প্রত্যেক বছরের মতো এইবারও আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঘিরে কিছু ভয়ঙ্কর দৃশ্য ফুটে উঠেছে, সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য গুলোর মধ্যে একটা “টিউশন ব্যবস্থা” (টিউশন ব্যবস্থার মধ্যে আজকের আবাসিক স্কুল, টাকার বিনিময়ে প্রাইভেট সংস্থার দ্বারা শিক্ষালাভ)। এই ব্যবস্থা সরকারী শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা এবং প্রাইভেট শিক্ষা ব্যবস্থাকে জনপ্রিয় করার অন্যতম কারণ। আজ এই ব্যবস্থা এমন ভয়ংকর রূপ নিয়েছে যেটার শিকার হয়েছে সমাজের আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা ছেলে মেয়েরা। লিখেছেন আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয় (ব্যাঙ্গালুরু)-এর অধ্যাপক আজাবুল বিশ্বাস।
ব্রহ্মত্তর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার দিন পনেরো পরেই প্রাইভেট টিউশন নিয়ে শুরু করেছিলাম জীবনের ফরমাল এডুকেশন, সাল ১৯৯৭। আমাদের সময় টিউশন ব্যবস্থা অনেক ফুলে ফেঁপে না উঠলেও ফরমাল শিক্ষা ব্যবস্থার একটা প্যারালাল সিস্টেম হয়ে দাঁড়াতে আরম্ভ করেছিল। সম্প্রতি ২০২৩ সালে প্রকাশিত অ্যানুয়াল স্ট্যাটাস অফ এডুকেশন রিপোর্ট (ASER) ২০২২ এ প্রত্যেক বছরের মতো এইবারও আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঘিরে কিছু ভয়ঙ্কর দৃশ্য ফুটে উঠেছে, সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য গুলোর মধ্যে একটা “টিউশন ব্যবস্থা” (টিউশন ব্যবস্থার মধ্যে আজকের আবাসিক স্কুল, টাকার বিনিময়ে প্রাইভেট সংস্থার দ্বারা শিক্ষালাভ)। এই ব্যবস্থা সরকারী শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা এবং প্রাইভেট শিক্ষা ব্যবস্থাকে জনপ্রিয় করার অন্যতম কারণ। আজ এই ব্যবস্থা এমন ভয়ংকর রূপ নিয়েছে যেটার শিকার হয়েছে সমাজের আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা ছেলে মেয়েরা। একটা শ্রেণীকক্ষে কেউ যদি টিউশন না পড়ে তাহলে তাকে নিয়ে খিল্লি ওড়ানো হয়। টিউশন ব্যবস্থা ছেলে-মেয়ের ডিপ্রেশনের একটা বাহক। স্কুল শুধুই একটা বিল্ডিং নয়, এটা একটা সমাজের প্রতিরূপ। স্কুল হলো ছাত্র ছাত্রীদের মানসিক, দৈহিক সমস্ত রকমের উন্নতির একটা পবিত্র জায়গা। সরকারী বিদ্যালয় ছেলে- মেয়েদের ভবিষ্যতের নাগরিক তৈরিতে তৎপর। আজ সেই ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে এই টিউশন ব্যবস্থা। আজকের সমাজে যারা ভবিষ্যতের সুষ্ঠু নাগরিক বানাতে তৎপর, তাদের একটা বড়ো অংশ এই টিউশন ব্যবস্থকে এগিয়ে নিয়ে যেতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন। এই টিউশন ব্যবস্থা বেড়ে উঠার পেছনে রয়েছে অনেক কারণ-প্রথমত, শ্রেণীকক্ষে শিক্ষক এবং পড়ুয়া অনুপাত মেনটেইন না করার ফলে পড়ুয়াদের প্রতি নজর রাখা সম্ভব হয় না। ফলস্বরূপ, ছাত্র ছাত্রী / অভিভাবক প্রাইভেট টিউশন নিতে বাধ্য হয়। দ্বিতীয়ত, প্রথম কারণকে হাতিয়ার বানিয়ে শিক্ষক শিক্ষিকারা পড়ুয়াদের মাথায় ঢুকিয়ে দিচ্ছেন যে, টিউশন ছাড়া লেখাপড়া সম্ভব নয়। তৃতীয়ত, বিদ্যালয়ের পরিবেশকে লেখাপড়ার পরিবেশ বানাতে সাহায্য করে গ্রন্থাগার বা স্কুল লাইব্রেরী। এক সময় রাজ্যের স্কুল গুলোতে একজন লাইব্রেরিয়ান থাকতেন, গ্রন্থাগারের সম্পদ গুলো ছাত্র ছাত্রীদের জন্য দেওয়া হলেও শিক্ষক শিক্ষিকা সেই সুবিধা সীমিত রাখতেন শুধুমাত্র তথাকথিত উচ্চ পরিবারের ছেলে মেয়েদের জন্যই। উদাহরণ হিসেবে - আমাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষিকা দের ছেলে মেয়েরাই এই সুবিধার আওতায় থাকতো। কিন্তু বর্তমানে এই স্কুল লাইব্রেরির অবস্থা শোচনীয়। রাজ্যে ৫০ শতাংশ স্কুলে লাইব্রেরী নেই বললেই চলে আর থাকলেও সেখানে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত লাইব্রেরিয়ান নেই। চতুর্থত, বর্তমান ত্রুটিপূর্ণ পরীক্ষা পদ্ধতি। আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতি নোট এবং মুখস্ত বিদ্যার উপর নির্ভর করে নেওয়া হয়। সেই কারণে, নোটস বা এক কোথায় গাইড নিয়ে কিভাবে বেশি মার্কস অর্জন করা যায় তাই “টিউশন”। ইত্যাদি।
সব জায়গায় এই চিত্রের কাহিনী আলাদা। কোথাও এর জন্য ছাত্র ছাত্রী দায়ী, আবার কোথাও অভিভাবক আবার কোথাও শিক্ষক শিক্ষিকা বা শিক্ষা ব্যবস্থা বা সরকার। দায়ী যেই হোক না কেনো এই প্রাইভেট “ব্যবসা” ধীরে ধীরে স্কুল শিক্ষার গুরুত্বকে গ্রাস করে ফেলেছে সেটা জেনে রাখা দরকার। আজ এই প্রাইভেট “ব্যবসা” স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থার সমান্তরাল ব্যবস্থা বানিয়ে স্কুল সময়ে নিজ ব্যবস্থা চালাতে সক্ষম। ভারতবর্ষের মতো সুবিশাল দেশের জন্য সরকারী শিক্ষা ব্যবস্থা ব্যতীত অন্য কোনো ব্যবস্থা সঠিক হতে পারেনা। একটা সুস্থ দেশ তৈরি হয় সুস্থ - শিক্ষিত নাগরিকের দ্বারা আর এই নাগরিক বানাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করার সামর্থ রেখে আমাদের সরকারী শিক্ষা ব্যবস্থা। আমাদের রাজ্যে নার্সারি লেভেল থেকে শুরু করে গ্র্যাজুয়েশন লেভেল পর্যন্ত টিউশনের এক আলাদা ডিমান্ড। টিউশন ব্যবস্থা কত খারাপ বা কত ভালো সেটা সবার না জানা নয়। সম্প্রতি যে রিপোর্টের কথা উল্লেখ করলাম সেই অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গ এবং তার পাশের রাজ্য ঝাড়খণ্ড, বিহার ও ওড়িশায় প্রায় ৬০-৬৫ শতাংশ ছাত্র ছাত্রী (ক্লাস ১ থেকে ৮) বাইরে থেকে প্রাইভেট টিউশন নিয়ে শিক্ষা লাভ করে। তারপরেও ৩২% অষ্টম শ্রেণীর পড়ুয়ারা দ্বিতীয় শ্রেণীর পাঠ্য পুস্তক পড়তে পারেনা। তারমানে যারা টিউশন পড়েনা তারাই কি লেখাপড়ায় এত কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে? তাহলে প্রশ্ন হলো, সরকারী বিদ্যালয় তাহলে কিসের জন্য? আর যদি সরকারী বিদ্যালয়ে লেখাপড়া সঠিক ভাবে চলছে তাহলে প্রতিদিন টিউশন ব্যবস্থা বৃদ্ধির দর ঊর্ধ্বমুখী কেনো? ভারতের অনেক বিশ্ব বিদ্যালয় বা কলেজ আছে যেখানে উন্নতমানের গ্রন্থাগারের ব্যবস্থা থাকার কারণে ছাত্র ছাত্রীরা নিজের নোটস বা রেফারেন্স বই খুব সহজেই পেয়ে যায়। বহু সংখ্যক বিশ্ব বিদ্যালয়ে টিউশন পড়ার কোনো কনসেপ্ট নেই, কিন্তু সেই সংখ্যাটা খুব কম। বিদ্যালয়ের সক্রিয় গ্রন্থাগার, পড়ুয়া - শিক্ষক অনুপাত মেনটেইন, স্বচ্ছ নিয়োগ ব্যবস্থা, লাইব্রেরিয়ান এবং শিক্ষকদের নিয়মিত স্কিল ডেভলপমেন্ট ট্রেনিং ইত্যাদি বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবেই।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct