বর্তমান ভারতে সবচেয়ে জটিল সমস্যা হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতাবাদের ব্যাপক উত্থান। বস্তুত রাষ্ট্রিক আর সামাজিক জীবনে সাম্প্রদায়িক আচরণ লালিত-পালিত এবং উৎসাহিত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় শাসকগোষ্ঠীর দ্বারাই। ভয়ের কারণ, ফ্যাসিবাদের পোষক সরকার সাম্প্রদায়িকতাবাদের বীভৎস প্রকাশ সাম্প্রদায়িক একতরফা দাঙ্গার মারফত দেশস্থ বিশেষধর্মী মানুষজনের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। তা নিয়ে এই সন্দর্ভ পত্রটি লিখেছেন ইতিহাসবেত্তা খাজিম আহমেদ।
নৈর্ব্যক্তিক বিচারের প্রতি পক্ষপাত রয়েছে এমন সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, রাষ্ট্র ভারতের সবচেয়ে জটিল সমস্যা হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতাবাদের ব্যাপক উত্থান। বস্তুত রাষ্ট্রিক আর সামাজিক জীবনে সাম্প্রদায়িক আচরণ লালিত-পালিত এবং উৎসাহিত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় শাসকগোষ্ঠীর দ্বারাই। ভয়ের কারণ এটাই যে, ফ্যাসিবাদের পোষক এই সরকার সাম্প্রদায়িকতাবাদের বীভৎস প্রকাশ সাম্প্রদায়িক একতরফা দাঙ্গার মারফত দেশস্থ বিশেষধর্মী মানুষজনের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। সাম্প্রদায়িকতাবাদের উত্থান ঘটেছিল আধুনিক রাজনীতির উন্মেষের কালে। বিগত এক শতকের বেশি সময় ধরে মধ্যশ্রেণিগুলিকে এবং বুদ্ধিজীবীদের স্থায়ীভাবে ঘিরে ছিল একটি সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, যা রাজনীতিতে, পত্র-পত্রিকায়, সাহিত্যে এবং বিশেষ করে শিক্ষাব্যবস্থায় সর্বব্যাপী হয়েছিল। বিপনচন্দ্র বলছেন, সাম্প্রদায়িকতা ছিল বিগত প্রায় ১৬০ বছরের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার ভ্রান্ত চেতনা। কারণ বিষয়গতভাবে হিন্দু আর মুসলমানদের স্বার্থের মধ্যে বাস্তব সংঘাতের অস্তিত্ব ছিল না। তাঁর মতের সমর্থনে জওহরলাল নেহরু আর হুমায়ুন কবিরের সিদ্ধান্ত উদ্ধৃতি করেছেন : “এ কথা যেন কখনো বিস্মরণ না হয় যে, ভারতে সাম্প্রদায়িকতাবাদ একটি আধুনিক ঘটনা যা আমাদের চোখের সামনে গড়ে উঠেছে।” (নেহরু, সিলেক্টেড ওয়ার্কস, সপ্তম খন্ড, পৃষ্ঠা-৬৯)। ‘কথা শোনা যাচ্ছে সাম্প্রদায়িকতাবাদের জোয়ারের। আমি মনে করি কথাটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য নয়। বস্তুত, সাম্প্রদায়িক প্রভেদ ভারতীয় রাজনীতিতে একটি দুষ্ট ক্ষত হিসাবে আছে কেবল আধুনিক যুগের গোড়া থেকে।’ (কবির, মুসলিম পলিটিক্স, পৃষ্ঠা-৮৬)। আদতে ধর্মীয় প্রভাব থেকে সাম্প্রদায়িকতাবাদের উদ্ভব ঘটেনি, বরং সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এবং মতাদর্শগত প্রয়োগ ধর্মীয় প্রভেদকে সাম্প্রদায়িক বিচ্ছেদে রূপান্তরিত করেছিল। সাম্প্রদায়িকতাবাদ, জনগণের সার্বভৌমত্ব ভিত্তিক আধুনিক রাজনীতিকে ধর্মীয় অভিজ্ঞানের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করতে সেদিনও চেয়েছিল, আজও সেই প্রশ্নে ভয়াবহভাবে সমান ক্রিয়াশীল।
ঔপনিবেশিক অধোবিকাশ হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে প্রতিযোগিতার জন্ম দিয়েছিল। চাকরির ক্ষেত্রে হিন্দুদের অধিকতর হারকে ‘হিন্দু অর্থনৈতিক আধিপত্য’ এবং মুসলমানদের বৃহত্তর অংশকে ‘হিন্দু অবস্থানের’ প্রতি ‘মুসলিম হুমকি’ হিসেবে ভাবার প্রবণতাকে তীব্রতর করেছিল। (দেখুন উইল ফ্রেড কান্টওয়েল স্মিথ, ‘মডার্ন ইসলাম ইন ইন্ডিয়া’, পৃষ্ঠা- ২১১-২১২)। সাম্প্রদায়িকভাবে চিন্তা আর কাজ করার মধ্য শ্রেণির যে প্রবণতা, তার বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস নেতৃত্ব দৃঢ় সংগ্রাম চালাবার সাহস পেত না। নেহরুর বিশ্বাস ছিল, সম্পূর্ণ মধ্যবিত্ত শ্রেণিভুক্ত ব্যক্তিবর্গকে সাম্প্রদায়িকতাবাদের কবল থেকে মুক্ত করতে পারলে; এই মহা আপদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার সম্ভাবনা বা আশা রয়েছে। (সিলেক্টেড ওয়ার্কস, সপ্তম খন্ড, পৃষ্ঠা-১৮৯)। হাল আমলে অর্থাৎ ২০১৪ সালের পর থেকে শুধুমাত্র সাম্প্রদায়িকতা নয়, উগ্র সাম্প্রদায়িকতা এবং তদ্জনিত বীভৎস হত্যাকাণ্ড, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ এবং নানাবিধ অমানবিক কাজকর্ম নিরবচ্ছিন্নভাবে চলছে। ধর্মীয় বিচারে সংখ্যালঘু জনসত্ত্বা ইতিহাসের এক অদ্ভুত মোড় আর বাঁকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। খুব স্পষ্ট করে বলা যেতে পারে আজকের দিনে তীক্ষ্ণ সাম্প্রদায়িক মানসিকতা প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রতিক্রিয়াশীল এবং পশ্চাদাভিমুখী শক্তিবর্গের এবং তাদের নানাবিধ ‘এজেন্সি’র স্বার্থকে সুরক্ষিত করছে। আর অগণন ‘আদম সন্তান’ বর্ণনাতীত বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে রয়েছে। সহানুভূতিবিহীন সংখ্যাগরিষ্ঠের দয়ায় যেন তারা বেঁচেবর্তে রয়েছে। এই সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইতিহাসবেত্তা অধ্যাপক বিপনচন্দ্র বলছেন, ‘১৮৮০-র দশক থেকে ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ সাম্প্রদায়িকতাবাদ’-এর যাত্রা শুরু হয় পাঞ্জাবে একটি তেজিয়ান গো-রক্ষা আন্দোলনের মাধ্যমে। এই আন্দোলন পরবর্তীকালে যুক্তপ্রদেশ আর বিহারে ছড়িয়ে পড়ে। মজার কথা, ব্রিটিশ ফৌজি ছাউনিগুলোতে ব্যাপকভাবে গো-হত্যা করার স্বাধীনতা বহাল তবিয়তে রয়ে গিয়েছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসমাজ দ্বারা লালিত সাম্প্রদায়িকতাবাদের প্রবক্তা রায়বাহাদুর লালচাঁদ (১৯০৯-এ ‘পাঞ্জাব হিন্দু মহাসভা’র প্রতিষ্ঠাতা) ‘সেলফ অ্যাবনেগেশন ইন পলিটিক্স’ নামক একটি পুস্তিকায় সাম্প্রদায়িক মতাদর্শের সূত্রগুলোর বিশদ উল্লেখ এবং ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। ‘ঐক্যের যূপকাষ্ঠে’ হিন্দু স্বার্থকে বলি দেবার জন্য তৎকালীন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতৃবর্গ এবং পত্রপত্রিকাগুলো খাঁটি হিন্দু দায়িত্ব পালন করছে না বলে অভিযোগ তোলেন।
হিন্দু মহাসভার সভাপতি এন সি কেলকার (১৯৩২) এবং ভাই পরমানন্দ (১৯৩৩) আর মহাসভার বিশিষ্ট নেতা বি এস মুজ্ঞে একই মনোভাব পোষণ করতেন। ১৯৩৭-এরপর হিন্দু মহাসভার বিনায়ক দামোদর সাভারকারের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ’ প্রবলতম সাম্প্রদায়িক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করতে থাকে। ১৯৩৮-এ হিন্দু মহাসভার সভাপতির ভাষণে সাভারকার মন্তব্য করেন, হিন্দু সম্প্রদায় থেকে উদ্ভূত প্রভাবশীল নেতৃবর্গ হিন্দু স্বার্থের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে, কিন্তু মুসলিম লীগের কাছে এক পায়ে খাড়া হয়ে থাকে। হিন্দু মহাসভার নেতৃবর্গ মনে করতেন যে, ব্রিটিশ সরকারের বিরোধিতা করে সরকারি শুভদৃষ্টি হারানো হিন্দুদের অনুচিত হবে। সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের তলার সারি আরো খোলাখুলিভাবে রাজানুগত প্রকাশ করে যেমন, লাহোরের হিন্দু যুবলীগ ১৯৩৩-এর মে মাসে বলে, আমরা মনে করি, এখন সময় যত না মুসলিম ও হিন্দুদের মধ্যে ঐক্যের, তার বেশি ব্রিটিশদের ও হিন্দু ভারতীয়দের মধ্যে ঐক্যের। আরএসএস-এর রাজনীতি ঔপনিবেশিক শাসনের তাঁবেদার ছিল পুরোপুরি। ১৯৩৯-এ এম এস গোলওয়ালকার হিন্দু নেতৃবর্গকে বিশ্বাসঘাতক, হিন্দু জাতীয়তার ধ্বংসকারী, নিচ স্বার্থপর এবং আমাদের সর্বনাশের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন। উগ্র সাম্প্রদায়িকতাবাদী ভি.ডি. সাভারকার এবং গোলওয়ালকার এমনভাবে ভারতীয় হিন্দুজাতির সংজ্ঞা দিলেন যাতে মুসলমানরা চিরকাল তার পরিধির বাইরে থাকে। মুসলমানদের দেখা হল, ভারতীয় সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে এক চিরকালীন বৈরী ও বিজাতীয় অংশরূপে, যারা বিদেশি হিসাবে হয় হিন্দুদের কাছে সম্পূর্ণ বশ্যতা স্বীকার করবে অথবা মুসলমান ধর্ম (ইসলাম ধর্ম) ত্যাগ করবে, নয়তো বহিষ্কৃত হবে। হিন্দু রাষ্ট্র দর্শন, হিন্দুত্ব, বাঞ্চ অফ থটস নামক পুস্তিকাগুলিতে এই ধরনের বিস্ময়কর মন্তব্য বারবার লাগাতার করা হয়েছে। এর প্রতিক্রিয়ায় মুসলমানরাও সম্প্রদায়গতভাবে সংঘবদ্ধ হতে শুরু করে। ১৯০৭ সালে ‘‘মুসলমানদের ‘দাসের স্তরে’ নেমে যাওয়ার এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরতন্ত্রের সম্ভাবনা... এবং সংখ্যালঘুরা তাদের পরিচিতি হারানোর বিপদ’’ (মইন শাকির, খিলাফত টু পার্টিশন, পৃষ্ঠা-১৯৫) প্রসঙ্গে নবাব ভিকারুল মূলক আশক্ষা প্রকাশ করেছিলেন। ১৯২৬ সালে বাংলাদেশের ‘মোসলেম দর্পণ’ সতর্ক করে দিয়েছিল যে, সরকারি সাহায্য না থাকলে তেইশ কোটি হিন্দু সাত কোটি মুসলমানকে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করে দেবে। (এম. এন. ইসলাম ‘বেঙ্গল মুসলিম ওপিনিয়ন অ্যাজ রিফ্লেক্টেড ইন দ্যা বেঙ্গল প্রেস- ১৯১০-১৯৩০, পৃষ্ঠা-১২৭)। সাবেক ভারতবর্ষের মুসলমানরা মনে করলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় এই দেশের অন্য সব সম্প্রদায়কে গুঁড়িয়ে দিতে এবং হিন্দু রাজ প্রতিষ্ঠা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ১৯৪১-এ ‘হ্যাম্পস্টেড স্টিচড’- স্যুট, ইতালিয়ান ‘সুজ’ পরিহিত শীর্ণকায় লম্বা একজন ব্যারিস্টার তাঁর ঠোঁটে চেপে ধরা ‘দগ্ধ হাভানা সিগার’ একটি ড্রিমল্যান্ডের প্রত্যাশা করে বসলেন। এসবই সংখ্যাগরিষ্ঠের সাম্প্রদায়িক ঐতিহাসিক কর্মকাণ্ডের নতিজা। জন্মের সুবাদে ইসলামধর্মী, সাংস্কৃতিক পরিচয়ে প্রায় ইউরোপিয়ান, এই ‘সুভদ্র জন’-মনে করতেন যুক্ত ভারতবর্ষে মুসলিমদের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। বিশ শতকের শুরু থেকেই সংখ্যাগরিষ্ঠ সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা বিপন্ন অস্তিত্বের প্রসঙ্গটি জোরেশোরে তোলে। ১৯০৯ সালে লেফ- কর্নেল ইউ. এন. মুখার্জি একটি বই প্রকাশ করেন, যার ইঙ্গিতপূর্ণ নাম একটি মৃত্যু পথ যাত্রী (এ ডাইং রেস) প্রয়োগ করা হয়েছিল হিন্দুদের প্রতি। বলেছিলেন, “ওরা (মুসলিমরা) তাকিয়ে আছে ঐক্যবদ্ধ মুসলিম জগতের জন্য---আমরা অপেক্ষা করছি আমাদের বিলুপ্তির জন্য। ১৯৩৭-এ ভি.ডি. সভারকার বলেন, ‘‘মুসলিমরা হিন্দুদের নিজ বাসভূমিতে ভূমিদাসের পর্যায়ে নামিয়ে দিতে চায়।’’ আধুনিক ভারত ইতিহাসের অসামান্য বিশ্লেষক বিপনচন্দ্র ‘কমিউনালিজম্ ইন মডার্ন ইন্ডিয়া’- নামক অনন্যসাধারণ গ্রন্থে সাম্প্রদায়িকতাবাদের উত্থান সম্পর্কে অনবদ্য আলোচনা উপস্থাপন করেছেন। তাঁর মতে, আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতি ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারের মারফত সাম্প্রদায়িকতারূপী দৈত্যকে অ্যারেস্ট করা সম্ভব হয়ে উঠত, কিন্তু সেই সময়ে এমন সদিচ্ছার উজ্জীবন লক্ষ্যযোগ্য হয়ে উঠেনি। সদ্যতন রাষ্ট্রীয় আর সামাজিক জীবনে আবারও উগ্র সাম্প্রদায়িকতাবাদের উত্থান প্রখরভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। ইতিহাস নির্দেশিত ‘সবক’ উপেক্ষণীয় হয়ে রইল। প্রখ্যাত মার্কসবাদী ব্রিটিশ ঐতিহাসিক এরিক হবসবম-এর পর্যবেক্ষণ আর উপলব্ধি হল, মানুষ ইতিহাস থেকে কম শিক্ষা নেয়।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct