আপনজন ডেস্ক: মণিপুর নিয়ে সরকার ও শাসক দল বিজেপির রাজনৈতিক হাতিয়ার নস্যাৎ করে দিল সুপ্রিম কোর্ট। সোমবার হিংসা–উপদ্রুত ওই রাজ্যের নারী নির্যাতন–সম্পর্কিত একাধিক মামলার শুনানির সময় প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় বলেন, অন্যান্য রাজ্যে নারী নির্যাতনের ঘটনা তুলে ধরে মণিপুরের জঘন্যতম ঘটনার সাফাই দেওয়া যায় না। প্রধান বিচারপতি বলেন, মণিপুরে যা ঘটেছে, তা নজিরবিহীন। মণিপুরের জাতিগত দাঙ্গার সহিংসতা গোটা দেশকে স্তম্ভিত করলেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এখনো সংসদে কোনো বিবৃতি দেননি। বিরোধীদের দাবি অনুযায়ী মণিপুর নিয়ে আলোচনায়ও সরকার পক্ষ রাজি নয়। তারা তাদের শর্তে স্বল্প সময়ের আলোচনা করতে চায়। প্রধানমন্ত্রীকে বিবৃতি দিতে ও জবাবদিহিতে বাধ্য করাতে বিরোধীরা সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পেশ করলেও সরকার পক্ষ এখনই তা নিয়ে আলোচনা করতে চায় না; বরং মণিপুরে হিংসার বীভৎসতা চাপা দিতে সরকার ও বিজেপির পক্ষ থেকে পশ্চিমবঙ্গ, রাজস্থান, ছত্তিশগড়ের মতো বিরোধীশাসিত রাজ্যে নারী নির্যাতন নিয়ে আলোচনার দাবি তোলা হয়েছে। সেই দাবি যে অন্যায্য ও অযৌক্তিক, প্রধান বিচারপতি তা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিলেন। সরকার পক্ষ ও শাসক দলের সেই যুক্তিই আজ প্রধান বিচারপতির এজলাসে পেশ করেন বিজেপির প্রয়াত নেত্রী ও প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের আইনজীবী কন্যা বাঁশুরি স্বরাজ। কিন্তু তার দাবিকে গুরুত্ব না দিয়ে প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় বলেন, ‘এসব বলে লাভ নেই। অপরাধ অন্য রাজ্যেও হচ্ছে। এটা সামাজিক বাস্তবতা। কিন্তু অন্য রাজ্যে হচ্ছে বলে মণিপুরে যা ঘটেছে, তা চাপা দেওয়া যায় না।’ প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়, বিচারপতি জে বি পর্দিওয়ালা ও বিচারপতি মনোজ মিশ্রর এজলাসে মণিপুর নিয়ে একাধিক মামলার শুনানি শুরু হয়। দুই নারীকে বিবস্ত্র করে হাঁটানো ও তাঁদের নির্যাতনের ভিডিও প্রকাশ্যে আসার পর প্রধান বিচারপতি মন্তব্য করে বলেছিলেন, সরকার ব্যবস্থা না নিলে তাঁরা তা করতে বাধ্য হবেন। সেই মন্তব্যের পর কেন্দ্রীয় সরকার ভিডিওতে প্রকাশিত ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব সিবিআইকে দেওয়ার কথা জানায়। ওই সিদ্ধান্তের ভালো–মন্দ, মণিপুর থেকে মামলাগুলো অন্য কোনো রাজ্যে (আসাম বা ত্রিপুরা) সরানো ঠিক হবে কি না—এসব বিষয়েও সুপ্রিম কোর্ট আজ বিভিন্ন পক্ষের মতামত শোনেন। সেই নির্যাতিতা দুই মহিলা এজলাসে বলেন, সিবিআইয়ের ওপর তাদের আস্থা নেই। তাঁরা চান, সুপ্রিম কোর্টের গড়ে দেওয়া বিশেষ তদন্ত দল ঘটনার তদন্ত করুক। কেন্দ্র জানিয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণে তদন্ত চালানো হলে তাদের আপত্তি নেই। আগামীকালও শুনানি চলবে।
আজ শুনানিতে কেন্দ্র ও মণিপুর রাজ্য সরকারকে বেশ কিছু অপ্রিয় মন্তব্য শুনতে হয়। প্রধান বিচারপতি জানতে চান, নারী নির্যাতনের ওই ঘটনা ঘটেছে গত ৪ মে। জিরো এফআইআর করা হয়েছে ১৮ মে। কেন পুলিশ ১৪ দিন সময় নিল এফআইআর করতে? কেন তারা এত দিন অপেক্ষা করছিল? কেন নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে এফআইআর করেনি? রাজ্য সরকারের পক্ষে সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারেননি। তিনি শুধু বলেন, ভিডিও প্রকাশ্যে আসার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই রাজ্য সরকার ৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। তিনি জানান, ওই বিশেষ থানায় মোট ২০টি এফআইআর দাখিল হয়েছিল। সারা রাজ্যে দায়ের হয়েছে ছয় হাজারের বেশি। প্রধান বিচারপতি জানতে চান, এফআইআর দাখিলের এক মাস পর কেন তা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠানো হয়। যে ছয় হাজার এফআইআর দাখিল হয়েছে, সেগুলোর চরিত্রই–বা কী, তা–ও তিনি জানতে চান। কয়টি নারী নির্যাতনের, কয়টি ধর্ষণের, কয়টি খুন, লুটপাট, আগুন লাগানোর—প্রধান বিচারপতি তা জানতে চাইলে সলিসিটর জেনারেল বলেন, তাঁর কাছে এসব তথ্য নেই। প্রধান বিচারপতি তাঁকে নির্দেশ দেন, মণিপুর সরকারের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে মঙ্গলবার এজলাসকে জানাতে। একই সঙ্গে এফআইআরগুলোর কোনটা কোন অপরাধসংক্রান্ত, সেই ভাগাভাগিও করার নির্দেশ দেওয়া হয়।তদন্তের ভার সিবিআইয়ের হাতে দেওয়া হবে, নাকি সুপ্রিম কোর্ট তদন্ত দল গড়ে দেবে, রাজ্যবাসীর আস্থা ফেরাতে বিশেষ দল গড়ে দেওয়া হবে কি না—এসব বিষয়েও সুপ্রিম কোর্ট মতামত শুনেছে। ভিডিওতে যে দুই নারীর ওপর নির্যাতনের দৃশ্য রয়েছে, তাঁদের আইনজীবী কপিল সিব্বাল ওই মামলার দায়িত্ব সিবিআইয়ের হাতে দেওয়ার বিরুদ্ধে আপত্তি জানান। মণিপুর থেকে সরিয়ে মামলাটি আসামে নেওয়ারও তিনি বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, নির্যাতিত নারীদের সিবিআইয়ের ওপর বিশ্বাস নেই। তাঁরা চান সুপ্রিম কোর্টের গড়ে দেওয়া বিশেষ তদন্ত দল তদন্ত করুক। মণিপুর পরিস্থিতি নিয়ে আজকেও ভারতীয় সংসদের উভয় কক্ষের অধিবেশন বারবার মুলতবি হয়ে যায়। রাজ্যসভার চেয়ারম্যান সরকারের শর্তে স্বল্প সময়ের আলোচনার অনুমতি দেন। বেলা দুইটা থেকে তা শুরুর চেষ্টাও চলে। কিন্তু বিরোধীদের প্রতিরোধে সভা মুলতবি হয়ে যায়। লোকসভায় গৃহীত অনাস্থা প্রস্তাব কবে আলোচিত হবে, স্পিকার তা আজকেও ঠিক করেননি। এই অবস্থায় হট্টগোলের মধ্যে সরকার প্রয়োজনীয় বিল পাস করিয়ে নিচ্ছে।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct