গাজা যুদ্ধ শেষ হবে কবে তার কোনো আভাস দিগন্তরেখায় এখনো দেখা যাচ্ছে না। সাত মাসের এই যুদ্ধে হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে। ব্যাপক গণহত্যার অভিযোগের মুখে পড়েছে ইসরায়েল। সাত মাসে ইসরায়েল এখন ক্ষতবিক্ষত একটা সমাজে পরিণত হয়েছে। ইতিহাসের যে কোনো সময়ের চেয়ে ইসরায়েলিরা এখন আরও বিখণ্ডিত ও বিভক্ত। এ বিষয়টি এবারে ইসরায়েলের গ্রীষ্মকালীন পার্বণের সময় আরও স্পষ্ট হয়ে গেছে। মৃত সৈন্যদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ইসরায়েলিরা প্রতিবছর মেমোরিয়াল ডে পালন করেন। এ বছর ১৩ মে মেমোরিয়াল ডের ৭৬তম বার্ষিকী পালন করেন তাঁরা। এই উদ্যাপন প্রতীকীভাবে খুবই শক্তিশালী অর্থ বহন করে। জায়নবাদী জাতীয় বয়ানের প্রতি ইহুদি ও ইসরায়েলি আনুগত্য ঐক্যবদ্ধভাবে প্রকাশের প্রতীক এটি।কিন্তু এই বছরের উদ্যাপনের সময় ঐক্যের কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই ফাটলটা আরও গভীরভাবে বেরিয়ে আসে ১৪ মে ইসরায়েলের স্বাধীনতা দিবসের দিন। ইসরায়েলের টেলিভিশন চ্যানেল–১২–এর খবরে সেই বিভাজিত চিত্র দেখা গেছে। একদিকে সরকারি উদ্যাগে আলোক প্রজ্বালন অনুষ্ঠান। সেখানে একজনও দর্শক নেই। যেন একজন স্বৈরশাসককে আলোকিত করতে সর্বোচ্চ আয়োজন। অন্যদিকে আমরা দেখলাম, ৭ অক্টোবর হামাসের হাতে বন্দী ইসরায়েলিদের পরিবারগুলোর প্রতিবাদ। প্রিয় স্বজনদের ফিরে পাওয়া যাবে কি না, সেই অনিশ্চয়তা থেকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মরিয়া প্রতিরোধের এক দৃষ্টান্ত।এই স্বাধীনতা দিবসটি নিজেই ভিন্ন অর্থ নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। ফিলিস্তিন ও ইহুদি আন্দোলনকর্মীরা একসঙ্গে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। ১৯৪৮ সালের বিপর্যয়ের স্মরণে ফিলিস্তিনিরা এ দিনে নাকবা দিবস পালন করেন। এবারে ছিল নাকবার ৭৬তম বার্ষিকী। এ উপলক্ষে আয়োজিত প্রত্যাবর্তন শোভাযাত্রায় ফিলিস্তিনিদের পাশাপাশি ইহুদি আন্দোলনকর্মীরা অংশ নেন।একই সময়ে ইসরায়েলের দেরথ শহরে হাজার হাজার ইহুদি গাজায় ইহুদি বসতি স্থাপনের দাবিতে ‘গাজা চলো’ মিছিলে অংশ নেয়। গাজার ধ্বংসযজ্ঞ তাদের মনে আনন্দ জাগিয়েছে, আর তারা পরিকল্পনা আঁটছে সেখানে কীভাবে বসতি স্থাপন করা যাবে।
ন্যায়ের জন্য লড়াই
এবারের নাকবা দিবসে ফিলিস্তিনিরা যে প্রত্যাবর্তন মিছিল করেন, সেটির দৈর্ঘ৵ কয়েক শ মিটার হয়েছিল। আগের বছরগুলোর তুলনায় সেটি হয়তো ছোট ছিল। যাহোক, অপেক্ষাকৃত ছোট মিছিল হওয়া সত্ত্বেও গর্বিত ফিলিস্তিনি আত্মপরিচয়ের শক্তিশালী প্রকাশের জন্য এটি যথেষ্ট। মিছিলটি ছিল অনেক বেশি বর্তমানের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক। এই মিছিলে এমন একটি দেশে থেকে ন্যায়বিচারের স্থায়ী দাবি তোলা হয়েছে, যেখানে ন্যায়বিচারই অনুপস্থিত।তারা ন্যায়বিচারের দাবি জানিয়েছেন ঘরবাড়িহারা মানুষের জন্য, তারা ন্যায়বিচারের দাবি জানিয়েছেন গাজার জন্য, তারা ন্যায়বিচারের দাবি জানিয়েছেন রাজনৈতিক বন্দীদের জন্য। এই মিছিল ছিল বিস্মৃতির বিপক্ষে ন্যায়বিচার ও লড়াইয়ের প্রতীক।এই মিছিলে ছোট্ট শিশুদের কাঁধে নিয়ে তার বাবারা এসেছিলেন। একবার ভেবে দেখুন তো এর প্রভাব কতটা বিস্তৃত হতে পারে?দেরথে ডানপন্থীদের আয়োজিত মিছিলেও শিশুদের দেখা গেছে। মিছিলের ব্যানারে লেখা ছিল, ‘গাজার পথে স্বাধীনতার মিছিল’। মিছিলে অংশ নেওয়া বাবারা কি তাঁদের শিশুদের কাছে ব্যাখ্যা করে বলেছেন, ইহুদি তরুণেরা কীভাবে গাজার অভুক্ত শিশুদের জীবন বাঁচানোর জন্য পাঠানো ত্রাণের বহর ধ্বংস করেছেন?নাকবা দিবসে ফিলিস্তিনি শিশুরা শেফারমের (উত্তর ইসরায়েলে অবস্থিত আরব শহর) কাছে বইয়ের দোকানগুলোতে জড়ো হয়েছিল নিজেদের ইতিহাস জানার জন্য। আর দেরথে ইসরায়েলি শিশুরা তাদের পরিবারের সঙ্গে গাজায় বিস্ফোরণের শব্দের তালে তালে মিছিলে শামিল হয়েছিল। বলতে পারেন, এই শিশুরা কী শিখল?ফিলিস্তিনি শিশুরা দেখল যে তাদের প্রতিবাদ মিছিলে ইহুদি আন্দোলনকর্মীরা এসে সংহতি জানালেন। তাদেরকে প্রশংসা আর সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করা হলো। দেরথের ইহুদি শিশুরা কী শিখল? তারা শিখল ফিলিস্তিনিদের বিপর্যয় উদ্যাপন করতে এসেছে তাদের পরিবার।
ফ্যাসিবাদের পরিধি বাড়ছে
এক প্রজন্ম পরে এই ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি শিশুরা প্রাপ্তবয়স্ক হবে। নাগরিক অধিকারগুলো ভোগ করার মতো বড় হবে তারা। কিন্তু সেই নাগরিক অধিকার ক্রমেই সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলে।জাতীয়তাবাদী চিন্তার সঙ্গে ও বৈষম্য বাড়ছে ইসরায়েলে। ফ্যাসিবাদের পরিসর ক্রমে সম্প্রসারিত হচ্ছে। নাগরিকত্বের পূর্ণাঙ্গ মানে কী, তা নিয়ে ইসরায়েলের ইহুদিরা কখনোই মনোযোগ দেননি। কারণ, তাঁরা জাতিগতভাবেই সুরক্ষার অধিকার পান। কিন্তু ৭ অক্টোবর থেকে যা কিছু ঘটে চলেছে, তাতে প্রমাণিত হয়, ইসরায়েলি ইহুদি হিসেবে আমাদের দুর্বল হয়ে আসা নাগরিক মর্যাদা কতটা বিপদের মধ্যে পড়েছে।জিম্মি ইসরায়েলিদের সরকার যেভাবে পরিত্যাগ করেছে, সেটিই এর বড় দৃষ্টান্ত। যখন জাতীয়তাবাদী স্বার্থই মুখ্য, তখন নাগরিকদের একপাশে ঠেলে ফেলা হয় এবং নাগরিক শব্দের মানে খোয়া যায়।
ওরলি নয়, ইসরায়েলের মানবাধিকারকর্মী
মিডলইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct