ভারতবর্ষের স্বাধীনতার আট দশক পূর্তির প্রাক্কালে যখন দেশ উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ছুঁয়ে ফেলছে, তখনও পশ্চিমবঙ্গের কিছু মুসলিম অধ্যুষিত জেলা শিক্ষার ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে। বিশেষত মুর্শিদাবাদ, মালদা, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর ও বীরভূম জেলার মুসলিম জনগোষ্ঠী এখনও মৌলিক শিক্ষাগত পরিকাঠামোর অভাবে ভুগছে। এই পিছিয়ে পড়ার কারণ শুধু অর্থনৈতিক নয়, বরং এটি একটি বহুস্তরীয়, ঐতিহাসিক ও নীতিগত অবহেলার ফলাফল। এই সংকট মোকাবিলায় কেবল সরকারি প্রকল্প ও নীতিই যথেষ্ট নয়, বরং প্রয়োজন মুসলিম সমাজের মধ্যে থেকে সংগঠিত, দায়িত্বশীল ও উদ্ভাবনী উদ্যোগ। লিখেছেন পাশারুল আলম।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতার আট দশক পূর্তির প্রাক্কালে যখন দেশ উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ছুঁয়ে ফেলছে, তখনও পশ্চিমবঙ্গের কিছু মুসলিম অধ্যুষিত জেলা শিক্ষার ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে। বিশেষত মুর্শিদাবাদ, মালদা, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর ও বীরভূম জেলার মুসলিম জনগোষ্ঠী এখনও মৌলিক শিক্ষাগত পরিকাঠামোর অভাবে ভুগছে। এই পিছিয়ে পড়ার কারণ শুধু অর্থনৈতিক নয়, বরং এটি একটি বহুস্তরীয়, ঐতিহাসিক ও নীতিগত অবহেলার ফলাফল। এই সংকট মোকাবিলায় কেবল সরকারি প্রকল্প ও নীতিই যথেষ্ট নয়, বরং প্রয়োজন মুসলিম সমাজের মধ্যে থেকে সংগঠিত, দায়িত্বশীল ও উদ্ভাবনী উদ্যোগ। এই প্রবন্ধে সেই পশ্চাৎপদতার পরিসংখ্যান, কারণ, এবং সম্ভাব্য জাতিগত (communitarian) সমাধানের পথ বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
শিক্ষাগত পশ্চাৎপদতার বাস্তব চিত্র
সাচার কমিটি রিপোর্ট (২০০৬)
সাচার রিপোর্টে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, মুসলিম শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তির হার পশ্চিমবঙ্গের গড় হারের চেয়ে ১০% কম। মাধ্যমিক স্তরে ছাত্রীদের ড্রপআউটের হার ৪০% ছাড়িয়ে গেছে, যা লিঙ্গ বৈষম্য ও সামাজিক অনিশ্চয়তার সূচক।
NFHS-5 রিপোর্ট (২০২০-২১)
NFHS-5 অনুযায়ী মুর্শিদাবাদে মহিলা সাক্ষরতার হার মাত্র ৫২%, যা রাজ্যের গড় (৭১%) থেকে অনেক নিচে। মালদা জেলার ৬-১৪ বছর বয়সী শিশুর ৩০% নিয়মিত বিদ্যালয়ে যায় না, যা শিক্ষার প্রতি অবহেলা ও আর্থসামাজিক চাপে শিশুদের কাজে নিযুক্ত হওয়ার প্রবণতা প্রকাশ করে।
প্রধান কারণসমূহের বিশ্লেষণ
১. অবকাঠামোগত ঘাটতি
বহু গ্রামে এখনও বিদ্যালয় নেই বা থাকলেও সেখানে পর্যাপ্ত শিক্ষক, শৌচাগার, পানীয় জল বা পাঠ্যসামগ্রীর অভাব প্রকট। পাঠক্রমের গুণগত মানও প্রশ্নাতীত নয়।
২. দারিদ্র্য ও শিশুশ্রম
অধিকাংশ পরিবার দিনমজুর বা ছোট ব্যবসায় যুক্ত। ফলে অভাবী পরিবারগুলিকে সন্তানের শ্রম ব্যবহার করতেই হয়। স্কুলে যাওয়ার খরচ, ইউনিফর্ম, বই-খাতার খরচও অনেক সময় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
৩. ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উদাসীনতা
মসজিদ ও মাদ্রাসাগুলি অনেক সময় ধর্মীয় শিক্ষার বাইরে শিক্ষার্থীদের সামাজিক ও কর্মজীবনোপযোগী শিক্ষায় আগ্রহী নয়। আধুনিক শিক্ষার প্রসারে তহবিলের অভাব এবং মানসিক বাধাও একটি প্রধান কারণ।
৪. লিঙ্গ বৈষম্য ও সামাজিক অনুশাসন
রক্ষণশীল মানসিকতার ফলে মেয়েদের উচ্চশিক্ষা অবধি যাওয়ার পথ অনেক সময় বন্ধ হয়ে যায়। বাল্যবিবাহ, প্রথাগত বিধিনিষেধ এবং নিরাপত্তার অভাবও একটি বড় বাধা।
সমাধানের পথ: একটি জাতিগত পুনর্জাগরণ
শিক্ষার এই সংকট কাটিয়ে উঠতে হলে সমাজের অভ্যন্তর থেকেই সংগ্রামের সূচনা করতে হবে। একে কেন্দ্র করে তৈরি হতে পারে ‘স্বনির্ভর শিক্ষা আন্দোলন’—যা হবে মুসলিম সমাজের নিজস্ব উদ্যোগ ও নেতৃত্বে পরিচালিত।
১. স্থানীয় সংগঠন ও মসজিদ-কেন্দ্রিক প্রাথমিক শিক্ষা
প্রতিটি মসজিদ বা ইসলামিক সংগঠনের পাশে একটি প্রি-প্রাইমারি স্কুল স্থাপন করা যেতে পারে।
সপ্তাহে অন্তত তিন দিন আধুনিক শিক্ষার ক্লাস চালানো যেতে পারে—যেখানে ধর্মীয় ও সামাজিক শিক্ষা পাশাপাশি চলবে।
২. NGO ও শিক্ষা ট্রাস্টের সংযুক্তি
Al Ameen Mission, Rahmani 30, Talimi Board-এর মতো সফল সংগঠনের কার্যপদ্ধতি অনুসরণ করে নতুন প্রকল্প গঠিত হতে পারে।
STEM শিক্ষা, ইংরেজি দক্ষতা ও নারীদের প্রযুক্তি-ভিত্তিক প্রশিক্ষণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
৩. স্থানীয় শিক্ষিত পেশাজীবীদের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন
“গ্রাম শিক্ষা ফান্ড” গঠন করে স্থানীয় শিক্ষকদের পারিশ্রমিক, পাঠ্যবই কেনা ও কোচিং ব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভব।
গ্রামের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক ও প্রবীণদের নিয়ে মাসিক শিক্ষাসভা আয়োজিত হতে পারে।
৪. মহিলা শিক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব
মেয়েদের জন্য পৃথক কোচিং সেন্টার, মহিলা শিক্ষিকা নিয়োগ, ছাত্রীদের জন্য সুরক্ষিত পরিবহন ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নারীশিক্ষার গুরুত্ব বুঝিয়ে জনসচেতনতা গড়তে হবে।
“মিল্লি শিক্ষা মিশন”: একটি প্রস্তাবিত মডেল
এই জাতীয় উদ্যোগের একটি রূপ হতে পারে “মিল্লি শিক্ষা মিশন”—একটি স্বেচ্ছাসেবী ও সমাজভিত্তিক শিক্ষা প্রকল্প, যার লক্ষ্য মুসলিম অধ্যুষিত ব্লকগুলিতে অন্তত একটি করে মডেল স্কুল স্থাপন করা।
প্রধান বৈশিষ্ট্য:
ত্রিভাষিক শিক্ষা: বাংলা, ইংরেজি ও উর্দু/আরবি।
ডিজিটাল ও গণিত দক্ষতা উন্নয়ন ক্লাস
মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জন্য evening science class
প্রযুক্তিনির্ভর পাঠদান (projector, tablet, ইন্টারনেট)
অর্থায়ন ও সম্পৃক্ততা
স্থানীয় ব্যবসায়ী, প্রবাসী শ্রমিক ও মুসলিম যুবক-যুবতীদের অনুদানে তহবিল গঠন।
Crowdfunding ও ওয়াকফ সম্পদের সঠিক ব্যবহারের পরিকল্পনা।
পরিশেষে বলা যায়, শিক্ষা শুধু আর্থিক উন্নতির মাধ্যম নয়, এটি একটি জাতির চেতনার ভিত্তি। পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম সমাজ যদি আত্মসমালোচনামূলকভাবে নিজেদের শিক্ষাগত দুর্বলতা উপলব্ধি করে এবং সংগঠিত ভাবে এগিয়ে আসে, তবে আগামী প্রজন্মের জন্য এক নতুন দিগন্ত খুলে যাবে। সরকারি সহায়তা কাম্য বটে, কিন্তু আত্মনির্ভরতা ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়। ইতিহাস আমাদের শেখায়—স্বাধীনতা সংগ্রাম হোক বা ভাষা আন্দোলন—সব ক্ষেত্রেই জনগণের আত্মপ্রেরণাই সবচেয়ে কার্যকর শক্তি।
“স্বশিক্ষিত জাতিই স্বাবলম্বী জাতি—এবং এই দায়িত্ব শুধু রাষ্ট্রের নয়, প্রতিটি ব্যক্তির।”
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct