পাপান
গোপা সোম
দোলের দিনে পাপান ঘরেই বসে থাকে, আজকাল আর পাপান আবির, রঙ নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় বেরোয় না। কয়েক বছর আগেও, পাপান দোলের দিনে কত আনন্দ করেছে! পাপানের সব বন্ধু, ছোটোবেলার, বড়বেলার, সবাই মিলে, দোলের দিন সকাল হলেই, বাড়ীর কাছের ক্লাবের এক ছোট্ট ঘরে এসে মিলিত হত। আর সবাই নিজেদের ইচ্ছে মত, নানা রঙের আবির, রঙ, পিচকিরি, বালতি আনতো, প্রত্যেকেই মুখোশ, পরচুলা, সব পরতো। বড় বালতি করে জল নিয়ে, রঙ মিশিয়ে, পিচকিরিতে ভরে রাখতো। আর সাইকেল নিয়ে ঘুরতো পাড়ায় পাড়ায়। খুব হৈ চৈ করে বেড়াতো। দোলের দিনে, রং তৈরীর সরঞ্জাম রাখবার জন্য ক্লাবের এই ছোট ঘর পাওয়ার পিছনেও একটা ঘটনা আছে। পাপানদের পাড়ার মোড়েই এই ক্লাব, অনেকদিন থেকেই আছে। এই ক্লাবের ছেলেদের পাড়ায় সবাই ভয় পেত। এই ছেলেগুলি পাড়ায় পাড়ায় চাঁদা নিয়ে যখন তখন জুলুমবাজি করতো, সবাইকে এদের ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকতে হত। মনের মত চাঁদা না পেলেই ক্লাবের ছেলেরা নানা ভাবে হয়রানি করতো সবাইকে। পাপানের বাবার থেকে ওই ক্লাব প্রচুর টাকা চাঁদা আদায় করতো, যখন, তখন। পাপানের বাবা নির্ঝঞ্ঝাট, শান্তিপ্রিয় মানুষ, ঝুট ঝামেলা থেকে দূরে থাকতে ভালোবাসেন, ক্লাবের ছেলেদের বলে দিয়েছিলেন, তোমরা এত এত টাকা চাঁদা চাও কেন? সবার কি সামর্থ্য আছে এত এত চাঁদা দেবার? জুলুমবাজি করবে না, আমি তোমাদের সাধ্য মত বেশী করেই দেই, তা বলে পাড়ার সবার কাছে এমনটি আশা করবে না। সবাই যে যেমন দেবেন, তাতেই তোমরা সন্তুষ্ট থাকবে। তবেই আমি তোমাদের কে আর্থিক অনুদান দেব, নতুবা নয়। পাড়ায় তাই ওরা আর বেশী ট্যাঁ ফুঁ করতে পারে না, চাঁদা নিয়ে। যিনি যেমন দেন, তাই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে। পাপান একদিন কথা বলতে বলতে ক্লাবের ছেলেদের বলেছিল, ওদের ক্লাবের ছোট ঘরটা পেলে, পাপানদের খুব সুবিধে হয়, রঙ, বালতি রাখতে। পাপানকে ওরা খুব ভালোবাসে, ওদের সেই ছোট্ট ঘর, কোনো কাজে তেমন লাগে না, দোলের দিনে পাপানদের ছেড়ে দেয়।
পাপান এখন পড়াশোনা নিয়ে খুব ব্যস্ত। এম বি বি এস করছে দিল্লীতে, ছুটিতে বাড়ী এসেছে। পাপানের বন্ধুরাও এখন ভালো ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছে। কেউ এঞ্জিনীয়ারীং, কেউ টেকনোলজি, কেউ আবার বি এইচ এম এস ওপড়ছে। গত সন্ধ্যায় পাপান আর ওর সব বন্ধু মিলে, যেখান সেখান থেকে শুকনো ডাল-পালা যোগাড় করেছে, বিশাল বড় ঘর বানিয়ে, তাতে আগুন দিয়ে, “নাড়া পোড়া” পালন করেছে। আকাশে বড় পূর্ণিমার চাঁদকে সাক্ষী রেখে। কিন্তু দোলের দিন পাপানকে রঙ মাখাতে আর কেউ এখন দেখতে পায় না। পাপানের বন্ধুরা অনেক জোর করেছে তাকে রঙ খেলার জন্য, পাপান কিন্তু অনড়, ওর প্রতিজ্ঞায়। বিগত তিন বছরের একটা ঘটনা পাপানকে খুব নাড়া দিয়েছিল, বলেই, পাপান দোলের দিনে, আর ঘর থেকে বেরোয় না ।এমনই দোলের দিনেই, পাপানরা সবাইকে রঙ দিচ্ছিল, এমন সময় রাস্তায় এক ভিখিরী যাচ্ছিল, পাপানের এক বন্ধু মজা করে দিল এক পিচকিরী রঙ তার গায়ে, অসহায় ভিখিরী টি আহাহা করে উঠলো। সে বলে উঠলো, বাবা, তোমরা আমাকে রঙ দিলে, আমার এই পুঁটুলিতে না দিলে পারতে, সকাল থেকে শুধু জল খেয়ে আছি বাবা, ঘরেও কোনো খাবার নেই, করে খাব যে। ক্ষুধার তাড়ণায়, বেরিয়েছিলাম, দুটি খাবার পেলে, খেয়ে নেব। অনেক বাড়ী গেলাম, কেউই কিচ্ছু দিতে পারে নি বাবা, আজ দোল, কেউ পূজো-পাঠ করছে, কেউ আবার রঙ খেলায় ব্যস্ত। একজনতো রেগে মেগে বলেই দিল, সরে দাঁড়াও, কি জ্বালা, দেখছো না, এখানে পূজো হচ্ছে, এখন কে তোমাকে খাবার দেবে, যাও, যাও, অন্যখানে দেখ। অনেক ঘুরে ঘুরে, এক বাড়ী থেকে একজন দুটি রুটি, তরকারী দিল। বাবা, ভাবছিলাম এখানে গাছের তলায় বসে খেয়ে নেব। কিন্তু, দেখি সে বোধ হয় আর ভালো নেই এখন, বলে পুঁটুলি খুলে দেখালো, রুটি, তরকারী, সব রঙের জলে ভিজে গেছে। তার চোখ দিয়ে দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে মাটিতে পড়লো। এই দেখে পাপান মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নিল, আর কোনোদিন সে রঙ খেলবে না। পাপানের মনে খুব কষ্ট হলো। সে ভিখিরীকে বললো, চলো আমার সাথে, বলে বাড়ীতে নিয়ে এসে, বসালো এক জায়গায়। পাপানের মা একটি থালায় করে গরম ভাত, আলু ভাজা, ডাল, তরকারী দিলেন, ওই ভিখিরীটিকে। প্রথমে আপত্তি করলেও, সবটুকু খাবার সে খেয়ে নিল। পাপানের মা আরোও নেওয়ার জন্য বললেও আর নিল না। পরম তৃপ্তি করে ভাত টুকু খেয়ে সে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। ঘর থেকে যাওয়ার আগে পাপানের মা কে আশীর্বাদ করে বললো, ঈশ্বর তোমাদের মঙ্গল করুন। আর পাপানকে বলে গেল, মানুষ হও বাবা, অনেক বড় হও। জীবনে একটা কথাই মনে রাখবে, ত্যাগেই আনন্দ, ভোগে নয়, নিজের আনন্দকে সবার মাঝে আনন্দ হিসেবেই ছড়িয়ে দাও, তোমার আনন্দ অন্যের দুঃখের কারণ হয় না যেন বাবা কক্ষণো। এই ঘটনা পাপানের মনে খুব দাগ কাটে, সেই থেকে পাপান আর রঙ খেলে না।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct