সেইতো এলে ফিরে
আহমদ রাজু
আলমারির গোপন ড্রয়ারের ভেতরে থাকা হলুদ খামের চিঠিটা যখন রুনার হাতে উঠে আসে তখনও তার মন ছিল ফুরফুরে। কিছুক্ষণ আগেই সে গোসল সেরে বিয়ের সাজে সেজেছিল। সেই টুকটুকে লাল বেনারশি শাড়ি, ব্লাউজ আর কপালে মেরুন কালারের বড় একটা টিপ। অবশ্য লাল রঙের টিপ বরাবরই পছন্দ রুনার। বিয়ের পর সব পছন্দ সপে দিয়েছে সজলের কাছে। সজল যে তাকে বোঝে না তা নয়; বোঝে- প্রচণ্ড বেশি বোঝে। আর বোঝে বলেইতো দু’জনের ভাললাগা একাকার হয়ে মিশে আছে নদীমাতৃক বাংলাদেশের মতো। এমনিতেই স্বাভাবিকভাবে সুন্দর বলতে যা বোঝায় রুনা তার থেকেও অনেক বেশি। কাঁচা হলুদ গায়ের রং, দীঘল কালো চুল তার কীর্তনখোলার মতো, চোখ দুটি একবিংশ শতাব্দীর বনলতাকে হারা মানাবে। আর তার চলার ছন্দে খুঁজে পাওয়া যায় কোন এক গাঁয়ের মেঠো পথের অস্তিত্ব। বারো বছরের ক্ষীপ্র গতির সংসার হলেও নতুনের আগমন ঘটেনি এখনও। এজন্যে কেউ কাউকে দোষারোপ করে না। দু’জন সমানতালে চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হলেও তেমন অগ্রগতি এখনও চোখে পড়েনি। যে যা বলেছে- যেখানে যেতে বলেছে সেখানে গিয়েছে। সজল ব্যক্তিগতভাবে তাবিজ-কবজে বিশ্বাস না করলেও এক্ষেত্রে সে সুবোধ বালকের মতো চলে গিয়েছে ফকির বাড়িতে। তাবিজ বেঁধেছে গলায়-হাতে। পানিপড়াও খেয়েছে নিয়ম করে; যদি কোন ফল হয়। হয়নি; কোন ফল হয়নি। বাড়িতে যে অদৃশ্য শূন্যতা, সে শূন্যতা রয়েই গেছে। অবশ্য শূন্যতা বোঝার উপায় নেই দু’জনের দাম্পত্যে- দু’জনের একাগ্রতায়। খামের উপরে প্রাপক- সজল আহমেদ লেখা দেখে আগ্রহ বাড়ে রুনার। তাছাড়া এই গোপন ড্রয়ারের কথা সে জানতো না। আজ আলমারি পরিষ্কার করতে যেয়ে ড্রায়ারের অস্তিত্ব অনুভব করে কৌতুহলবসতঃ সেটি খোলে। সেখানে আহামরি কিছু না থাকলেও কিছু কাগজের সাথে পরম মমতায় চিঠিটা রাখা ছিল।
সে চিঠিটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে থাকে। না খামের মুখ খোলা বা ছেঁড়া নেই। তবে হয়তো সজল সাবধানে খুলে চিঠিটা পড়ে আবারো আঠা দিয়ে মুখ আটকিয়ে রেখেছে; মনে মনে ভাবে রুনা। তার চোখ পড়ে খামের ডান পাশটা খোলা, আপাত দৃষ্টিতে যা দেখা যায় না। সে তড়িঘড়ি ভেতর থেকে কাগজটা বের করে এক নিমেষে পড়ে শেষ করে। ভালবাসার কথা লেখা এটা নিশ্চিত। তবে তা কাব্যিক ভাষায়। সজলের সাথে অন্য কারো সম্পর্ক আছে? যদি তার মনে এতকিছু থেকে থাকে তাহলে বলতে পারতো; আমি পথ ছেড়ে দিতাম। মুহূর্তে চোখ দুটি লাল হয়ে ওঠে। তবে কী এত বছর শূন্যের ওপর ভালবাসা নামক ইমারত নির্মাণ করে চলেছে! সজল একবার অন্তত তাকে কথাটা বলতে পারতো! একটা শূন্যতা এ সংসারে রয়েছে সত্য, তাইবলে তলে তলে এতকিছু! সে কেঁদে ওঠে। মুহূর্তে তার জীবনটা উলট পালট হয়ে যায়। কী উৎসাহ-উদ্দিপনা নিয়ে সেজেছিল! সজলের প্রিয় মোরগ পোলাও রান্না করে অপেক্ষায় ছিল তার! আজ যে তাদের বারো তম বিবাহ বার্ষিকী! একটু পরেই ফিরে আসার কথা সজলের। অন্যদিন দুপুরে বাড়ি খেতে না আসলেও আজ সে সকালে বের হবার সময় বলেই গিয়েছিল দুপুরে খেতে আসবে। রুনা মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়, এ সংসারে সে আর এক মুহূর্ত থাকবে না। মিছেমিছি কেন সজলের সুখের মাঝে অন্তরায় হবে? তার চেয়ে তাদের পথ থেকে সরে দাঁড়িয়ে সংসারটাকে ভরিয়ে দেবার জন্যে সহযোগিতা করা তার কর্তব্য। এমনিতে এত বছরে একটা সন্তানের মুখ দেখাতে সে ব্যর্থ হয়েছে। এখন আর জায়গা আকড়িয়ে কোন লাভ নেই। তার চেয়ে ভাল বাবার বাড়িতে চলে যাওয়া। ভাইয়েরা অন্তত তাকে তাড়িয়ে দেবে না এটুকু বিশ্বাস আছে। আর যদি একান্তই তাদের কাছে না থাকতে পারে তাহলে ছোটখাট একটা চাকুরী জোগাড় করা খুব একটা কঠিণ কিছু হবে না বলে মনে হয় তার। সে চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়। বিয়ের শাড়ি কাপড় খুলে খাটের ওপর রাখে। কপালের টিপ খুলে নিচে ফেলে দেয়। মনের মাঝের কষ্টটাকে সে যথাসম্ভব চেপে রেখে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে। সজলের আসার সময় ঘনিয়ে আসছে- বেশি আর দেরি নেই। হয়তো এক থেকে দেড় ঘন্টার মধ্যে সে ফিরে আসবে। তার আগে রুনাকে চলে যেতে হবে। খাবার টেবিলে খাবার সাজিয়ে পাশে একটা কাগজের চিরকুট রেখে সে এক কাপড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। ঘর থেকে বের হবার সময় তার হৃদয় থেকে কান্না জোয়ারের মতো উছলিয়ে উঠছিল; যা সে অনেক কষ্টে সামাল দিয়েছে। হাতে একটা ফুলের ডালি নিয়ে সজল বাড়ি আসে। কলিংবেল চাপ দেয় বার কয়েক। ভেতর থেকে কোন সাড়াশব্দ শুনতে পায় না। তবে কী রুনা বাইরে কোথায় গিয়েছে? সে না বলে কোথাও কোনদিন গিয়েছে অন্তত এই বারো বছরে এমনতো মনে হয়নি! নিজের মনের সাথে কথা বলে সজল। আর অপেক্ষা না করে নিজের ব্যাগে রাখা চাবি দিয়ে ঘরে ঢোকে। ঘরের ইলেকট্রিক বাতিগুলো তখনও জ্বলছিল। না এ ঘরে-ও ঘরে কোথাও নেই। খাটের ওপর যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিয়ের শাড়ি, ব্লাউজ আর তার পছন্দের মেরুন কালারের লাল টিপের পাতা। ডাইনিং টেবিলের ওপর খাবার ঢেকে রাখা। সেখানে থাকা সাদা কাগজের দিকে নজর যায় তার। কাগজটা হাতে তুলে নেয় সে। তাতে লেখা-
‘সজল,আমি চলে যাচ্ছি। আমাকে খোঁজার বৃথা চেষ্টা করো না। তোমরা সুখি হও। -রুনা’কথাগুলো স্রেফ এটুকুই। সজল বুঝতে পারে না সে হঠাৎ কেন এমন সিদ্ধান্ত নিল রুনা। কী এমন ঘটলো যে, যার জন্যে তাকে কঠিণ সিদ্ধান্ত নিতে হলো? গত বারো বছরে তার সাথে এমন কিছু হয়েছে বলে তার মনে পড়ে না। কোন অভিমানে সে ঘর ছাড়লো? আকাশ-পাতাল ভেবে কোন সন্তোষজনক বিষয় মাথায় আসে না সজলের। রুনা যদি বাবার বাড়ি যায় তাহলে সজলের পক্ষে সেখানে যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ সে শ্বশুর বাড়ির ঠিকানা জানে না। বিয়ের পরে একদিনও সেখানে যায়নি। শুধু বরিশাল বাড়ি, এটুকু শুধু জানে। মাঝে মধ্যে শ্বশুর বাড়ির লোকজন এখানে বেড়াতে আসতো ঠিকই তবে একদিনও তার বরিশালে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। আজ বুঝেছে, না যাওয়াটা মস্তবড় ভুল ছিল। গেলে অন্তত এই বিপদের সময়ে একটা গতি হতো নিশ্চয়। সে বুঝতে পারে না কী হচ্ছে আর কী হয়েছে। সে এখন কী করবে- কার কাছে যাবে? সজলের মনে খটকা লাগে। চিঠিতে রুনা লিখেছে- “তোমরা সুখে থেকো” এই তোমরা বলতে রুনা কাকে বোঝাতে চেয়েছে? তবে কী সে তাকে সন্দেহ করছে? নাকি অন্য কিছু! তবে আর যাই হোক, রুনা অন্তত সজলকে সন্দেহ করতে পারে না এ ব্যাপারে একশো ভাগ নিশ্চিত সজল। বারো বছরের সংসার- চার বছর কেটেছে কলেজে। মোট ষোল বছরের চেনা জানায় একদিনও তার সাথে মনোমালিন্য হয়নি। তবে আজ কিসের জন্যে....। তার মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। চোখের সামনে অস্পষ্ট হয়ে যায় সবকিছু। সে কোন রকম সোফার হাতল ধরে তার ওপর বসে নিজেকে সামলিয়ে নেয়। শীতের শুরু। কুয়াশা ভেজা ভোর। গাছের পাতারা ভিজে চুপষে আছে যেন। মটরশুটির ক্ষেতে নতুনের আগমন। গাছিরা খেজুর গাছ তৈরিতে ব্যস্ত। আর ক’দিন পরেই গাছ থেকে সংগ্রহ করবে নতুন রস। দূরে রাখাল সারিবদ্ধভাবে গরু নিয়ে মাঠের মাঝ দিয়ে কোথাও যেন যাচ্ছে। এমনি ক্ষণে রুনা মেঠো পথ বেয়ে গ্রামের দিকে রওনা দিয়েছে; যেখানে তার বাবা-মা, ভাইদের সংসার। অধিকাংশ রাস্তা ধূলিময় হলেও জায়গা বিশেষ দুবলা ঘাসে ভরে আছে। সেখানে জমে থাকা শিশির বিন্দু পা ভিজিয়ে দেয় রুনার। মন তার ভারাক্রান্ত হলেও মুখে তা প্রকাশ পায় না। সে হেঁটেই চলেছে। ঢাকা থেকে বরিশাল লঞ্চে। লঞ্চঘাট থেকে বাসে উজিরপুর বাজার। তারপর এই দীঘল পথে হাঁটা। সকালে রুনাকে দেখে বাড়ির সকলে অবাক! কোন চিঠিপত্র নেই। একদম স্বশরীরে উপস্থিত! মা এগিয়ে আসে উঠানে দাঁড়িয়ে থাকা রুনার দিকে। “রুনা; মা তুই...!” রুনাকে উদ্দেশ্য করে বলল তার মা। “কেন মা? আমাকে কী আশা করোনি?”“না তা নয়। অন্তত একটা চিঠিতো দিতে পারতিস?”“তা হয়তো পারতাম। আসলে আমি অপ্রস্তুতভাবে চলে এসেছি। ”“রুনা কোন সমস্যা?”কেঁদে ওঠে রুনা। “আমি আর ওখানে ফিরে যাবো না মা। ”রুনার মা ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে। “বলিস কি?”“আমি ঠিকই বলছি মা। আমি আর ফিরে যাবো না ওঘরে। ”“জামাই কী কিছু বলেছে?”রুনা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, “সে কী বলবে? যা করেছে তা বলার ওপর দিয়ে গেছে। ” “জামাই অন্যায় কিছু করতে পারে আমি তো ভাবতেই পারি না। ”“আমিও কি ভাবতে পেরেছি মা? সে আর একজনের সাথে...” কথা শেষ করতে পারে না রুনা। সে শব্দ করে কাঁদতে থাকে। তার বুক যেন ভেঙে খান খান হয়ে যায়।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct