সঞ্জীব মল্লিক, বাঁকুড়া, আপনজন: বিপত্তারিণী আসলে দেবী দুর্গারই আর এক রূপ। শাস্ত্র মতে, দুর্গার ১০৮টি অবতারের মধ্যে অন্যতম হলেন দেবী সঙ্কটনাশিনী। তাঁর একটি রূপ হলেন মা বিপত্তারিণী। প্রতি বছর আষাঢ় মাসে রথযাত্রা থেকে উল্টোরথের মধ্যে যে মঙ্গল ও শনিবার পড়ে, তাতেই এই ব্রত পালিত হয়। সমস্ত রকমের বাধা, বিপত্তি ও বিপদ থেকে সন্তান এবং পরিবারকে রক্ষা করার জন্য এই পুজো করা হয়।রথযাত্রার পরের মঙ্গল ও শনিবার মা বিপত্তারিণীর পুজো করে থাকেন ভক্তগণেরা। স্বামী, সন্তান এবং সমগ্র পরিবারের মঙ্গল কামনায় বিবাহিত মেয়েরা এই পুজো করে থাকেন।পূজায় ১৩ সংখ্যাটির একটি বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। এই পূজায়সুতো বাঁধার প্রথা রয়েছে,যা ১৩টি গাট থেকে প্রস্তুত করা হয়। মহিলারা উপোস রেখে এটি প্রস্তুত করে। বিশ্বাস করা হয় যে এই সুতো বেঁধে রাখলে স্বামী-সন্তানের উপর আসা সমস্ত বিপদ দূর হয়।বিশ্বাস করা হয় যে, এই তাগা হাতে পরলে তাঁকে কোনও বিপদ স্পর্শ করতে পরে না। পুজোর শেষে সকলেই হাতে ওই তাগা বেঁধে দেওয়া হয়। মেয়েরা বাম হাতে ও ছেলেরা ডান হাতে এটি পরেন। এটি শুধু ব্রত পালন যিনি করছেন তিনিই যে বাঁধেন তা নয় পরিবারের অন্য সদস্যরাও বাঁধেন বিপন্মুক্তির জন্য। বিশ্বাস করা হয় যে সংসার ও সন্তানদের জন্য এই ব্রত পালন করেন তারা৷ এই ব্রতর ফলে কেটে যায় সমস্ত বিপদ।প্রসাদ হিসেবে ১৩টি লুচি ও ১৩ রকমের ফল খাওয়ার চল রয়েছে।বিপত্তারিণী পুজোয় ১৩ সংখ্যার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। স্বামী ও সন্তানের রক্ষার্থে ১৩টি গিঁট দেওয়া লাল সুতো যা রক্ষা সুতো নামে পরিচিত, তা হাতে বেধে দিতে হয়। তাতে ১৩টি দুর্বাও দেওয়া থাকে।ভট্টাচার্য্য পরিবারের সকলের এক সময় আদিবাড়ি ছিল ওন্দা থানার অন্তর্গত রঘুনাথনগরে। তখন থেকেই মাটির একচালা ঘরে আজ থেকে প্রায় ২৫০ বছর আগে ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ ১১৮০ বঙ্গাব্দে ভট্টাচার্য্য পরিবারের আদিপুরুষ স্বর্গীয় রমেশ ভট্টাচার্য্য , স্বর্গীয় বিজয় ভট্টাচার্য্য,স্বর্গীয় কেদারনাথ ভট্টাচার্য্য এবং স্বর্গীয় গোষ্ঠ ভট্টাচার্য্য এর তত্ত্বাবধানে মা বিপত্তারিণী-র পুজো শুরু করেন ভট্টাচার্য পরিবারের ব্যক্তিবর্গরা। সেই সময় সংসারে অভাব অনটন থাকায় শুধুমাত্র ঘট পুজোর প্রথা প্রচলিত ছিল।প্রথম থেকেই ভট্টাচার্য্য পরিবার বিশেষ শাস্ত্রীয় পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। পুজো অর্চনার পান্ডিত্যের জন্য বর্তমানে আজও পুরোহিত হিসেবে ওন্দা অঞ্চলে খুব সুখ্যাতি আছে। পুজো অর্চনায় ছিল তাদের একমাত্র প্রধান জীবিকা। শোনা যায়,ভট্টাচার্য্য পরিবারের আদি এক সদস্যের কঠিন ব্যাধি হলে বিভিন্ন প্রান্তের কবিরাজি চিকিৎসকদের দেখালেও সেই ব্যাধি থেকে কিছুতেই মুক্তি পাচ্ছিলেন না। সেই সময় দেবী বিপত্তারিণী স্বয়ং ভট্টাচার্য্য পরিবারের আদিপুরুষ কোন এক সদস্য কে স্বপ্নে সেই কঠিন ব্যাধির ওষুধ বলে দেন। ঠিক তখন থেকেই মাটির একচালা কুড়েঘরে মা বিপত্তারিণীর পুজো প্রথম শুরু করেন।কথিত আছে, গোগড়া গ্রামের চক্রবর্তী জমিদাররা দেবত্ব পূজা অর্চনার জন্য ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ ১২৭৫ বঙ্গাব্দে রঘুনাথনগর থেকে গোগড়া গ্রামে ভট্টাচার্য্য পরিবারদের নিয়ে আসেন। কারন গোগড়া গ্রামে তখন বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করলেও কুলো পুরোহিত ব্রাহ্মণ সেকালে ছিল না। ভট্টাচার্য্য পরিবারকে গোগড়া গ্রামে নিয়ে আসার পর চক্রবর্তী জমিদারেরা কিছু ভূ- সম্পত্তি প্রদান করেন। এবং বাড়ির ও দেবত্ব মন্দিরের পুজো অর্চনার কাজে নিযুক্ত করেন। তখন থেকে ভট্টাচার্য্য পরিবার আজও বর্তমানে গোগড়া গ্রামে বসবাস করছেন। গোগড়া গ্রামে আসার পর স্বর্গীয় সুকুমার ভট্টাচার্য্য,স্বর্গীয় কানাইলাল ভট্টাচার্য্য,স্বর্গীয় রামকিঙ্কর ভট্টাচার্য্য, স্বর্গীয় সুধাংশু ভট্টাচার্য্য ও স্বর্গীয় কৃষ্ণদাস ভট্টাচার্য্য রা গোগড়া গ্রামে মা বিপত্তাতারিনীর পুজো শুরু করেন।
বর্তমানে প্রতি বছর ভট্টাচার্য্য পরিবারের বংশধর প্রবীর ভট্টাচার্য্য মহাশয় এর দ্বারা সাড়ম্বরে গোগড়া গ্রামের বাড়িতে মা বিপত্তারিণী-র পুজো করছেন নিয়ম-নিষ্ঠা মেনে। এই বছর মা বিপত্তারিণীর পুজো গোগড়া গ্রামে ১৫৫ বছর অতিক্রম করল। এই পুজো দেখতে গোগড়া ছাড়াও ওন্দা গ্রামের বিভিন্ন প্রান্তে ভক্তবৃন্দরা ছুটে আসেন পুজো দেখতে। মা বিপত্তারিণীর কাছে কেউ যদি মনস্কামনা করেন তা ফলস্বরূপ সকলের মনবাঞ্ছনা পূরণ করেন। মা বিপত্তারিণী পুজোর উপলক্ষে ভট্টাচার্য্য বাড়িতে এদিন মায়ের অন্য ভোগের আয়োজন করা হয়। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে বাড়িতে অরন্ধন পালিত হচ্ছে। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের রান্না হচ্ছে এক হাঁড়িতে। তাই গোগড়া গ্রাম সহ এদিন গ্রামের আশেপাশে প্রতিটি প্রান্তের জনসাধারণ মানুষ এই সম্মিলিত উৎসবে সামিল হয়েছেন।এছাড়াও গোগড়া গ্রামের ভট্টাচার্য্য পরিবার এক ঐশ্বরিক শক্তির অধিকারী, কথিত আছে ভট্টাচার্য্য পরিবারের কুলো দেবতা শ্রীরাম চন্দ্র ও হনুমান রয়েছে। ঠাকুরের স্বপ্নাদেশ আছে যে বাচ্চাদের এক প্রকার ব্যাধি রয়েছে যেটা নাকি বাচ্চাদের হাত-পা শুরু হয়ে যায় পেট বড় হয়ে যায়। এরকম ব্যাধির প্রতিকারে উপায় ‘ধন্বন্তরীর ওষুধ’ ভট্টাচার্য্য পরিবারের এক পূর্বপুরুষ স্বপ্নাদেশে পান। স্বপ্নাদেশে পাওয়া ওষুধ এই রোগের জন্য দেয়া হয়। বাঁকুড়া জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে দূর দূরান্ত থেকে মানুষ এই ব্যাধির প্রতিকারের জন্য ছুটে আসেন। এবং সকলেই ভালো হয়ে বাড়ি ফিরে যান। বর্তমানে এই ধন্বন্তরীর ‘ওষুধ’ দিয়ে আসছেন ভারতী ভট্টাচার্য্য, ছায়া ভট্টাচার্য্য, পূর্ণিমা ভট্টাচার্য্য। কূলদেবতা বজরংবলী ও রঘুনাথ জি-র মূর্তি গুলি ওন্দার কৃষি জমিতে চাষ দেওয়ার সময় নাগলের ফলাতে উঠেছিল। সেখান থেকে নিয়ে এসে বাড়িতে স্থাপন করা হয়। ভট্টাচার্য্য বাড়ির বিপত্তারিণী পুজো যে বহু প্রাচীন তা বলার কোনো অপেক্ষা রাখে না
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct