ইসরায়েলে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগঠন হামাসের চলতি আক্রমণের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যকে কেন্দ্র করে সম্ভাব্য সমঝোতামূলক চুক্তি উপেক্ষিত হতে পারে এবং অঞ্চলটি নতুন রাজনৈতিক কাঠামোয় রূপান্তরিত হতে পারে। মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএনের বিশ্লেষণে এমনই ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।গাজা উপত্যকা থেকে অনুপ্রবেশ করে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) সদস্য ছাড়াও বেসামরিক নাগরিকদের জিম্মি করে নিয়ে গেছে হামাস। ঠিক কতজন নেওয়া হয়েছে তা এখনো অজানা।তবে গণমাধ্যমগুলো বলছে, সংখ্যাটি কয়েক শ হতে পারে। হামাস ঘোষণা দিয়েছে, তারা এসব জিম্মির বিনিময়ে ইসরায়েলি কারাগারে ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি চায়। অতীতে এভাবে বহুসংখ্যক বন্দিকে মুক্ত করতে সক্ষম হয় তারা। এ অবস্থায় পরিস্থিতি আরো জটিল হবে।কারণ হামাস এসব জিম্মি ব্যক্তিকে গাজার বিভিন্ন জায়গায় এমনভাবে ছড়িয়ে দেবে যে ইসরায়েলি বাহিনী গাজার আকাশে বিমান হামলা চালাতে দ্বিধাবোধ করতে বাধ্য। কারণ এতে হামাসের হাতে বন্দিদের ক্ষতির আশঙ্কা থাকবে।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের মধ্যস্থতায় আরববিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য স্বাক্ষরিত ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’ নিয়ে নতুন করে ভাবতে হতে পারে, যার আওতায় সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), বাহরাইনসহ কয়েকটি আরব রাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের দিকে এগিয়েছে। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের দিক থেকে ওই চুক্তি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল।কারণ তারা মনে করে, চুক্তিতে তাদের জন্য কিছুই নেই। ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তা জ্যারেড কুশনার অবশ্য অঙ্গীকার করেছিলেন, ফিলিস্তিনি প্রকল্পে ওয়াশিংটন পাঁচ হাজার ডলার সহায়তা করবে। কিন্তু ২০১৯ সালে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ বাহরাইনের এসংক্রান্ত সম্মেলন বয়কট করায় তা আর হয়ে ওঠেনি।আবার ট্রাম্প প্রশাসন তেল আবিব থেকে তার দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তর করে। অথচ পূর্ববর্তী কোনো মার্কিন শাসকই এ ধরনের পথ বেছে নেয়নি।ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে, কারণ তারা পূর্ব জেরুজালেমের ওপর অধিকার দাবি করে।এর মধ্যে বাইডেন প্রশাসনের সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে, যা এ অঞ্চলকে নতুন কাঠামো দিতে পারে। প্রথমবারের মতো কোনো ইসরায়েলি মন্ত্রী সম্প্রতি সৌদি আরব সফর করেছেন। গত সপ্তাহে সৌদি আরবে ইহুদি প্রার্থনাসভা হওয়ার খবরও পাওয়া গেছে। ইসরায়েলের বর্তমান কট্টরপন্থী সরকার ফিলিস্তিন সংকট নিয়ে সংবেদনশীল নয়। আবার সৌদির প্রকৃত শাসক মোহাম্মদ বিন সালমান ফিলিস্তিনিদের প্রতি তাঁর বাবা বাদশাহ সালমানের মতো সমব্যথী নন। এ ছাড়া ইসরায়েল ও সৌদি আরব উভয়ের জন্যই ইরান শত্রু রাষ্ট্র।মূলত উপরোক্ত কারণগুলোই হামাসকে ইসরায়েলে হামলা চালাতে উৎসাহিত করেছে। হামাসের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক রয়েছে, যা অনেকবারই আলোচনা হয়েছে। সৌদি-ইসরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের গুঞ্জনের মধ্যে ইরান বেশ কয়েকবার এ নিয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছে। ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি এই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। শনিবার হামাসের আক্রমণকে সমর্থনের বার্তা দিয়েছেন খামেনির শীর্ষ সামরিক উপদেষ্টা।
হামাস কারা
হামাসের উত্থান মূলত আশির দশকে। ফিলিস্তিনিদের প্রথম গণজাগরণের (ইন্তিফাদা) পথ ধরে এই সংগঠনের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৮৭ সালের দিকে ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থার (পিএলও) নেতা শেখ আহমেদ ইসমাইল হাসান ইয়াসিনসহ আরো কয়েকজনের নেতৃত্বে সংগঠনটির যাত্রা শুরু হয়। ১৯৮৮ সালে ‘হামাস চার্টার’ ঘোষণার মধ্য দিয়ে সংগঠনটি জানায়, তারা মিসরভিত্তিক মুসলিম ব্রাদারহুডের ফিলিস্তিন শাখা হিসেবে প্রকাশ্যে কার্যক্রম চালাতে যাচ্ছে। এরপর হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের কয়েক দফা যুদ্ধ হয়। ঘটনাপ্রবাহের সূত্র ধরে হামাস গাজা উপত্যকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। অন্যদিকে ফিলিস্তিনের আরেক অংশে বলবৎ থাকে ফাতাহর শাসন। বর্তমানে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ (পিএ) নামের স্বশাসিত কর্তৃপক্ষের নেতৃত্বে এই ফাতাহ।পশ্চিমা বিশ্ব হামাসকে ইসলামপন্থী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী মনে করে এবং ফাতাহকে ধর্মনিরপেক্ষ নিয়ন্ত্রিত গোষ্ঠী মনে করে। ২০০৬ সালের পুরো ফিলিস্তিনের নির্বাচনে হামাস সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় এবং ফাতাহর সঙ্গে ঐক্য গড়ে সরকার তৈরি করে। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বের আর্থিক অসহযোগিতায় সেই সরকার টিকতে পারেনি। তবে তখন থেকে গাজায় একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ তৈরি করে তারা। বর্তমানে হামাসের নেতৃত্বে রয়েছে ইসমাইল হানিয়া।ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জাপানসহ অনেক পশ্চিমা দেশ তাদের সন্ত্রাসী সংগঠন মনে করে।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct