পাশারুল আলম: ভারতে জাতিগণনা একটি নিছক পরিসংখ্যানগত প্রক্রিয়া নয়; বরং এটি একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতিবিম্ব। ২০২৫ সালের জাতিগণনা উপলক্ষে যে রাজনৈতিক আলোড়ন ও নীতিগত বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তা বহুদিনের অবদমিত দাবির বহিঃপ্রকাশ। বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি, বিশেষত রাহুল গান্ধি ও তাঁর দল কংগ্রেসের সক্রিয় ভূমিকা এবং সমাজবাদী পার্টি, রাষ্ট্রীয় জনতা দল সহ বিভিন্ন নাগরিক আন্দোলনের চাপ জাতিগণনাকে কেবল প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং সামাজিক ন্যায়ের একটি ধাপে উন্নীত করেছে।
সামাজিক ন্যায়বিচার ও জাতিগণনার তাৎপর্য
“বৈষম্যকে মেনে নেওয়া ও গণনা করা হল প্রথম পদক্ষেপ।” ভারতীয় সমাজের দীর্ঘকালীন শ্রেণি ও জাতিগত বৈষম্য দলিলবদ্ধ করতে জাতিগণনা একটি অনিবার্য প্রক্রিয়া। বিশেষত অন্যান্য পিছিয়ে পড়া শ্রেণি (OBC)-র সংরক্ষণ-সংক্রান্ত দাবিগুলি এই গণনার মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেতে পারে।
মণ্ডল কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের জনসংখ্যার অন্তত ৫২% ওবিসি শ্রেণিভুক্ত হলেও, সংরক্ষণে তাদের অংশ ২৭%। ২০২৫-এর জাতিগণনায় যদি ওবিসিদের প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি উঠে আসে, তবে সেই অনুযায়ী সংরক্ষণের হার পুনর্বিবেচনা করা কি রাষ্ট্রের কর্তব্য নয়? তথ্য ছাড়া ন্যায়বিচারের ভিত্তি স্থাপন সম্ভব নয়।
রাজনৈতিক বাস্তবতা ও ‘হক’-এর রাজনীতি
‘জিতনা আবাদি, উতনা হক’—এই স্লোগান বর্তমানে রাজনৈতিক বাস্তবতার কেন্দ্রবিন্দুতে। বিজেপি প্রাথমিকভাবে জাতিগণনার বিরোধিতা করলেও পরবর্তীতে বাস্তব রাজনৈতিক চাপের মুখে তা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে রাজনৈতিকভাবে একটি প্রতীকী পরাজয়, কিন্তু সমাজের পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি।
ওবিসি ভোটব্যাংক এখন আর কেবল প্রান্তিক নয়, বরং ভারতের নির্বাচন রাজনীতির প্রধান চালিকা শক্তি। কংগ্রেসের নেতৃত্বে জাতিগণনার দাবিকে গণআন্দোলনে রূপ দেওয়া, যদিও রাজনৈতিক কৌশলের অংশ, তবুও এর ফলাফল সমাজবদলের সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
জাতিগণনার সীমাবদ্ধতা ও বিতর্ক
যদিও জাতিগণনা একান্ত প্রয়োজনীয়, তবুও এর বাস্তবায়ন নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন থেকে যায়:
১. অসম্পূর্ণ গণনা: যদি কেবল ওবিসি, এসসি ও এসটি গোষ্ঠীর গণনা হয় এবং উচ্চবর্ণের তথ্য বাদ পড়ে, তবে সমাজের পূর্ণ বৈষম্যচিত্র উঠে আসবে না।
২. অর্থনৈতিক ও কৃষিভিত্তিক উপাত্তের অভাব: শুধুমাত্র জাতিগত গঠনের পরিসংখ্যান যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন অর্থনৈতিক, জমি ও আয়ের তথ্য—বিশেষত শ্রেণিগত বৈষম্য বুঝতে। অথচ এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান এখনও অস্পষ্ট।
৩. সংরক্ষণের সীমা: বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী সংরক্ষণের সর্বোচ্চ সীমা ৫০%। কিন্তু যদি ওবিসিদের প্রকৃত সংখ্যা এই সীমার বহু ঊর্ধ্বে দেখা যায়, তবে সংবিধানিক কাঠামোতে পরিবর্তন ছাড়া তা কার্যকর করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।
প্রশাসনিক ও সাংবিধানিক প্রতিবন্ধকতা
জাতিগণনার স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতা নির্ভর করে প্রশাসনিক সদিচ্ছা ও নিরপেক্ষতার উপর। কিন্তু বাস্তবে আমলাতন্ত্র এবং গণমাধ্যমের পরিচালনা আজও উচ্চবর্ণ ও প্রভাবশালী শ্রেণির করায়ত্ত। এমনকি বিচারব্যবস্থাও এর ব্যতিক্রম নয়। ফলে তথ্য বিকৃতি, বিলম্ব, বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত উপস্থাপনা জাতিগণনার গুরুত্বকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে।
পরিশেষে বলা যায়, জাতিগণনা আজ কেবল একটি পরিসংখ্যানগত অনুশীলন নয়, এটি সামাজিক ন্যায়, সংবিধানিক ভারসাম্য এবং রাজনৈতিক বাস্তবতার সন্ধিক্ষণে দাঁড়ানো এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। বৈষম্যের অস্তিত্ব স্বীকার না করলে তার নিরসন সম্ভব নয়।
যেমন যোগেন্দ্র যাদব বলেন, “তথ্য সংগ্রহ ও গণনা না করে বৈষম্য দূর করা যায় না।” তাই জাতিগণনা কেবলমাত্র প্রশাসনিক কার্যক্রম নয়, বরং এক বৃহত্তর সমাজবদলের সূচনা—যার সাফল্য নির্ভর করবে এর স্বচ্ছতা, পরিপূর্ণতা এবং সদিচ্ছার উপর।
*** মতামত লেখকের নিজস্ব
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct