শিক্ষা সমাজের অন্যতম প্রধান শক্তি, যা উন্নয়নের ভিত্তি রচনা করে। শিক্ষা যে কোনো সমাজের সার্বিক উন্নয়নের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বিশেষত মুসলিমদের মধ্যে শিক্ষার হার শিক্ষার সুযোগের প্রসার বিগত কয়েক দশকে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেলেও এখনো অনেক বড় চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। সরকারি নীতি ও প্রকল্পের ঘোষণা যতই করা হোক, বাস্তবিক পরিস্থিতি এখনো কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছায়নি। লিখেছেন ড. নাজমুল হুসাইন।
শিক্ষা সমাজের অন্যতম প্রধান শক্তি, যা উন্নয়নের ভিত্তি রচনা করে। শিক্ষা যে কোনো সমাজের সার্বিক উন্নয়নের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বিশেষত মুসলিমদের মধ্যে শিক্ষার হার শিক্ষার সুযোগের প্রসার বিগত কয়েক দশকে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেলেও এখনো অনেক বড় চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। সরকারি নীতি ও প্রকল্পের ঘোষণা যতই করা হোক, বাস্তবিক পরিস্থিতি এখনো কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছায়নি। শিক্ষার প্রসারে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এলেও, বিশেষ করে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে, গুরুতর অসমতা রয়ে গেছে। এখনো শিক্ষার পরিকাঠামো, সুযোগ এবং মান নিয়ে বহু সমস্যা রয়ে গেছে। সরকারি নীতির পাশাপাশি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবদানও আজকের শিক্ষার মান নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত, আল-আমীন মিশনের মতো সংস্থা সংখ্যালঘু ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে চলেছে। তবুও সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীদের জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা এখনো বড় চ্যালেঞ্জ।
সংখ্যালঘু অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিতে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে ব্যাপক বৈষম্য চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার মত। যদিও সর্বশিক্ষা অভিযানের মাধ্যমে শিক্ষার সম্প্রসারণ ঘটানোর চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু বিদ্যালয়ের সংখ্যা এবং শিক্ষার মানের মধ্যে এক বিস্তর ফারাক রয়ে গেছে। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে সরকারি স্কুলের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। পশ্চিমবঙ্গের গড়ে প্রতি ১১৮০ জন ছাত্রছাত্রীর জন্য একটি প্রাথমিক স্কুল রয়েছে, কিন্তু সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে এই সংখ্যা ২১৮৩ জন, অর্থাৎ, একটি বিদ্যালয়ের উপর চাপ দ্বিগুণ। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত ব্লকগুলিতে প্রতিটি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১৪,৬৮৫ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে, যা রাজ্যের গড় ১০,৭১০ জনের তুলনায় অনেক বেশি। উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি অন্যরূপ নয়, সংখ্যালঘু অধ্যুষিত জেলাগুলিতে উচ্চশিক্ষার সুযোগ খুবই সীমিত। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনেক কম, ফলে শিক্ষার সুযোগ সীমিত থাকে। শহরের তুলনায় গ্রামের সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে শিক্ষার এই বৈষম্য আরও প্রকট।
এছাড়াও, পর্যাপ্ত ও যোগ্য শিক্ষকের সমস্যা তো রয়েছেই, যা শিক্ষার মানের ওপর প্রভাব ফেলছে। সরকারি স্কুলে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই, বেসরকারি স্কুলে যারা আছেন তাদের অনেকের প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। সরকারি বেসরকারি স্কুলের সম্যসার ধরণ আলাদা হলেও, শিক্ষকের অভাবের কারণে বাচ্চাদের শিক্ষা নিশ্চিত করা কঠিন পরিস্থিতিতে। প্রাইমারি স্কুলের তুলনায় উচ্চশিক্ষার পর্যায়ে পরিস্থিতি আরও গভীর সংকটে।সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার মান ও সুযোগ-সুবিধা কমে যাওয়ায় অনেক অভিভাবক বেসরকারি স্কুলের দিকে ঝুঁকছেন। সরকারি স্কুলে পর্যাপ্ত শিক্ষক, আধুনিক পাঠ্যক্রম, অবকাঠামো ও শিক্ষার মান বজায় রাখতে না পারার কারণে ছাত্রছাত্রীরা ভালো শিক্ষার সন্ধানে বেসরকারি স্কুলে ভর্তি হচ্ছে। ফলে প্রাইভেট স্কুলের সংখ্যা ও ব্যবসা বাড়ছে, আর শিক্ষা লাভের বদলে ব্যবসায় পরিণত হচ্ছে। সংখ্যালঘু শিক্ষার ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মাদ্রাসা শিক্ষা। একসময় শুধুমাত্র ধর্মীয় শিক্ষার জন্য মাদ্রাসাগুলিকে দেখা হতো, কিন্তু বর্তমানে অনেক মাদ্রাসাই সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। সাধারণ স্কুলের তুলনায় মাদ্রাসার পরিকাঠামো কম হওয়ায় শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়ছে। মাদ্রাসাগুলিকে সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে আরও যুক্ত করা দরকার, যাতে ছাত্ররা বিজ্ঞান, গণিত ও প্রযুক্তির সমান সুযোগ পায়। কিন্তু এখনো অনেক মাদ্রাসা আধুনিক পড়াশোনা থেকে দূরে থাকায় ছাত্ররা ভবিষ্যতে চাকরির প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে।
সংখ্যালঘু শিক্ষার উন্নয়নে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প থাকলেও তার বাস্তবায়নে জটিলতা রয়েছে বা ঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয় না। সংখ্যালঘু শিক্ষার জন্য বরাদ্দ তহবিল অনেক সময় সঠিকভাবে কাজে লাগানো হয় না, ফলে প্রকৃতভাবে সংখ্যালঘুরা সেই সুবিধা থেকে বঞ্চিত। সংখ্যালঘু শিক্ষার প্রকল্পগুলোর ধীরগতির বাস্তবায়ন সংখ্যালঘু শিক্ষার অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজে দীর্ঘসূত্রিতা এবং শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে অনিয়ম।
তবে এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যেও কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। বর্তমানে ইংলিশ মিডিয়াম মডেল মাদ্রাসা চালু হয়েছে, যা সংখ্যালঘু অভিভাবক ও ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার প্রতি উৎসাহ বাড়াচ্ছে। এই মাদ্রাসাগুলো আধুনিক শিক্ষা ও ধর্মীয় শিক্ষার সমন্বয় করছে, যেখানে বিজ্ঞান, গণিত, প্রযুক্তি ও ভাষা শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীরা শুধু ধর্মীয় জ্ঞান নয়, ভবিষ্যতে চাকরির বাজারেও প্রতিযোগিতা করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারছে। এই ধরনের উদ্যোগ সংখ্যালঘু শিক্ষার উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তবে এই সমস্ত চ্যালেঞ্জের মধ্যে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তনও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বর্তমানে ইংলিশ মিডিয়াম মডেল মাদ্রাসা চালু হয়েছে, যা সংখ্যালঘু অভিভাবক ও ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনায় উৎসাহিত করছে। পরিকাঠামো গত ভাবে ঠেলে হলেও অনেক ইংলিশ মিডিয়াম মডেল মাদ্রাসায় পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষক নেই.। সরকারি প্রকল্প যেমন সর্বশিক্ষা অভিযান (SSA), মাদ্রাসা আধুনিকীকরণ প্রকল্প, কন্যাশ্রী, এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু বৃত্তি প্রকল্পগুলো কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে।
সরকারি স্কুলের পাশাপাশি বেসরকারি স্কুলের প্রসার পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করেছে। বিশেষ করে শহর ও কিছু গ্রামীণ এলাকায় অনেক বেসরকারি স্কুল গড়ে উঠেছে, যা সরকারি স্কুলের তুলনায় ভাল মানের শিক্ষা দিচ্ছে। এসব স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের শুধু সাধারণ পড়াশোনা নয়, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্যও প্রস্তুত করছে। বেসরকারি স্কুলগুলো ইংরেজি শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে, ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের সংখ্যা বাড়ছে। পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু শিক্ষার উন্নয়নে আল-আমীন মিশন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এটি একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে সাথে সংখ্যালঘু ছাত্রছাত্রীদের জন্য অনুপ্রেরণার কেন্দ্র। আল-আমীন মিশন মূলত দরিদ্র সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে কাজ করে। অনেক মেধাবী সংখ্যালঘু বাচ্চাদের সঠিক দিকনির্দেশনা ও সুযোগ করে দিয়েছে আল-আমীন মিশন। যেখানে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত করা হয়। NEET এ ভালো ফল করে অনেকেই ডাক্তার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। আল-আমীন মিশনের এই সাফল্য প্রমাণ করে যে পরিকল্পিত শিক্ষা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে সংখ্যালঘু ছাত্রছাত্রীরাও উচ্চশিক্ষায় সফল হতে পারে। আল-আমীন মিশনের মত উদ্যোগ আরও বাড়লে সংখ্যালঘু শিক্ষার উন্নতি আরো বারবে।
এখানে এই কথা বলা খুবই প্রজন যে বেসরকারি স্কুলগুলোর বড় সমস্যা হল প্রচুর পয়সার প্রয়োজন। অনেক সংখ্যালঘু পরিবার আর্থিকভাবে দুর্বল হওয়ায় তাদের পক্ষে ভালো মানের শিক্ষা পাওয়া কঠিন ও প্রতিভাবান অনেক বাচ্চা শুধুমাত্র টাকার অভাবে উন্নত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই সমস্যার সমাধানে সরকার যদি বেসরকারি স্কুলগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে তবে অনেক ভালো শিক্ষার সুযোগ পাবে। এতে তারা ভবিষ্যতে আরও ভালো ক্যারিয়ার গড়তে পারবে এবং সামগ্রিকভাবে সংখ্যালঘু শিক্ষার উন্নতি হবে। আল-আমীন মিশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর সংখ্যা বাড়ানো দরকার, যাতে সংখ্যালঘু ছাত্রছাত্রীরা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে আরও ভালোভাবে প্রস্তুতি নিতে পারে।
সংখ্যালঘু শিক্ষার উন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা খুবই জরুরি। প্রথমত, সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের সংখ্যা বৃদ্ধি করা উচিত। শিক্ষকদের নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনতে হবে। দ্বিতীয়ত, মাদ্রাসাগুলিকে আধুনিক শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত করে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষার সুযোগ বাড়াতে হবে, শিক্ষকের প্রশিক্ষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ করে মাদ্রাসার শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। তৃতীয়ত, বিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষার প্রসার ঘটানোর জন্য আরও সচেতনতামূলক কর্মসূচি চালু করা দরকার। সর্বোপরি, শিক্ষার মানোন্নয়ন ও বৈষম্য দূর করার জন্য সরকারকে আরও বেশি সক্রিয় হতে হবে। শুধুমাত্র প্রকল্প ঘোষণা করলেই সমস্যার সমাধান হবে না, বরং প্রকল্পগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। সংখ্যালঘু বাচ্চাদের জন্য বিশেষ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা সঠিক দিকনির্দেশনা পায় এবং ভবিষ্যতে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।
একটি শিক্ষিত সমাজই পারে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে নিশ্চিত করতে। পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘুদের জন্য শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করতে হলে সরকারের পাশাপাশি সমাজের প্রতিটি স্তরের সক্রিয় অংশগ্রহণ একান্তু দরকার। শিক্ষার আলো যদি সত্যিই সমাজের প্রতিটি স্তরে পৌঁছায়, তবেই একটি সমৃদ্ধ ও প্রগতিশীল পশ্চিমবঙ্গ এর সাথে সাথে উন্নতশীল দেশ গড়ে তোলা সম্ভব। পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু শিক্ষার উন্নয়নে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয় খুবই জরুরি। শুধু সরকারি বিদ্যালয়ের উপর নির্ভর করলে সমস্যার সমাধান হবে না, পাশাপাশি বেসরকারি শিক্ষার সুযোগ বাড়ানো ও সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ সুযোগ তৈরি করাও প্রয়োজন রয়েছে। আল-আমীন মিশনের মতো উদ্যোগ দেখিয়ে দিয়েছে যে সঠিক পরিকল্পনা ও সহযোগিতায় সংখ্যালঘু ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষাক্ষেত্রে বড় সাফল্য অর্জন করতে পারে। এই উদ্যোগকে আরো প্রসারিত করা একান্ত প্রয়োজন, পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু সমাজ শিক্ষার মাধ্যমে আরও উন্নত ও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারবে। শিক্ষা যদি প্রকৃত অর্থে সমাজের প্রতিটি স্তরে পৌঁছায়, তবে সংখ্যালঘু সমাজের উন্নত ভবিষ্যতের স্বপ্ন সত্যি করা সম্ভব হবে।
* লেখক: প্রিন্সিপাল, দ্য স্কলার স্কুল
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct