্রেসের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলা ইসরায়িলি লবি সংগঠনগুলোকে উপেক্ষা করার আস্পর্ধা স্বয়ং হোয়াইট হাউসেরও নেই। আর এই লবী সংগঠন গুলির কাজই হল সর্বদা ইসরাইলের স্বার্থকে সুরক্ষিত করা। বর্তমানে এরা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রো- প্যালেস্টাইনিদের প্রোটেস্ট গুলিকে অ্যান্টি-সেমিটিজম বা অ্যান্টি-জিউস বলে দেগে দেওয়ার প্রচেষ্টায় ব্যস্ত। ডেমোক্রাটিক কিংবা রিপাবলিকান সব দলের নির্বাচনী এজেন্ডা হল ইসরাইল প্রীতি। লেবানন হামলায় হিজবুল্লার শীর্ষ নেতৃত্ব হাসান নুরুল্লাহ সহ আরো ছয় শীর্ষ কমান্ডারের নিহতের পরেও একের পর এক মুসলিম দেশের উপর একতরফা আক্রমণ শানিয়ে কি বার্তা দিতে চাইছেন? তবে কি তারা কোন ধর্মযুদ্ধকে উসকে দিতে চাইছেন ? যে রাষ্ট্র তার মিত্র দেশগুলির কার্যকলাপ এবং গতিবিধির ওপর নজরদারি চালাতে ছাড়েন না। সেই মোসাদ নামক বিশ্বের অন্যতম কার্যকর এবং ভয়ঙ্কর গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষে কি তাদের নিকটতম চিরশত্রু হামাসের গতিবিধির ওপর নজর রাখা খুবই কষ্টসাধ্য ছিল? আজ যে সব পশ্চিমা নাগরিকরা প্রো-প্যালেস্টাইনিদের আন্দোলন কে সন্ত্রাসবাদের সমর্থন হিসেব তীব্র ভাষায় আক্রমণ করছেন তারা কি তাদের কালো ইতিহাস খুলে দেখেননি? নাকি তাদের শাসকেরা অত্যন্ত সুকৌশলে সেই রক্তাক্ত অধ্যায় গুলিকে ইতিহাসের পাতা থেকে ছিড়ে ফেলেছেন? শুধুমাত্র ধর্মীয় বিদ্বেষ বশত কোন একটি সম্প্রদায়কে সমগ্র বিশ্বে কোণঠাসা করে রাখার প্রচেষ্টা নয় কি?নব্য সাম্রাজ্যবাদের এই সাম্প্রদায়িক রূপকে কি ‘সাম্প্রদায়িক সাম্রাজ্যবাদ’আখ্যা দেওয়া ভুল হবে? যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ঘোষিত নয়া বিশ্ব ব্যবস্থায় বিশ্বকে গণতন্ত্রের জন্য স্থিতিশীল করে যুদ্ধ মুক্ত বিশ্ব গড়ার যে ধারণা দেওয়া হয়, প্রকৃতপক্ষে তাদেরই দ্বিচারিতা এবং পক্ষপাতমূলক নীতি বিশ্বে স্থিতিশীলতার পরিবর্তে জন্ম দেয় দীর্ঘমেয়াদি বিশৃঙ্খলার। যেটা ভয়াবহ এক জীবন্ত আগ্নেয়গিরির সমতুল্য। যার জ্বলন্ত লাভা সমগ্র মধ্যপ্রাচকে ছাই ভস্মে পরিণত করবে এবং অদূর ভবিষ্যতে তা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নামক বিশ্বব্যাধি রুপে সমগ্র মানব সভ্যতাকে গ্রাস করবে।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct