‘সন্ত্রাসবাদীদের বোনকে দিয়েই জঙ্গিদের শিক্ষা দিয়েছেন মোদি....।’ ভারতীয় সেনাবাহিনীর গ্লোরিয়াস অফিসার কর্নেল সোফিয়া কুরেশিকে নিয়ে এমন জঘন্যতম মন্তব্য করেছেন মধ্যপ্রদেশের মন্ত্রী কুনওয়ার বিজয় শাহ। বিশেষ কোনও ধর্মীয় দৃষ্টি কোণ থেকে এই রকম একজন উচ্চ পদস্থ গৌরবাজ্জ্বল সেনা আধিকারিককে এভাবে সন্ত্রাসবাদীদের বোন বলে শুধু কর্নেল কুরেশিকে অসম্মান করার মতো ক্ষমার অযোগ্য অপরাধই নয়- চরম দেশ বিরোধী এবং দেশের ঐক্য বিনষ্টকারী অপরাধ। লিখেছেন সনাতন পাল।
‘সন্ত্রাসবাদীদের বোনকে দিয়েই জঙ্গিদের শিক্ষা দিয়েছেন মোদি....।’ ভারতীয় সেনাবাহিনীর গ্লোরিয়াস অফিসার কর্নেল সোফিয়া কুরেশিকে নিয়ে এমন জঘন্যতম মন্তব্য করেছেন মধ্যপ্রদেশের মন্ত্রী কুনওয়ার বিজয় শাহ। বিশেষ কোনও ধর্মীয় দৃষ্টি কোণ থেকে এই রকম একজন উচ্চ পদস্থ গৌরবাজ্জ্বল সেনা আধিকারিককে এভাবে সন্ত্রাসবাদীদের বোন বলে শুধু কর্নেল কুরেশিকে অসম্মান করার মতো ক্ষমার অযোগ্য অপরাধই নয়- চরম দেশ বিরোধী এবং দেশের ঐক্য বিনষ্টকারী অপরাধ। এই ধরণের ব্যক্তিরা ভারতের মতো বৈচিত্রময় ধর্মনিরপেক্ষ দেশের জাতীয় ঐক্য রক্ষার ক্ষেত্রে অন্তত বিপজ্জনক। এধরণের মন্ত্রীকে জাতীয় ঐক্যের রাজদন্ড দ্বারা বুঝিয়ে দিতে হবে, সোফিয়া সন্ত্রাসবাদীদের বোন নয়- সমস্ত ভারতবাসীর বোন এবং দিদি। আমার ধারণা হাজার হাজার বিজেপি কর্মী এবং নেতা ও বিরোধীরা সহ দেশভক্ত আপামর ভারতবাসী আমার এই বক্তব্যকে সমর্থন করবেন।
কর্নেল কুরেশি দুদিন আগেই নিজের জীবনের বাজি রেখে সন্ত্রাস দমনে ‘ অপারেশন সিঁদুর’ কে কার্যকর এবং গৌরবময় ভূমিকা পালন করেছেন তার জন্য কোনও স্বর্ণপদকই যথেষ্ট নয়- যাকে সারাদেশ স্যালুট করছে, আর এই আগাছা জাতীয় কোয়ার্টার সাইজের নেতার জন্য তার কপালে জুটল - সে সন্ত্রাসবাদীদের বোন! ছিঃ ছিঃছিঃ। ত্যাগের প্রতিদান এমন হলে ত্যাগীরা মানসিক ভাবে কতটা বিধ্বস্ত হতে পারে, সেই ধারণা আছে? এমনটা ঘটলে কেউ কি আর জীবনের রিস্ক নিয়ে দেশের জন্য কাজ করতে চাইবেন ?
কিছুদিন ধরে দেখছি, এমন কিছু বিজেপির নেতা- কর্মী আছেন, যারা সমাজে বিভাজন তৈরি করতে নানা রকম প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে চলেছেন। কখনও বিদেশ সচিবকে দেশের গদ্দার বলা, শহীদের স্ত্রী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বললে তার সম্পর্কে সমাজ মাধ্যমে কুৎসা ছড়ানো- হয়েছে। কিন্তু ঐক্য বিনষ্টকারী এই সব উইপোকাদের বিরুদ্ধে প্রশাসন দলীয় রাজনীতির সংকীর্ণতার কারণেই হয়তো কিছু ব্যবস্থা নিতে পারছে না, যেটা নেওয়া খুব জরুরি।
কুনওয়ার বিজয় শাহ বিজেপির টিকিটে ভোট ভিক্ষে করে মানুষের দয়াতে মন্ত্রী হয়েছেন। তাই উনি এখন আর শুধু বিজেপির নেতা নন, ভারতের মতো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের একটা অঙ্গ রাজ্যের মন্ত্রী। তার উপরে যে সাংবিধানিক দায়িত্ব অর্পিত রয়েছে, তার এই উক্তি শোনার পরে মনে হচ্ছে তিনি এই গুরুদায়িত্ব পালনে অক্ষম। প্রথমে তার এই চরম আপত্তিকর মন্তব্যের জন্য ধিক্কার জানাচ্ছি এবং নিন্দা করছি। তার মত একটা অপদার্থ মন্ত্রীকে দেশের প্রতিটা সচেতন এবং সংবেদনশীল নাগরিক ঘৃণা করবেন এটাই স্বাভাবিক। আমরা সবাই জানি যে পাকিস্তানের জঙ্গিরা সকলেই মুসলমান। আবার এটাও কারও অজানা নয় যে মুসলমান মানেই জঙ্গি নয়। অপরদিকে এটাও ঠিক যে, অন্য যে কোনও ধর্মের মানুষই সন্ত্রাসবাদী হতে পারে। অর্থাৎ সন্ত্রাসবাদীদের কোনও ধর্ম হয় না। কর্নেল সোফিয়া কোনও ধর্ম জিজ্ঞেস না করে বিনা দ্বিধায় যে কোনও সন্ত্রাসবাদীকে খতম করার মত ক্ষমতা রাখেন। সেটা তিনি তার কাজের মধ্য দিয়েই প্রমাণ করেছেন, “ ইউ আর প্রাউড অফ মাই সিস্টার”
কর্নেল কুরেশি ভারত মাতার সেই বীর সন্তান যিনি দেশমাতৃকাকে রক্ষা করতে রাতের অন্ধকারে নিজের জীবনকে বাজি রেখে লড়াই করে দেশের শত্রুদের খতম করে জয়কে ছিনিয়ে এনে দেশমাতৃকার চরণে লুটিয়ে দিতে পারেন। “অপারেশন সিঁদুর’ কে কার্যকরী রূপ দিয়েছেন কুরেশির মত সেনারা-কুনওয়ারের মতো বিজেপির নেতা বা কর্মীরা নয়। সেদিন রাতে শহীদ হলে কুরেশির মত সেনারাই শহীদ হতেন- বিজেপির নেতা বা কর্মীরা হতেন না। ভারত- পাকিস্তানের এই যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য সারাদেশ গর্বিত। প্রধানমন্ত্রী থেকে বিদেশমন্ত্রী, বিদেশ সচিব, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা সহ দেশবাসী -সকলেই ভারতীয় সেনার ভূমিকায় প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কারও মুখে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নিয়ে বিদ্বেষের কোনও কথা নেই। ধর্মনিরপেক্ষ একটা রাষ্ট্রে এটাই কাম্য। আমরা গর্বিত যে আমরা ভারতীয়। আমরা গর্বিত যে আমাদের দেশে এমন সেনা বাহিনী আছে।
আর সেখানে একটা অঙ্গরাজ্যের মন্ত্রী- কর্নেল কুরেশির মত দেশভক্ত সেনাকে ধর্মীয় কারণে সন্ত্রাসবাদীদের বোন বলবে! আর আমরা সেটা চুপচাপ মেনে নেব? এটা হতেই পারে না। পহেলগাঁও হত্যাকাণ্ডে জঙ্গিরা ধর্ম দেখে খুন করেছিল শুধুমাত্র একটাই কারণে- যাতে ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লেগে ভারতীয় নিজেরাই নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি করে মরে । কিন্তু সদা জাগ্রত সচেতন ভারতবাসী সেই ষড়যন্ত্র বুঝতে পেরে ভারতীয়দের মধ্যে কোনও বিভাজন হতে দেননি, সম্প্রীতিকে চোখের মণির মত রক্ষা করেছেন। ফলে ভারতের জাতীয় এক্য অটুট আছে। সারাদেশের ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের ফল এই ‘অপারেশন সিঁদুর ‘ এর জয়। মধ্যপ্রদেশের এই মন্ত্রীর মন্তব্য অনুরূপভাবে ভারতের জাতীয় ঐক্য এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিপন্থী। এই পরিস্থিতিতে এধরণের কথা উনি কি উদ্দেশ্যে বলেছেন, সে বিষয়ে উচ্চ পর্যায়ের নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া দরকার। দরকার হলে আইনি প্রক্রিয়া মেনে ওনাকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞেসাবাদে করা দরকার।
কর্নেল সোফিয়া সেনা অফিসার না হয়ে সাধারণ নাগরিক হলেও ঐ ধরণের মন্তব্য কোনও ভারতীয় নাগরিক করতে পারেন না। ঐ মন্ত্রী এমন একটা সময়ে কথাটা বলেছেন যখন ট্রাম্পের দ্বারা ভারতবর্ষের সার্বভৌমত্ব আক্রান্ত, পাশে চিন বদমাইশি শুরু করেছে,ভারতের বিরুদ্ধে একটা ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছ তখন।
আমরা যে রকম পাকিস্তানের আগ্রাসন বরদাস্ত করব না, তেমনি চীন, আমেরিকা সহ অন্য কোনও দেশের আগ্রাসন এবং দাদাগিরি মানব না। আমার ধারণা ট্রাম্পের কাশ্মীর ইস্যুতে নাকগলানো এবং ভারত সরকারের আগে ট্রাম্প নিজে মাতব্বরি করে যুদ্ধ বিরতির কথা ঘোষণা করাতে বিরোধীরা সহ সারাদেশের সচেতন মানুষ যেমন ট্রাম্পের উপরে ক্ষোভে ফুঁসছেন তেমনি ভারত সরকারেরও এটা ভালো লাগেনি। সেই জন্য আন্তর্জাতিক দাদাগিরি চাপের কারণে ভারত সরকার ট্রাম্পকে ধিক্কার জানাতে না পারলেও। কিন্তু কাশ্মীর ইস্যুতে তৃতীয় পক্ষ কারও হস্তক্ষেপ চায় না- এটা বলে ভারত সরকার নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রের কারণে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আগামীতে আমাদের ঐক্যবদ্ধ ভাবে লড়াই করতে হতে পারে। বিশ্বের শক্তিধর দেশ আমেরিকা এবং বিশ্ব ক্ষমতার ভরকেন্দ্রে থাকার জন্য আন্তর্জাতিক বিপদ এড়াতে ভারত সরকার ট্রাম্পের কুশপুত্তলিকা দাহ করতে পারবে না। তখন শাসক- বিরোধী জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ট্রাম্পের কুশপুত্তলিকা দাহ করতে হতে পারে। আবার চীনের বিরুদ্ধেও লড়তে হতে পারে। তাই এই মুহূর্তে আমাদের আরও বেশি করে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ঠিক সেই সময়ে একজন মন্ত্রীর এমন কথা নিশ্চিত রূপে পরিতাপের বিষয়। একটা অংশের বিজেপি কর্মীদেরও এটা বোঝা দরকার যে বিজেপির বিরুদ্ধে বলা মানে দেশের বিরুদ্ধে বলা নয়। মোদিজির সমালোচনা করা মানেও সে ভারত বিরোধী নয়।
কর্নেল কুরেশির দাদু, বাবা সবাই সেনাবাহিনীতে ছিলেন। বাবা দাদু অবসর নিলেও স্বামী এখনও ভারতীয় সেনাবাহিনীতেই রয়েছেন। দেশের প্রতি তাদের একটা পারিবারিক অবদান আছে, এটা আমরা জানি। এবার ঐ মন্ত্রী মশাই বলুন, দেশের প্রতি তার এবং পারিবারের কি অবদান আছে? আমরা এটাও জানি এ বিষয়ে কুনওয়ারের চুপ থাকা ছাড়া উপায় নেই ।
কর্নেল কুরেশির উদ্দেশ্যে মন্ত্রী কুনওয়ার শাহ যে মন্তব্য বক্তব্য করেছেন সেটা বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সমর্থন করবেন না বলেই আমার বিশ্বাস। কিন্তু কুনওয়ারের বিরুদ্ধে কড়া অ্যাকশন না নিলে নিশ্চিত রূপেই বাজপেয়ীর মুচলেখা দেওয়া থেকে আরম্ভ করে কার্গিল যুদ্ধের কফিন কেলেঙ্কারির কথা আলোচনায় চলে আসবে।
একদিকে ঘাড়ের উপরে ট্রাম্প কাকার চাপ অপর দিকে শুল্ক বৃদ্ধির চাপ তার উপরে এসব নোংরামো? ভারতীয় সেনাবাহিনীর সম্মান রক্ষার্থে এবং দেশের জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে কুনওয়ার বিজয় শাহকে মন্ত্রী সভা থেকে সরানো হোক এবং তার বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া শুরু করা হোক। এমন শিক্ষা দেওয়া হোক যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ এধরণের কথা বলার আগে দশবার ভাবেন। এই লেখাটা পড়ে অনুগ্রহ করে আমাকে কোনও রাজনৈতিক দলের তকমা সেঁটে দেবেন না। কোনও রাজনৈতিক অভিসন্ধি থেকে এ লেখা নয়। দেশের স্বার্থে, ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের স্বার্থে, সেনাবাহিনীর মর্যদা রক্ষার্থে অন্য যে কোনও ধর্মের মা বোনকে যেন কারও দ্বারা অন্যায় ভাবে অপমানিত হতে না হয় সেই জন্যই এই লেখাটা লিখলাম। এক্ষেত্রে কর্নেল কুরেশি না হয়ে অন্য যে কোনও ধর্মের মানুষের সাথে এমনটা হলে ঠিক এই লেখাটাই লিখতাম।
*** মতামত লেখকের নিজস্ব
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct