এম মেহেদী সানি, কলকাতা, আপনজন: ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমি’র ‘অ্যাসোসিয়েট ফেলো’ হিসেবে নির্বাচিত হলেন বাঙালি বিজ্ঞানী ড. কুতুবউদ্দিন আলি মোল্লা। সম্প্রতি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমি’র তরফে ২১ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, যারা ২০২৫ সালের ‘অ্যাসোসিয়েট ফেলো’ হিসেবে নিযুক্ত হবেন। সেই তালিকার সর্বকনিষ্ঠ বিজ্ঞানী ‘জিনোম এডিটিং প্রযুক্তি’র উদ্ভাবনকারী বাঙালি কৃষি বিজ্ঞানী কুতুবউদ্দিন জায়গা করে নিয়েছেন। তিনি বর্তমানে ওড়িশার কটকে অবস্থিত ধান গবেষণা কেন্দ্রে বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত। গত বছরের শেষে কুতুবউদ্দিনের ‘জিনোম এডিটিং প্রযুক্তি’ উদ্ভাবন সাড়া ফেলেছিল কৃষি গবেষণার ক্ষেত্রে। আর এই সামগ্রিক সাফল্যের জন্য বিজ্ঞানীর মুকুটে যুক্ত হচ্ছে একের পর এক নতুন পালক।
গত ডিসেম্বর মাসে লখনউ-এ ন্যাশনাল বোটানিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটে ‘ফ্লোরা অ্যান্ড ফানা সায়েন্স ফাউন্ডেশনে’র পক্ষ থেকে মিলেছে ‘প্রফেসর সুশীল কুমার ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ড-২০২৪।’ এর আগেও কেন্দ্রীয় সরকারের ‘ইয়ং সায়েন্টিস্ট অ্যাওয়ার্ড ২০১৩-১৪’ সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন কুতুবউদ্দিন । এবার বছরে শুরুতেই ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমি’র ‘অ্যাসোসিয়েট ফেলো’দের তালিকায় জায়গা করে নিলেন। তালিকা অনুযায়ী, ‘ওড়িশার আইসিএআর-জাতীয় ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের শস্য উন্নয়ন বিভাগের সিনিয়র বিজ্ঞানী ড. কুতুবউদ্দিন আলী মোল্লা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জিনোম এডিটিং টুল, TnpB তৈরি করেছেন, যা Cas9/Cas12a এর এক-তৃতীয়াংশ। তিনি দু’টি জলবায়ু সহনশীল ধানের জাতও উদ্ভাবন করেছেন।’ কুতুবুদ্দিনের এই সাফল্যে সেন্ট্রাল রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অধিকর্তা ড. এম. জে. বেগ বলেন, “ড. কুতুব আমাদের দেশের অন্যতম উজ্জ্বল তরুণ মেধাবীদের একজন । তিনি ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বহু স্বীকৃতি অর্জন করেছেন। ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমি’র অ্যাসোসিয়েট ফেলো হিসেবে নির্বাচিত হওয়া তাঁর জাতীয় পর্যায়ে আরও একটি গৌরবজনক সংযোজন। তিনি যে স্বদেশি জিন সম্পাদনা প্রযুক্তি (genome editing technology) উন্নয়ন করছেন, তা ভারতের বিদেশি পেটেন্টপ্রাপ্ত প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীলতা অনেকাংশে কমিয়ে আনতে সক্ষম হবে।”
ধানের জমিতে কীটনাশক ব্যবহার রুখতে বিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে প্রজেক্ট উপস্থাপন করে নজর কেড়েছিল যে ছেলেটি আজ তিনি স্বনামধন্য কৃষি বিজ্ঞানী। জানা গিয়েছে, উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বসিরহাটের জয়গ্রামের ভূমিপুত্র ড. কুতুবউদ্দিন আলি মোল্লার এই উত্তরণে কার্যত খুশির হাওয়া বইছে গোটা বাংলার শিক্ষা মহলে।
ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমি’র ‘অ্যাসোসিয়েট ফেলো’ হিসেবে নির্বাচিত হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করে কুতুবউদ্দিন বলেন, “ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমি’র অ্যাসোসিয়েট ফেলো নির্বাচিত হওয়ায় আমি আনন্দিত এবং কৃতজ্ঞ। আমি একটি সাধারণ গ্রাম থেকে উঠে এসেছি, আর আজ ভারতীয় জাতীয় বিজ্ঞান অ্যাকাডেমি থেকে এই জাতীয় পর্যায়ের স্বীকৃতি পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করছি । এই সম্মান আমাকে ভবিষ্যতে আরও দায়িত্বশীলভাবে বিজ্ঞানচর্চা চালিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দেবে । এই সম্মান আমাকে আরও বেশি দায়িত্ববান করে তুলবে, মানুষের জীবন ও দেশের উন্নয়নের জন্য বিজ্ঞানচর্চায় আরও নিবেদিত হওয়ার অনুপ্রেরণা জোগাবে ।” এই সাফল্যের পর কুতুবউদ্দিন তাঁর সকল সহকর্মী, বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।
বিজ্ঞানী কুতুবুদ্দিনের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, তাঁর হার না মানা জীবনের সাফল্যের কাহিনীটা একেবারেই সহজ ছিল না। প্রত্যন্ত গ্রামের প্রান্তিক পরিবারে জন্ম কুতুবুদ্দিন ছিলেন বাড়ির বড় ছেলে। পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে কুতুবুদ্দিন বড় হওয়ায় দায়িত্ব একেবারে কম ছিল না । পিতা ইলিয়াস মোল্লা গ্রামীণ চিকিৎসক এবং মাতা সুফিয়া বেগম গৃহকর্ত্রী। স্থানীয় বিদ্যালয় থেকেই উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন কুতুবুদ্দিন মোল্লা, স্নাতকে বোটানি অনার্স নিয়ে পড়ার জন্য পাড়ি দেন কলকাতায়। পরে বোটানি নিয়ে স্নাতকোত্তর এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পিএইচডি সম্পন্ন করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছাত্র ছিলেন কুতুবুদ্দিন। স্নাতক স্নাতকোত্তরে মেধাতালিকায়ও জায়গা করে নেন তিনি। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ২০১৪ সালে জুনিয়ার বিজ্ঞানী হিসেবে যোগ দেন দিল্লির ‘ন্যাশনাল ব্যুরো অফ প্ল্যান্ট জেনেটিক রিসোর্স’-এ। ২০১৫ সালে কটকের ধান গবেষণা কেন্দ্রে সিনিয়র বিজ্ঞানী হিসেবে যোগদান করেন। কর্মরত অবস্থায় ২০১৭ সালে ফেলোশিপ নিয়ে গবেষণার জন্য পাড়ি দেন ইউনাইটেড স্টেটে। ফিরে এসে আবার যোগদান করেন কটকের ধান গবেষণা কেন্দ্রে। কুতুবুদ্দিনের বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন ছিল ছোট থেকেই ৷ বাবার কৃষি জমিতে ধান চাষের সময় কীটনাশকের ব্যবহার করতে দেখতেন কুতুবুদ্দিন। তবে এবার জিনোম এডিটিং প্রযুক্তির উদ্ভাবন অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে বিজ্ঞানী কুতুবুদ্দিনকে। এবার সেই সাফল্যই ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমির অ্যাসোসিয়েট ফেলো’ হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার জন্য সহায়ক হলেন।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct