আপনজন ডেস্ক: একদা পেশীবহুল ও শক্তিশালী ফিলিস্তিনি বডিবিল্ডার মোয়াজাজ ওবাইয়াত ৯ মাস ইসরায়েলি ‘হেফাজতে’ থাকার পর জুলাইয়ে মুক্তি পেয়েছিলেন। মুক্তির পর তিনি বিনা সহায়তায় হাঁটতে পারছিলেন না। এরপর অক্টোবরে ভোরে তার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাকে আবার আটক করা হয়।
অধিকৃত পশ্চিম তীরের একটি সরকারি হাসপাতাল থেকে রয়টার্সের দেখা মেডিকেল নোট অনুসারে, পুনরায় গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বেথলেহেম সাইকিয়াট্রিক হাসপাতালে পাঁচ সন্তানের জনক ৩৭ বছর বয়সী ওবাইয়াতের গুরুতর মানসিক সমস্যা ধরা পড়ে।
রিপোর্ট অনুযায়ী, তিনি পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারে (পিটিএসডি) ভুগছেন। তার সমস্যাটি ইসরায়েলি প্রত্যন্ত কেটজিয়ট কারাগারে থাকা সময়কালের সঙ্গে সম্পর্কিত।
চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট নোটগুলোতে বলা হয়েছে, ওবাইয়াত কারাগারে শারীরিক ও মানসিক সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
গাজা যুদ্ধ বন্ধে এবং হামাসের হাতে বন্দি ইসরায়েলি জিম্মিদের বিনিময়ে যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করার জন্য আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা জোরদারের মধ্যেই ইসরায়েলি কারাগার এবং বন্দি শিবিরে ফিলিস্তিনিদের নির্যাতন ও মানসিক ক্ষতির বিষয়গুলো নতুনভাবে সামনে আসছে।
পশ্চিম তীরের সরকারি সংস্থা প্যালেস্টাইন কমিশন ফর ডিটেনটিস অ্যান্ড এক্স-ডিটেনটিস অ্যাফেয়ার্সের প্রধান কাদৌরা ফারেস বলেন, ভবিষ্যতে কোনো চুক্তি করে বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হলে অনেকের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন থেকে সেরে উঠতে দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা সেবার প্রয়োজন হবে। তিনি ওবাইয়াতের বিষয়টি সম্পর্কে অবগত বলেও জানান।
গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরায়েলের হাতে আটক ৪ ফিলিস্তিনির সঙ্গে কথা বলেছে রয়টার্স।
তাদের সবাইকে কয়েক মাস ধরে আটকে রাখা হয়েছিল। একটি অবৈধ সংগঠনের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। তবে কোনো অপরাধের জন্য অভিযুক্ত না করে বা দোষ না পেয়েই মুক্তি দেওয়া হয়।
বন্দিরা যেমনটি বলেছেন, সকলে মারধর, ঘুম বঞ্চনা, খাদ্য বঞ্চনা। ভেতরে মানসিক চাপে থাকাকালীন দীর্ঘা সময় খাদ্য না দেওয়ার মতো নির্যাতনের জন্য দীর্ঘস্থায়ী মানসিক ক্ষত বহন করছেন অনেকে। রয়টার্স ইসরায়েলের কারাগার বা বন্দিশালায় গিয়ে এগুলো স্বাধীনভাবে যাচাই করার সুযোগ পায়নি।
ফিলিস্তিনি বন্দিদের ওপর গুরুতর নির্যাতনের প্রতিবেদন করা মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোর একাধিক তদন্তের সঙ্গে ফিরে আসা বন্দিরা যেসব বিবরণ দিচ্ছেন, এগুলোর মিল রয়েছে।
গত আগস্টে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় প্রকাশিত একটি তদন্তে ইসরায়েলি কারাগারগুলোতে ব্যাপক নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ ও নৃশংস অমানবিক অবস্থার প্রমাণিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল।
হোয়াইট হাউসও ইসরায়েলের কারাগারে নির্যাতন, ধর্ষণ ও নৃশংসতার খবরকে ‘গভীরভাবে উদ্বেগজনক’ বলে অভিহিত করে।
রয়টার্সের প্রশ্নের জবাবে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বলেছে, তারা গাজার বন্দিদের ওপর সামরিক বাহিনীর সদস্যদের নির্যাতনের বেশ কয়েকটি ঘটনা তদন্ত করছে।
কট্টর ডানপন্থী জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-গভিরের অধীনে থাকা ইসরায়েল প্রিজন সার্ভিস (আইপিএস) এবং দেশটির অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগ জানিয়েছে, তারা পৃথক পৃথক মামলা নিয়ে মন্তব্য করার মতো অবস্থানে নেই।
রয়টার্সের প্রশ্নের জবাবে বেন গভিরের কার্যালয় বলেছে, ইসরায়েলি কারাগারে ‘সন্ত্রাসীদের’ তদারকি করে থাকার পরিবেশ এবং ‘অপরাধীদের’ জন্য উপযুক্ত থাকার জায়গা দেওয়া হয়।
ইসরায়েলি মানবাধিকার গ্রুপ পাবলিক কমিটি এগেইনস্ট টর্চার ইন ইসরায়েলের (পিসিএটিআই) নির্বাহী পরিচালক টাল স্টেইনার ভুক্তভোগী বন্দিদের ওপর নির্যাতনের বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ভুক্তভোগীরা ব্যক্তিরা যেসব উপসর্গের (মানসিক সমস্যা) কথা বলেছেন, এটি তাদের জীবদ্দশায় প্রতিধ্বনিত হতে পারে। শুধু তাই নয় তাদের পরিবারকেও চুরমার করে দিতে পারে।
স্টেইনার বলেন, গত ৭ অক্টোবর থেকে ইসরায়েলি কারাগারে নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে গেছে। এটি ফিলিস্তিনি সমাজে বিধ্বংসী প্রভাব ফেলবে এবং ইতিমধ্যেই ফেলেছে।
জুলাই মাসে হাসপাতালের বিছানা থেকে কথা বলার সময়, মারাত্মকভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত ওবাইয়াত নিজের এবং সহবন্দীদের সাথে আচরণকে ‘জঘন্য’ বলে অভিহিত করেছিলেন। তার নষ্ট হয়ে যাওয়া পায়ের ক্ষতচিহ্ন দেখান। বিচ্ছিন্নতা, ক্ষুধা, হাতকড়া এবং ধাতব রড দিয়ে নির্যাতনের বর্ণনা দেন তিনি।
অথচ কারাগারে যাওয়ার আগে তোলা ওবাইয়াতের ছবিতে দেখা যাচ্ছে, তিনি একজন শক্তিশালী গড়নের মানুষ।
গত ১৯ ডিসেম্বর ইসরায়েলের উচ্চ আদালত ফিলিস্তিনি বন্দিদের জন্য পর্যাপ্ত খাবারের অভাব নিয়ে মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোর আনা একটি আবেদনের জবাব দিতে রাষ্ট্রকে নির্দেশ দেয়।
হামাসের হামলার পর গাজায় বন্দি ২৫১ জন নাগরিকের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের কথাও জানিয়েছে ইসরায়েল। শনিবার প্রকাশিত ইসরায়েলি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জিম্মিরা যৌন ও মানসিক নির্যাতনসহ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। হামাস বরাবরই জিম্মিদের নির্যাতনের কথা অস্বীকার করে আসছে।
ফিলিস্তিনি প্রিজনার্স ক্লাব নামে একটি অ্যাডভোকেসি গ্রুপ জানিয়েছে, ওবাইয়াতকে বর্তমানে বেথেলহেমের দক্ষিণে ইটজিয়নের একটি ছোট ‘আটক কেন্দ্রে’ রাখা হয়েছে। তাকে ‘প্রশাসনিক আটকে’ ছয় মাস ধরে আটকে রাখা হয়েছে। কোনো অভিযোগ বা বিচার ছাড়াই এক ধরনের কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে এবং তার গ্রেপ্তারের আনুষ্ঠানিক কারণ এখনো জানা যায়নি।
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগ এবং কারা বিভাগ মামলা সম্পর্কে রয়টার্সের প্রশ্নের জবাব দেয়নি।
ইসরায়েলি মানবাধিকার গ্রুপ পিসিএটিআই জানিয়েছে, গত বছরের অক্টোবর থেকে যুদ্ধের সময় হেফাজতে অন্তত ৫৬ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। যেখানে সংঘাতের আগের বছরগুলোতে বছরে মাত্র এক বা দু’জন মারা গিয়েছিলেন।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct