পাপান ও লাল গিরিগিটি
গোপা সোম
পাপানদের বাগান খানা বেশ সুন্দর, যদিও, পাপানের দেশের বাড়ীর বাগানের কাছে, কিছুই নয়। বাগানটাতে, খুব বেশী না হলেও, এমন কিছু গাছ আছে, যেগুলো সারা বছর ফুল দেয়, একটা বড় আমগাছ আর একটা পেয়ারা গাছ রয়েছে। কিছুটা জায়গা নিয়ে একটা দোলনাও আছে, পাপানের আর ওর বোনের জন্যে। পাপানের মা ফুল খুব ভালোবাসেন বলে, বাড়ীর সামনে, মরশুমী ফুলের একটা ছোট বাগিচাও আছে, বেশ খানিক জায়গা নিয়ে। সেখানে থরে থরে বাহারী ফুল ফুটে থাকে, কত না রঙের ফুল। পাপানের মা নিজের হাতেই গাছ লাগান, জল দেন, সার দেন আর আগাছা পরিষ্কার করেন। তিনি নিজে হাতেই গাছের পরিচর্যা করতে ভালোবাসেন। নিজের হাতের কাজেই তিনি তৃপ্তি পান। পাপানের মায়ের বাগান করা একটা সখ। বাগানে বহু রঙ বেরঙের প্রজাপতি, মৌমাছি আসে, ফুলের মধু খেতে। পাপানের খুব ভালো লাগে। তিতলি ওই বাগানে ঘুরে বেড়ায়, ফড়িং আসে, ফড়িং ধরতে চায়, পাপান, বলে, ফড়িং ধরতে নেই, ফড়িং ধরলে হাতে ঘা হয়, তিতলি আর ফড়িং ধরার শখ করে না।পাপানদের বাগানের সামনে আবার একটা বড় ফাঁকা জমি অনেকদিন ধরেই পড়ে আছে, ওই জমিতেও তিনটে বিশাল বড় রাধাচূড়া গাছ হয়েছে। পাপান শুনেছে ওর মায়ের কাছে, ওর জন্মের আগে গাছগুলোর নাকি জন্ম। ওই খানে ছোট-বড় বহু গিরগিটি ঘুরে বেড়াত, এখনোও বহু গিরগিটির আস্তানা ওই জমিটাতে। পাপানের মনে আছে, পাপান ছোটবেলায় গিরগিটি খুব ভয় পেত। পাপান বড় হয়ে ওর মায়ের কাছ থেকে জেনেছে, পাপান ওর বাবার সাথে যখন বেড়াতে যেত, গিরগিটি দেখলেই, ওর বাবাকে বলত, কোয়ে, কোয়ে, কোয়ে…….., অর্থাৎ কোলে নিতে। ওর বাবার কোলে চড়েই নির্ভয়ে তখন নিজের মুখ, গলা, প্রসারিত জিভ ছুঁয়ে বলত, গিরগিটির মুখ লাল…, গলা লাল…, জিভ লাল……
জমিটাতে, রাধাচূড়া গাছগুলো নিভৃতে, নিজের মত করেই বেড়ে চলেছে, প্রকৃতির কোলে। কাউকেই ডাল ছেঁটেও দিতেও হয় না, কোনোরকম যত্ন ও করতে হয় না। গ্রীষ্মের সময়ে, গুচ্ছ গুচ্ছ হলুদ ফুলে এদের প্রায় সব শাখা প্রশাখা ছেয়ে যায়। গাছতলায় অসংখ্য হলদে পাঁপড়ি পড়ে থাকে, মনে হয়, কে যেন গাছের গোড়ায় হলদে রঙ দিয়ে, জমিটাকে রঞ্জিত করে দিয়েছে, প্রতি বৈশাখেই এমনটা হয়। একটু জোরে হাওয়া দিলে, গোছা গোছা ফুল নিয়ে, ডাল গুলো ভীষণ জোর জোর এলোমেলো ভাবে দুলতে থাকে, তখন খুব সুন্দর লাগে দেখতে। আর কালবৈশাখীর ঝড়ে তো বহু বড় বড় ডাল ভেঙে পড়ে যায়, পথের পরেও কখনো কখনোও এসে পড়ে, পথ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে, পাপানদের বাগানে, গাছের কত পাতা ফুল সব উড়ে এসে পড়ে। এত ডাল ভেঙে পড়া দেখে, পাপানের খুব কষ্ট হয়, কত কষ্টে তিলতিল করে গাছ তার শাখা প্রশাখা বিস্তার করে, কুঁড়ি, ফুল ধারণ করে, আর এক মুহূর্তে সব শ্রম ধূলিসাৎ হয়ে যায়। কিছু করার ও থাকে না। এই তো প্রকৃতির খেলা। গ্রীষ্ম চলে গেলে, যখন বর্ষা আসে, তখন গাছ গুলোতে পড়ে থাকে অগুনতি ফল । বর্ষার বারিধারায় গাছের ডাল পালা গুলো যেন খুব হেলে দুলে, মনের আনন্দে অবগাহন করে। ঋতুচক্রে শরত, হেমন্ত এলে আবার, গাছগুলোকে কেমন যেন ম্রিয়মাণ মনে হয়, ফুল ফল বিহীন গাছেরা যেন নীরস জীবন কাটায়, ডালে ডালে কোথাও দু-একটা ফল থাকলেও সংখ্যায় নিতান্তই কম। এরপর যখন নিদারুণ শীত আসে, গাছের বৃদ্ধি কমে আসে, শীতের রুক্ষ হাওয়ায়, গাছের পাতা ঝরতে থাকে, গাছ বিবর্ণ হয়ে পড়ে। কিন্তু, প্রকৃতিতে ঋতুরাজের আগমনের সাথে সাথেই, গাছের শাখায় শাখায় ফের নতুন কচি পাতা দেখা দেয়, ধীরে ধীরে গাছগুলো ঘন সবুজ পাতায় ঢেকে যায়। গাছে কুঁড়ি আসে, ফুল হয়, তখন, গাছগুলো যেন প্রাণ ফিরে পায়। প্রকৃতির এই লীলা খেলা, পাপান বেশ উপভোগ করে। এইরকমই কোনো এক বৈশাখ মাসের একদিন সকালে পাপান ঘুম থেকে উঠে দেখে, আকাশে কালো মেঘ, রোদ নেই। ক’দিন ধরেই খুব গরম পড়েছে, ৪২ ডিগ্রী তাপমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। খবরের কাগজে, টিভি, রেডিওতে একটাই সতর্কবার্তা, তাপ প্রবাহ চলবে বেশ কয় দিন ধরে, মানুষ জনদের সতর্ক করে দেওয়া হচ্ছে। মানুষ জন সবাই গরমে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন, সবার মুখে একটাই কথা, কবে বৃষ্টি হবে, কবে পৃথিবী ঠান্ডা হবে। পশু পাখিদেরও কষ্টের শেষ নেই, জলাভাবে, কত পশু,পাখি ঝিমিয়ে পড়ছে। যাই হোক, সেদিন সকালে চড়চড়ে রোদের পরিবর্তে, আকাশে কালো মেঘ দেখে, পাপানের বেশ ভালোই লাগছে। যদি বা বৃষ্টি আসে। পাপানের মনটা খুব উদাস লাগছে, পড়ার ঘরে গিয়ে পাপান, জানালার কাছে বসে পড়লো। অল্প অল্প হাওয়া দিচ্ছে। একটু অন্যরকম পরিবেশ।
এমন সময় পাপান লক্ষ্য করে, যে গাছগুলোর কথা এতক্ষণ ধরে বলছিলাম, তাদেরই মধ্যে কোনো এক গাছের গোড়ায় কয়েকটা পাখি খুব নাচানাচি করছে, পাপানের দৃষ্টি স্বাভাবিকভাবেই ওদিকে গিয়ে পড়ল। গাছটার গোড়া থেকে, কতগুলি কচি ডাল বেরিয়েছে, তাতে নতুন নতুন কচি সবুজ পাতা, বেশ ছোটোখাটো একটা ঝোপের আকার নিয়েছে। পাপান দেখে, একটা হাঁড়িচাচা পাখি মাটিতে বসে আছে, লাফিয়ে লাফিয়ে কি করছে, এরপর হাঁড়িচাচা হঠাৎ করে, ঝোপের ভেতর চলে গেল, আর দু একটা বুলবুল পাখি, ঐ ঝোপের কাছ দিয়ে বারবার ঘুরপাক খেয়ে যাচ্ছে আর ঘুরপাক খেয়ে উঁচু গাছের ডালে বসছে। আবার নামছে, ঘুরপাক খাচ্ছে, আবার উঁচু ডালে গিয়ে বসছে। পাপানের ব্যাপারটা খুব তাজ্জব লাগে। পাপান সব কাজ ফেলে রেখে, ওই দিকেই মন দিয়ে চুপটি করে বসে থাকে, প্রথমে ভাবে, পাখিরাও কি লুকোচুরি খেলে? এইরকম ভাবে বেশকিছুক্ষণ চলার পর, পাপান দেখে, মূর্তিমান হাঁড়িচাচা, ঝোপের থেকে বেরিয়ে এলো, আর কি একটা নিয়ে বেশ ব্যস্ত ! ঠোঁট দিয়ে দিয়ে কি একটা টানছে, পাপান ভাবে, সাপ, পাপানের খুব ভয় করে, পাপানের মন উতলা হয়ে ওঠে, ভাবে কাকে বলবে, পাখিটাকে সরিয়ে আনতে, সাপ যদি হাঁড়িচাচাকে কামড়ে দেয়, কি হবে, এই ভেবে। ভালো করে চোখ কচলে পাপান দেখে , না সাপ না, আসলে এত রাধাচূড়া ফুলের দল পড়ে আছে জমিতে, ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। তা হলে ওটা কি? একবার ভাবলো পাখির ছানা, পড়ে গেছে বা,মনটা কেমন উতলা হয়ে গেল পাপানের। পাপান ভাবতে থাকে, পাখির ছানা গাছ থেকে পড়ে গেছে হয়তোবা, কাকে বলবে ছানাটাকে উঠিয়ে দিতে, এসব ভাবছিল বসে পাপান। তারপর একটু সামনের দিকে যেই না হাঁড়িচাচা এসে পড়েছে, অমনি, পাপান বুঝতে পারে, ছানাও নয়, সাপ ও নয়, এ যে একটা গিরগিটি, লালচে রঙের গলা দেখে বুঝতে পারলো। হাঁড়িচাচা কয়েকবার ঠুকরে ঠুকরে, গিরগিটিটা কে মেরে ফেললো, বেশ কিছুক্ষণ ধরে, ওখানে বসে থেকে ঠুকরে ঠুকরে কি খেলো! পাখির পেট কতটুকুই বা, একটু পরেই, ঝাঁ করে কোথায় উড়ে চলে গেল।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct