ভারতের রেল বিশ্বের বৃহত্তম ও ব্যস্ততম রেল। ভারতের অন্যতম যোগাযোগের মাধ্যম হল রেল। ভারতের আপামর জনসাধারণের অধিকাংশই ট্রেনে যাত্রা করে থাকেন। দীর্ঘ কাল ধরে ভারতীয়দের জনজীবনে রেল একটি জনপ্রিয় পরিবহনের মাধ্যম। কিন্তু রেলের নিরাপত্তা নিয়ে একটি বড় আতঙ্ক সকলের মাঝে রয়ে যায়। ইতিহাস বলছে স্বাধীনোত্তর ভারতের যে সকল ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনা হয়েছে তার অনেকগুলোর ক্ষেত্রেই অভিযোগ উঠেছে রেলের গাফিলতির। লিখেছেন এম ওয়াহেদুর রহমান।
ভারতের রেল বিশ্বের বৃহত্তম ও ব্যস্ততম রেল। ভারতের অন্যতম যোগাযোগের মাধ্যম হল রেল। ভারতের আপামর জনসাধারণের অধিকাংশই ট্রেনে যাত্রা করে থাকেন। দীর্ঘ কাল ধরে ভারতীয়দের জনজীবনে রেল একটি জনপ্রিয় পরিবহনের মাধ্যম। কিন্তু রেলের নিরাপত্তা নিয়ে একটি বড় আতঙ্ক সকলের মাঝে রয়ে যায়। ইতিহাস বলছে স্বাধীনোত্তর ভারতের যে সকল ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনা হয়েছে তার অনেক গুলোর ক্ষেত্রেই অভিযোগ উঠেছে রেলের গাফিলতির। তাই রেলের পরিষেবা ঘিরে ক্রমশঃ বাড়ছে উদ্বেগ। ১৯৫৬ সালের ২৭ নভেম্বর তামিলনাড়ুর আরিয়ালুরে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় ১৪২ জনের মৃত্যু হয়। ১৯৬৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর তামিলনাড়ুতে রামেশ্বরম ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে পাম্বান- ধানুস্কোদি যাত্রীবাহী ট্রেন। এতে প্রাণ হারান ১২৬ জন। ১৯৮১ সালের ৬ জুন বিহারের বাগমতি সেতু পার হওয়ার সময় একটি ট্রেন নদীতে পড়ে যায়, ফলে ৭৫০ মানুষের প্রাণ যায়। ১৯৮৮ সালের ১৮ এপ্রিল উত্তর প্রদেশের ললিত পুরে লাইনচ্যুত হয় কর্ণাটক এক্সপ্রেস , মৃত্যু হয় ৭৫ জনের। ১৯৯৫ সালের ২০ আগস্ট উত্তর প্রদেশের ফিরোজাবাদের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা কালিন্দি এক্সপ্রেস ট্রেনকে ধাক্কা দেয় পুরুষোত্তম এক্সপ্রেস ট্রেন। এ দুর্ঘটনায় ৪০০ জনের প্রাণহানী হয়।
১৯৯৭ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর মধ্যপ্রদেশের বিলাসপুরে নদীতে পড়ে যায় আমদাবাদ - হাওড়া এক্সপ্রেস পাঁচটি বগি। মৃত্যু হয় ৮১ জনের। ১৯৯৮ সালের ২৬ নভেম্বর পাঞ্জাবের খান্না গোল্ডেন টেম্পল মেইল ট্রেনের তিনটি বগি লাইনচ্যুত হয়। এ অবস্থায় পেছন থেকে এসে ট্রেন টিকে ধাক্কা দেয় জন্মু - তাবি শিয়ালদহ এক্সপ্রেস ট্রেন। এতে নিহত হয় ২১২ জন। ১৯৯৯ সালের ২ রা আগস্ট পশ্চিম বঙ্গের উত্তর দিনাজপুরের গাইসালে অবধ আসাম এক্সপ্রেস ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকা ব্রম্মপুত্র মেইল ট্রেনে সজরে ধাক্কা দেয়। এতে ২৮৫ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারান। ২০০২ সালের ৯ সেপ্টেম্বর বিহারের রফিগঞ্জে ধাবে নদীর সেতুর উপর রাজধানী এক্সপ্রেস ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। এতে ১৪০ জনের ও বেশি নিহত হন। ২০১০ সালের ২৮ মে পশ্চিম বঙ্গের ঝাড়গ্ৰামে মুম্বাই গামী জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস ট্রেনের সঙ্গে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি পণ্যবাহী ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে নিহত হন ১৪৮ জন। ২০১৬ সালের ২০ নভেম্বর উত্তর প্রদেশের পুখরায়ানে ইন্দোর - রাজেন্দ্র নগর এক্সপ্রেস ট্রেনের ১৪ টি বগি লাইনচ্যুত হয়। এতে প্রাণ হারান ১৫২ জন। ২০১৮ সালের ১৯ অক্টোবর অমৃতসরে একদল মানুষ রেল লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল, হঠাৎই ট্রেন তাদের পিষে চলে যায়। তবে ভারতের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া সকল ট্রেন দুর্ঘটনাকে প্রায় ছাপিয়ে গেছে ২০২৩ সালের ২ জুন শুক্রবার সন্ধ্যা সাত টার সময় ওড়িশার বালেশ্বর জেলার বাহানগর বাজার রেল স্টেশনের নিকটে চেন্নাই গামী করমন্ডল এক্সপ্রেস, যশবন্তপুর হামসফর এক্সপ্রেস সহ পণ্যবাহী, একই সঙ্গে তিনটি ট্রেনের দুর্ঘটনা। এই দুর্ঘটনা ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা বিধ্বংসী - প্রাণঘাতী ট্রেন দুর্ঘটনা। এই দুর্ঘটনার ফলে মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে মানুষের মৃত্যু মিছিল , ট্রেনের বগি গুলো যেমন ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে তেমনি পড়ে রয়েছে রক্তাত নিথর দেহ গুলো। মানুষ শুনেছে বগি গুলোর নিচে চাপা পড়া মানুষগুলোর অস্ফুট গোঙানী, কখনো বা শুনেছে হাসপাতালের মর্গে বেঁচে উঠা মানুষের বাঁচার আওয়াজ কিংবা জলের জন্যে আহাজারি। এই দুর্ঘটনায় মৃত্যু মিছিলে সামিল হয়েছে তিন শতাধিক মানুষ। ১৯৭৭ সালে ভারতের রেল এই করমন্ডল নামক দ্রুতগামী এক্সপ্রেস ট্রেনটি চালু করেন। ইতিপূর্বে এই করমন্ডল এক্সপ্রেস ট্রেন টি দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে। ২০০৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ৭.৩০ নাগাদ দ্রুত গতিতে জয়পুর রোড স্টেশন পেরোনোর সময় দুর্ঘটনার কবলে পড়ে করমন্ডল এক্সপ্রেস। লাইনচ্যুত হয়ে দু দিকে ছড়িয়ে পড়ে একাধিক কামরা। প্রাণ হারান ১১৬ জন। ২০০২ সালের ১৫ মার্চ অন্ধ্রপ্রদেশের নেল্লোরে লাইনচ্যুত হয় করমন্ডল এক্সপ্রেস। অগ্নিকাণ্ডের জেরে দুটি বগি ব্যাপক ক্ষতিগ্ৰস্ত হয়। স্বাধীনোত্তর ভারতের রেল দুর্ঘটনা গুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয়তো গাফিলতির কারণে কিংবা সিগন্যালিং এর কারণে ঘটেছে। তবে এই দুর্ঘটনা গুলোর জন্যে যেমন অনেকটাই দায়ী গাফিলতি বা সিগন্যালিং সমস্যা তেমনি হয়তো দায়ী অপ্রতুল কর্মী সংখ্যা , লোকোপাইলটদের অতিরিক্ত কর্ম সময় ও পরিকাঠামো গত সমস্যা। বিগত কয়েক বছরে ভারতীয় রেলে একাধিক নতুন পরিষেবা ও প্রযুক্তি চালু করা হলে ও তা এখনো পর্যন্ত গোটা রেলপথে স্থাপন করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। যার মধ্যে অন্যতম দুটি প্রযুক্তি হলো ‘ কবচ ‘ এবং ‘ অটোমেটিক রেল ফ্র্যাকচার ডিটেকশন সুইস টেকনোলজি ‘। কবচ এখনো পর্যন্ত হাতে গোনা কয়েকটি লাইনেই কেবলমাত্র চালু রয়েছে। এই সিস্টেম,যা একই লাইনে দুটি ট্রেন চলে এলে সতর্ক করে লোকোপাইলটদের। পাশাপাশি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে কমাতে থাকে দুটি রেল ইঞ্জিনের গতি। ২ জুনের দুর্ঘটনাগ্ৰস্ত দুটি ট্রেনেই এই প্রযুক্তি ছিল না। তাছাড়া সুইস টেকনোলজি ও বর্তমানে বিদ্যমান কেবলমাত্র কঙ্কন - গোয়া রেলওয়ে লাইনে, যা স্বয়ংক্রিয় ভাবে চিহ্নিত করে রেল লাইনে ফাটল দেখা দিয়েছে কিনা। বর্তমানে এই প্রযুক্তির প্রয়োজন পড়েছে গোটা দেশ জুড়েই। ফলে সার্বিক ভাবে দেখতে গেলে দেখা যায়, বাহ্যিক দিক থেকে চমকপ্রদ হয়ে উঠলেও , জনমানসে প্রশ্ন উঠছে ভারতীয় রেলের সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct