নায়ীমুল হক, কলকাতা, আপনজন: চলে গেলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ছাত্রদরদী শিক্ষক মিহির সেনগুপ্ত। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। বুধবার দমদম নাগেরবাজার-এর কাছে একটি নার্সিংহোমে বিকেল তিনটে পাঁচ মিনিটে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। সপ্তাহখানেক ধরে বেশ অসুস্থ ছিলেন তিনি। নার্সিংহোমে ভর্তি হন। কিছুটা সুস্থ হয়ে বাড়িও ফিরে আসেন। তারপর আবার গুরুতর অসুস্থ হলে, আবার ভর্তি হতে হয় তাঁকে। তবে এবার আর ফিরিয়ে আনা গেল না, চিরতরে চলে গেলেন তিনি সকলকে কাঁদিয়ে। এমনটি নয় যে, তিনি রেখে গেলেন কেবলমাত্র তাঁর স্ত্রী এবং মেয়েকে, বরং অসংখ্য সন্তানসম গুণগ্রাহী রেখে গেলেন তাঁর অপূর্ণ ইচ্ছা বাস্তব করার আর্জি পেশ করে। মিহিরদা বলেই ডাকতেন তাঁর গুনগ্রাহীরা। তাঁর জন্ম ওপার বাংলার অবিভক্ত বরিশাল জেলার মাহিলাড়া গ্রামের সেনগুপ্ত পরিবারে। বাবা ছিলেন বরিশাল তথা বাংলার প্রখ্যাত দেশনায়ক অশ্বিনী দত্তর ভাবশিষ্য। পিতৃদেবের প্রেরণায় কিশোর বেলা থেকেই সমাজসেবার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন তিনি। পারিবারিক আবহেই শিক্ষার প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ তৈরি হয়েছিল। সেই সূত্রেই ১৯৬৫ সালে দমদমের কিশোরভারতী বিদ্যালয়ের স্থাপনা। তারপর পুরুলিয়ার বাগমুন্ডিতে দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে তৈরি করেন কিশোর ভারতীর অপর শাখা, উত্তর ২৪ পরগনার ভাঙ্গড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চল কাশিপুরেও কিশোর ভারতীর সৌজন্যে এলাকার বহু ছাত্র-ছাত্রী দেখে শিক্ষার আলো। শুধু তাই নয় রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে তিনি ছুটে বেড়াতেন নীতি ও জ্ঞানের শিক্ষা কি করে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। যেখান থেকেই ডাক পেতেন দলবল নিয়ে ছুটে চলে যেতেন সেখানে। তাঁর থেকে বছরখানেকের বড় সমরদা (সমর বাগচী) ছিলেন তাঁর প্রাণের-সঙ্গীদের অন্যতম একজন। যেন ‘মানিকজোড়ের’ জুড়ি ভেঙে গেল, বলছিলেন তাঁর এক প্রাক্তন ছাত্র। শারীরিক অবস্থার পরোয়া করতেন না এঁরা কখনও। দেখতেন না কখনো রং, জাত, ধর্ম, বর্ণ, এসব কিছু। শুধু দেখতেন শিক্ষা-প্রসারে তাদের প্রকৃত ইচ্ছা কতখানি। শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই চালিয়ে যাওয়া যাকে বলে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ছিলেন সকলের হেড মাস্টারমশাই। এই নামেই তাঁকে ডাকত ছাত্রছাত্রীরা, সহকর্মীরাও।
তাঁর যোগ্য ছাত্র তথা দমদম কিশোর ভারতী হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সোমনাথ মুখোপাধ্যায় ধরার গলায় ‘গুরুদেবকে’ স্মরণ করলেন এইভাবে। “সে ছিল এক আশ্চর্য স্বপ্নের সময়, সে ছিল এক নিরলস নির্মিতির কাল। এক জাদুকরের মায়াখেলার আমরা ছিলাম ছয়ছোট্ট কুশীলব। চেনা পথ ছেড়ে এক অজানা, অচেনা পথের পথিক হবার ডাক দিয়েছিলেন তিনি। শঙ্কা ছিল, সময়ের উল্টো স্রোতে আমরা নাও বাইতে পারবো ? বুক চিতিয়ে আমাদের আগলে ছিলেন তিনি ও তাঁর অনুগামী সহচরেরা। তাঁর অনি:শেষ আশাবাদী মনকে সম্বল করে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন এক স্বতন্ত্র শিক্ষা যাপন পথ। প্রাথমিক ওঠাপড়ায় ভেঙে না পড়ে অদম্য মানসিক প্রেষণার জোরে প্রতিষ্ঠা করেছেন অনন্য এক নির্মাণশালা যা মুখে বইগোজা পড়ুয়া নয় সত্যিকারের মানুষ গড়ার কথা বলে। সকলের মাঝে থেকেও যে প্রতিষ্ঠান সকলের থেকে আলাদা। এই নিয়ে কিশোর ভারতীয়দের অস্মিতা,বড়াই। সেই আশ্চর্য মানুষটি আজ তাঁর মরজগতের জাদুখেলা শেষ করে দূরে অনেক দূরে পাড়ি দিলেন। আমরা কি তাঁকে হারালাম? তিনি কি চিরকালের মতো অলক্ষে চলে গেলেন? না, মোটেই না। তিনি ছিলেন, আছেন, থাকবেন আমাদের সকলের মনের মণিকোঠায় এক শাশ্বত স্বপ্নের মতো অন্তর্লীন অবয়বে। কোথায় যাবেন আপনি হেডমাস্টার মশাই? আপনি যে এক অলৌকিক শৌভনিক -হ্যামলিনের সেই আশ্চর্য বাঁশিওয়ালা। আমার আপনার পিছু ছাড়িনি। ভালো থাকবেন। আরও একটা নতুন পাঠশালা নির্মাণের ডাক এসেছে বুঝি?”
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct