প্রযুক্তি এখন মানুষের জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। শিশু-কিশোরদের মধ্যেও স্মার্ট ডিভাইসের ব্যবহার বাড়ছে। ‘ডিভাইস আসক্তি’ শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের মানসিক বৃদ্ধির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। বর্তমান প্রজন্ম স্মার্টফোন ও অনলাইন গেমে আসক্ত হয়ে পড়ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে দীর্ঘ সময়ের জন্য মোবাইলে অনলাইন গেম খেললে আসক্তি হতে পারে। এই নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদনটি লিখেছেন নব বালিগঞ্জ মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রিন্স বিশ্বাস...
সোশ্যাল মিডিয়া এবং অনলাইন গেমস সম্পর্কে সঠিক ধারণার অভাবে অভিভাবকরাও তাদের সন্তানদের খোঁজ রাখতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। মাঠে যাওয়া, ধুলো-কাদা, ঘাম, রোজ বিকেলে খেলা শেষে বাড়ি ফেরা- এই দৃশ্য আজকাল যেন হারিয়ে যাচ্ছে। পাড়ায় খেলার জায়গার অভাব, পড়াশোনার চাপ, তথাকথিত বখাটে ছেলেদের সঙ্গে মিশে যাওয়ার ভয়- কত কি অভিযোগ অভিভাবকদের! আর এই সব কারণে অভিভাবকরা অতি সহজে নিজের সন্তানের হাতে স্মার্ট ফোন তুলে দিচ্ছে। তাছাড়া অনেক পরিবারে বাবা-মা দুজনেই চাকরি করেন, দুজনেই ছুটছেন ‘ক্যারিয়ার ও সাফল্য’ নামের সোনার হরিণের পেছনে। এদিকে কাজের মায়ের কাছে বড় হচ্ছে শিশুটি। আবার অনেক অপরিণত মা শিশুকে খাওয়ানোর জন্য, তার কান্না থামাতে টিভি, কম্পিউটার এবং ভিডিও গেম ব্যবহার করছেন। এইভাবে শিশুকাল থেকেই অবিভাবকদের অজান্তে শিশুরা হয়ে উঠছে স্মার্ট ফোনের প্রতি আসক্ত। অন্যদিকে শহরের ইট, পাথর আর কংক্রিটের আড়ালে আটকে আছে শিশুদের রঙিন শৈশব। গ্রামের ছেলেমেয়েরা খেলাধুলার কিছু সুযোগ পেলেও শহরের ছেলেমেয়েরা সুযোগ কম পায়। শহুরে যান্ত্রিকতা শিশুদের, শৈশবেই প্রাপ্তবয়স্কে পরিণত করেছে। ফলে তারা মাউসের বোতাম টিপে কম্পিউটার স্ক্রিনে গেম খেলে, স্মার্টফোনে অনলাইনে গেম খেলে খেলাধুলার আনন্দ খুঁজে পাচ্ছে। অনেক সময় তাদের এই আকর্ষণ নেশার পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে তারা কম্পিউটার-মোবাইল-ট্যাব গেমের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। সেজন্য প্রথমেই বলা যায়, ভিডিও গেম আমাদের শিশু-কিশোরদের প্রকৃত শৈশব ও কৈশোর কেড়ে নিচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ৮ থেকে ২০ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ইন্টারনেটে ডুবে থাকার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের, একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে ১৩-১৭ বছর বয়সী শিশুদের অর্ধেকেরও বেশি ভিডিও গেম, কম্পিউটার, ই-রিডার, স্মার্টফোনে ফোন এবং অন্যান্য স্ক্রিন-ভিত্তিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সপ্তাহে ৩০ ঘন্টার বেশি সময় ব্যয় করে। সময়ের সঙ্গে তালমিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গের শিশু-কিশোরদের মধ্যেও প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে। সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখাগেছে পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে বৃহত্তম ফেসবুক ব্যবহারকারী হিসেবে কলকাতা শহরের নাম উঠে এসেসে। শুধু কলকাতা শহর নয় ফেসবুকে আক্রান্ত গ্রাম ও মফসলের শিশু কিশোর থেকে বয়স্করা । আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের আট বছর বয়সী শিশুরাও ফেসবুক ব্যবহার করছে। উইকিপিডিয়া অনুসারে, ভিডিও গেমগুলি ১৯৪০ এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি হয়েছিল। এরপর সত্তর ও আশির দশকে এটি জনপ্রিয়তা পায়। প্রথম বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত আর্কেড-টাইপ ভিডিও গেমটির নাম ছিল ‘কম্পিউটার স্পেস’। এরপর আটারি কোম্পানি বাজারে নিয়ে আসে বিখ্যাত খেলা ‘পং’। তারপর ধীরে ধীরে আটারি, কোলেকো, নিনটেনডো, সেগা ও সনির মতো ব্যবসায়ী কোম্পানিগুলো নানা উদ্ভাবন ও প্রচারণা চালিয়ে কয়েক দশকের মধ্যে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে মানুষের ঘরে পোঁছে দেয় পুঁজিবাদী সভ্যতার এ বিনোদনপণ্য। ২০০০ সালে Sony Company সমীক্ষা করে দেখেছিল যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি চারটি বাড়ির একটিতে একটি করে সনি প্লে স্টেশন আছে। ২০০৯ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, শতকরা ৬৮ ভাগ আমেরিকানের বাড়ির সব সদস্যই ভিডিও গেম খেলে। তারপর সময় বদলেছে। কম্পিউটার এবং ভিডিও গেমস ক্রমান্বয়ে হয়ে উঠেছে বিশ্বের অন্যতম লাভজনক ও দ্রুত বর্ধনশীল শিল্প ইন্ড্রাস্ট্রি। বিশ্বজুড়ে আজ মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে ভিডিও গেম এবং গেমাররা। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা অনুযায়ী সারা পৃথিবীতে প্রায় ২২০ কোটি মানুষ নিয়মিত বা অনিয়মিতভাবে ভিডিও গেম খেলে থাকে। যাদের অধিকাংশই হচ্ছে অল্প বয়সী শিশু-কিশোর ও তরুণ-তরুণী। এদের বদৌলতে গ্লোবাল ভিডিও গেম বাজারের আর্থিক মূল্য দাঁড়িয়েছে ১০৮.৯০ মিলিয়ন ডলার! এর মধ্যে ‘মোবাইল গেমিং’ই হচ্ছে সবচে বেশি পয়সা আয় করা সেক্টর। দেখাযাচ্ছে স্মার্টফোন ও ট্যাবলেটে গেমিং প্রতি বছর ১৯ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কী থাকে এসব ভিডিও গেমসে?
প্রশ্ন হচ্ছে, কী থাকে এসব ভিডিও গেমসে? কেন তাতে এত আসক্তি? খোঁজ করলে জানা যায়, জনপ্রিয় গেমগুলোর মধ্যে কিছু আছে ক্রিকেট ফুটবলের মতো। নানা রকম দল তৈরি করে এসব খেলা খেলতে হয়। খেলায় হারজিত হয়। এক ম্যাচ খেললে আরেক ম্যাচ খেলতে ইচ্ছে করে। এর কোনও শেষ নেই। আর এক ধরনের রয়েছে ফাইটিং গেম। ফাইটিং গেম হলো এক ধরনের ভিডিও গেম জেনার। এই ধরনের গেমে যুদ্ধ ভাব দেখা যায়। এখানে কিছু সংখ্যক চরিত্র থাকে এবং তাদের মধ্যে যুদ্ধটা হয়। এই চরিত্রগুলি একে অপরের সাথে লড়াই করতে থাকে যতক্ষণ না তারা তাদের বিরোধী পক্ষকে পরাজিত করতে পারে বা যতক্ষণ না তার বা তাদের খেলার সময় শেষ হয়। প্রতিটি চরিত্রের বিভিন্ন ক্ষমতা থাকে । এখানে বিজয়ী হতে চাইলে খেলোয়াড়দের অবশ্যই পাল্টা আক্রমণ করার দক্ষতা ও কৌশল অর্জন করতে হয়। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে, বেশিরভাগ ফাইটিং গেম খেলোয়াড়কে নির্দিষ্ট ইনপুট সংমিশ্রণ সম্পাদন করে বিশেষ আক্রমণ চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। গেম ফাইটিং এর প্রথম লড়াইটি ছিল ১৯৭৬ সালে ‘হেভিওয়েট চ্যাম্প’ নামক গেমে। গেম খেলার সময় ছেলে মেয়েদেরকে মোবাইল / কম্পিউটারের সামনে থেকে টেনে তোলা যায় না। এতে তদের চট করে এক ঘেয়েমিও আসে না। পড়াশুনা শিকেয় তুলে ছেলে মেয়েরা একটার পর একটা ম্যাচ খেলে যায়। আবার অনেক সময় যুবকদের দাবা, তাস, লুডোর মত গেম খেলতে দেখা যায়।
ভিডিও গেমের বিভিন্ন প্রকার:
কিশোর ও যুবকদের কাছে মূলত দুই ধরণের অনলাইন ভিডিও গেমের জনপ্রিয়তা রয়েছে । স্ট্যান্ডার্ড ভিডিও গেমগুলি সাধারণত একজন একক খেলোয়াড়ের দ্বারা খেলার জন্য ডিজাইন করা হয় এবং এতে একটি স্পষ্ট লক্ষ্য বা মিশন জড়িত থাকে, যেমন একজন রাজকুমারীকে উদ্ধার করা। এই গেমগুলির আসক্তি প্রায়শই সেই মিশনটি সম্পূর্ণ করার সাথে বা উচ্চ স্কোর বা প্রিসেট স্ট্যান্ডার্ডকে হারানোর সাথে সম্পর্কিত। অন্য ধরনের ভিডিও গেমের আসক্তি অনলাইন মাল্টিপ্লেয়ার গেমের সাথে যুক্ত। এই গেমগুলি অন্য লোকেদের সাথে অনলাইনে খেলা হয় এবং বিশেষ করে আসক্তি কারণ তাদের সাধারণত কোন শেষ নেই। এই ধরনের আসক্তি সহ গেমাররা একটি অনলাইন চরিত্র তৈরি এবং সাময়িকভাবে হয়ে উঠতে উপভোগ করে। তারা প্রায়ই বাস্তবতা থেকে অব্যাহতি হিসাবে অন্যান্য অনলাইন খেলোয়াড়দের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে। কারও কারও কাছে, এই সম্প্রদায়টি এমন জায়গা হতে পারে যেখানে তারা মনে করে যে, তারা সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য।
ভিডিও গেমের প্রতি আসক্তির কারণ কী?
বিশেষজ্ঞদের মতে ভিডিও গেমস এ আসক্তির, অনেকগুলি কারণ থাকে। ভিডিও গেমগুলি এত আসক্ত হয়ে উঠতে পারে এর প্রধান কারণগুলির মধ্যে “আমাদের ছেলেদের অনেক ভাল ভাল লেখকদের বই কিনে দিই। আমি চাই ওরা বই পড়ে শিখুক। কিন্তু না, তাদের কথা হল, তাদের সব বন্ধুরা গেম খেলছে, তারাও খেলবে।” এই ধরনের অভিযোগ প্রায় সর্বত্র ই অভিভাবক দের দেখা যায়। তাছাড়া যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়া এবং সেইসঙ্গে বাইরে খেলাধুলার পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকায় ভিডিও গেমেই শিশু কিশোরেরা অবসরের আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে। সেই সঙ্গে শহরগুলোয় পর্যাপ্ত বিনোদনের অভাবকেও এই গেমে আসক্তির জন্য দায়ী। আর সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে Smart Phone এর সহজলভ্যতা। ভিডিও গেমের প্রতি শিশুদের আগ্রহ নতুন কিছু নয়। তবে সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এই অবসাদকে মানসিক রোগের তালিকায় স্থান দিয়েছে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে দীর্ঘদিন অনলাইন ভিডিও গেম খেললে শিশু কিশোরদের বুদ্ধি, বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে সেইসঙ্গে সামাজিকীকরণে বাধা হয়ে দাড়ায়। বিষয়টিকে নিয়ে আমেরিকা, ব্রিটেনসহ ইউরোপীয় বেশ কয়েকটি দেশ বিশেষ ক্লিনিক তৈরির পাশাপাশি পর্যাপ্ত মনিটরিং শুরু করলেও এক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে ভারত। Play Station এ সামরিক যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তৈরি করা একটা গেমের প্রায় পুরোটা জুড়েই দেখা যায় যুদ্ধ সহিংসতা আর রক্তপাত। মনোবিদদের মতে “প্রতিনিয়ত এসব ভিডিও গেম খেললে শরীরে এক ধরনের হরমোন নিঃসৃত হয়। এটি শিশু কিশোরদের সবকিছুতেই উত্তেজিত করে তোলে। তারা অচিরেই বাবা-মায়ের অবাধ্য হয়ে পড়ে। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়।” WHO র ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অফ ডিজিজেস রিপোর্ট অনুযায়ী, গেমিং এ আসক্ত মানুষরা মূলত অন্য সব কিছুর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। কারও সঙ্গে মিশতে না পারা ছাড়াও ঘুম, খাওয়া-দাওয়া নিয়েও রয়েছে অনিয়ম।
মোবাইল ভিডিও গেম আসক্তি সমস্যার লক্ষণ কি?
অন্য যেকোনো আসক্তির মতো, ভিডিও গেমে আসক্তির কিছু লক্ষণ রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, গেমিং এ আসক্তির লক্ষণগুলো কমপক্ষে ১২ মাস ধরে থাকলে, সেটিকে আসক্তি বলা হয়। তবে লক্ষণ যদি গুরুতর ধরনের হয়, তবে সেগুলো অল্প দিন ধরে লক্ষণ দেখা দিলেও সেটাকেও গেমিং ডিজঅর্ডার বলা যাবে। কিছু লক্ষণ যেমন ইন্টারনেট ব্যবহার বা গেম খেলা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া। অর্থাৎ ঘন ঘন গেম খেলতে থাকা, অনেক বেশি সময় ধরে মোবাইল ব্যবহার করা এবং এত মনোয়োগ সহকারে মোবাইলে মগ্ন থাকা, যে চারপাশের অনেক কিছু তার মনোযোগের বাইরে চলে যাবে।
১. গেমে আসক্ত শিশুকিশোরদের দিনের শুরুই হবে Smartphone ব্যবহার বা গেম খেলার আকুতি নিয়ে, তীব্র আকাক্ষ্মা থাকবে গেম বা ইন্টারনেটের প্রতি। নতুন কিছুর চেয়ে গেম খেলাকে জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় বলে মনে করবে।
২. গেমে আসক্ত শিশুকিশোরদের প্রতিদিন ই মোবাইলে ভিডিও গেম খেলার সময় বাড়তে থাকবে। যেমন যেখানে আগে সপ্তাহে দুই দিন খেলত, এখন প্রায় প্রতিদিনই খেলবে। আগে হয়ত দিনে ১ ঘণ্টা কাটাত মোবাইলে গেম খেলে, এখন ৬ ঘণ্টা ব্যয় করলেও নিজেকে গেম খেলা থেকে বিরত রাখতে পারবে না।
৩. জীবনের সব আনন্দের উৎস খুজে পাবে মোবাইল গেমের ভিতর। এগুলো ছাড়া সে আর কোনো কিছুতেই আনন্দ পাবে না।
ভিডিও গেম আসক্তির মানসিক লক্ষণ:
ভিডিও গেম আসক্তির কিছু মানসিক লক্ষণ বা উপসর্গের মধ্যে রয়েছে -
৪. যে কাজগুলো শিশুকিশোরদের করার কথা, যেমন: পড়ালেখা, স্কুল, বাড়ির কাজ সবকিছু ব্যাহত হবে। এই ভাবে চলতে, চলতে পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হতে থাকবে। যে কোন কাজের মান কমে যাবে।
৫. মেজাজ সবসময় খিটখিটে থাকবে। মন খারাপ লাগবে বা মনমরা ভাবে থাকবে। আচরণ আগ্রাসী হয়ে উঠবে। দেখা যাবে কোনো কারণে ইন্টারনেট সংযোগ না পেলে বা মোবাইল রিচার্জ শেষ হয়ে গেলে, অস্থির হয়ে পড়বে, অনেক সময় রাগে চিৎকার করবে। এমনকি চিৎকার করে ঘরের আসবাপএ ভাঙচুর করবে। কখনো কখনো পরিবারের সদস্যদের প্রতি মারমুখী হয়ে উঠবে।
৬. ঘুমের সমস্যা দেখা দেবে। দিনে ঘুমাবে আর রাতে জাগবে। সকালে দেরি করে ঘুম থেকে উঠবে।
৭. খাবার খাওয়া অনিয়মিত হয়ে উঠবে। তাড়াতাড়ি খাওয়া যায় এমন খাবার খেতে চাইবে, বাড়ির খাবারের চাইতে ফাস্টফুড বেশি খেতে চাইবে। সময় নিয়ে খাবে না। বাড়ির সবার সঙ্গে একসঙ্গে বসে না খেয়ে নিজের ঘরে বসে খেতে চাইবে।
৮. মিথ্যা কথা বলবে। নিজের ত্রুটিগুলো ঢাকতে তথ্য গোপন করবে। স্কুল ফাঁকি দেবে বা ক্লাসে অমনোযোগী হয়ে পড়বে। কখনো ক্লসে ঝিমুবে।
৯. বাথরুমে বেশি সময় কাটাবে, বাথরুমে মুঠোফোন নিয়ে যাবে।
১০. সামাজিকতা কমে যাবে। কারও সঙ্গে মিশবে না। নিজেকে সবসময় অন্যদের কাছ থেকে গুটিয়ে রাখবে। চারপাশ ভুলে গিয়ে গেমে মগ্ন হয়ে থাকবে।
ভিডিও গেম আসক্তির স্বল্প-মেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব:
অন্য যেকোনো বাধ্যতামূলক অসুকের মতো, মোবাইলে ভিডিও গেমে আসক্তির মারাত্মক নেতিবাচক পরিণতি হতে পারে। যদিও বেশিরভাগ উপসর্গের স্বল্পমেয়াদী প্রভাব রয়েছে, তবে সঠিকভাবে সমাধান না করা গেলে, এগুলির আরও গুরুতর দীর্ঘমেয়াদী প্রতিক্রিয়ার দিকে নিয়ে যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ভিডিও গেমে আসক্ত কেউ গেমিং চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রায়ই সঠিক সময়ে ঘুমানো বা সঠিক সময়ে খাওয়া এড়ানো। যদিও এর স্বল্পমেয়াদী প্রভাবের মধ্যে ক্ষুধা এবং ক্লান্তি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে, এটি অবশেষে ঘুমের ব্যাধি বা খাদ্য-সম্পর্কিত স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে। একইভাবে, যারা ভিডিও গেম খেলার জন্য অন্যদের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন তারা স্বল্পমেয়াদে পারিবারিক ইভেন্ট, বন্ধুদের সাথে বেড়াতে যাওয়া বা অন্যান্য ইভেন্টগুলি মিস করবে। যদি এটি দীর্ঘ সময়ের জন্য একটি প্যাটার্ন হিসাবে চলতে থাকে, তবে, আসক্তরা নিজেদেরকে কোনো বন্ধু ছাড়াই খুঁজে পেতে পারে। ভিডিও গেমের আসক্তির দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবগুলি আর্থিক, একাডেমিক এবং পেশাগত পরিণতিগুলিকে বিবেচনা করতে হবে। ভিডিও গেম এবং ভিডিও গেমের সরঞ্জামগুলি খুব ব্যয়বহুল হতে পারে, বিশেষ করে যখন অনলাইন মাল্টিপ্লেয়ার গেমগুলির জন্য প্রয়োজনীয় উচ্চ-গতির ইন্টারনেট সংযোগের মতো পুনরাবৃত্ত খরচগুলিকে ফ্যাক্টর করা হয়। এই গেমগুলিও খুব সময়সাপেক্ষ হয়, যার ফলে আসক্ত কিশোররা তাদের শিক্ষা বা দৈনন্দিন জীবনে মনোযোগ দেওয়ার জন্য কম সময় পায়।
কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন:
আপনার বাড়ির কেউ যদি মোবাইল গেমিংয়ের প্রতি আসক্ত হয় বা বুঝতে পারেন যে, সে আসক্ত, তাহলে তার খুব তাড়াতাড়ি সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে পরামর্শ নেওয়া দরকার। একজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলার পর চেষ্টা করুন আসক্তির মূল কারণ কী। তাকে সামাজিক সমাবেশে সক্রিয়ভাবে সশরীরে উপস্থিত রাখার চেষ্টা করুন। যদি নিজে গেমে আসক্ত হন, যখনই খেলার জন্য মন চাইবে , তখন নিজেকে সময় দিন, বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে মন খুলে কথা বলুন, শখের সঙ্গে গেম খেলুন। জীবনের অন্যান্য জিনিসের প্রতি ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করুন।
বাবা-মায়েরা কীভাবে বুঝবেন, সন্তান গেমিংয়ে আসক্ত?
যদি আপনার সন্তান পড়াশোনা এবং খেলাধুলা ছাড়া মোবাইলে গেম খেলে বেশি সময় কাটাচ্ছে, তবে সেটি অবশ্যই উদ্বেগের কারণ। তার এই অভ্যাস গুলি বর্তমান ও ভবিষ্যতের জীবনযাত্রার মানকে দারুণভাবে প্রভাবিত করতে পারে। তাই অভিভাবকদের অবশ্যই সন্তানের জীবনের ভারসাম্য বজায় রাখতে ও চারপাশের জিনিসের প্রতি গুরুত্ব দিতে উত্সাহিত করতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে, একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবনযাপনের মধ্যে অল্পসল্প গেম খেলা ঠিক আছে কিন্ত সেটা কখনোই ঘন্টার পর ঘন্টা খেলা উচিত নয়। মোবাইল বা অনলাইন গেমিং ছাড়াও আরও অনেক জিনিস আছে, যেগুলি জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যখন দেখবেন বাড়িতে বিনোদন ও পড়াশোনার জন্য সবকিছু থাকা সত্ত্বেও আপনার সন্তান মোবাইল নিয়ে বুঁদ হয়ে আছে, তখনই বুঝবেন আপনার সন্তানের গেমিং অ্য়াডিকশন হয়েছে।
এই আসক্তি থেকে মুক্তির উপায়:
মোবাইল গেমের সীমিত ব্যবহারে কোনো ক্ষতি নেই। শিশু, কিশোর-কিশোরীদের মোবাইল গেমে আসক্তি থেকে রক্ষার জন্য এবং সঠিক উপায়ে গেমগুলো ব্যবহার করছে কিনা, তা নিশ্চিত করার জন্য কিছু উপায় রয়েছে। সেগুলো হলো—
১. রুটিন তৈরি করা:
বর্তমান বিশ্বে শিশু, কিশোর- মোবাইলে গেম খেলা থেকে বিরত রাখা কঠিন। শিশু, কিশোর- কিশোরীদের অনলাইন গেম খেলার জন্য একটি সময় নির্ধারণ করুন, যাতে সে খেলতে পারে এবং খুশি হয়। তাদের বুঝতে দিন, তারা প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য গেমটি খেলতে পারবে। তারা নিয়ম অনুসরণ করছে কিনা তা জানতে টিসপির (TiSPY)-এর মতো একটি নিয়ন্ত্রণ সফটওয়্যার ব্যবহার করতে পারেন। এটি শিশুর কার্যকলাপ সম্পর্কে জানাতে প্রতিদিন একটি নির্ধারিত সময়ে স্ক্রিনশট ধারণ করে। স্ক্রিনশট নেওয়ার সময় আপনি অনলাইনে না থাকলেও এটি সংরক্ষিত থাকে এবং আপনি যখনই অনলাইনে আসেন, তখনই ছবিটি দেখতে পারেন।
২. সহজলভ্যতা দূর করুন:
শিশু যদি ছোট হয় (৫ বছর পর্যন্ত) তবে কোনো পরিস্থিতিতেই শিশুর হাতে মুঠোফোন বা ভিডিও গেম তুলে দেবেন না। নিজের মধ্যে স্বচ্ছ ধারণা তৈরি করুন, বাড়ির খুব দরকারি জিনিসের মতো মুঠোফোনও একটি অতি প্রয়োজনীয় জিনিস, শিশুর খেলার সামগ্রী নয়। মা-বাবাও যদি মুঠোফোনকে সেভাবে চিহ্নিত করেন, তাহলে শিশুরাও অবশ্যই বুঝবে ব্যাপারটা। শিশু একটু বড় হয়ে গেলে তাদের টিভি বা মুঠোফোনে আসক্তির খারাপ দিকগুলো বোঝান।
৩. শিশুদের একাকিত্ব দূর করুন:
আজকাল বেশির ভাগ পরিবারই অতিব্যস্ত। তাই বন্ধু ও পরিবার-পরিজনহীন বাড়িতে smartphone ই তার কাছে পরম বন্ধুত্বের জায়গা করে নেয়। অনেক সময় মা-বাবা দুজনই চাকরিরত হলে শিশুর দেখাশুনা করার লোক তাকে smartphone দিয়ে বসিয়ে নিজের কাজ সারেন। ফলে শিশুরা আসক্ত হয়ে পড়ে মোবাইলে।
৪. বিশেষ স্থানে ফোন সুরক্ষিত রাখা:
মোবাইল ছাড়া গেমিং সহজ নয়। ফোনটি এমন স্থানে রাখুন, যেখানে শিশু সহজে খুঁজে না পায়। এটি হতে পারে একটি উঁচু শেলফ, আলমারি, রান্নাঘরের ড্রয়ার, স্টোররুম বা শিশুর থেকে দূরে অন্য কোনো জায়গা।
৫. ঘুমের আগে ইলেকট্রনিক ডিভাইস থেকে দূরে রাখুন:
ছোট থেকে শিশুকে খাওয়ানোর সময় বা ঘুমাতে যাওয়ার আগে ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহারের বদ অভ্যাস রাখবেন না। আজকালকার দিনে এটা শুনে আপাত অসম্ভব মনে হলেও কয়েক দিন অভ্যাস করলেই এটা সহজ হয়ে উঠবে। বরং গল্প বলুন, বই পড়ুন বা ধর্মগ্রন্থ পড়ে শোনান। এতে শিশুরা অনেক ধরনের প্রশ্ন করতে শিখবে, নতুন বিষয় সম্পর্কেও জ্ঞান বাড়বে। ঘুমাতে যাওয়ার আগে মন বিক্ষিপ্তও থাকবে না। সবকিছুই সম্ভব হবে যদি মা-বাবা সঠিকভাবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। এর জন্য নিজেদের শিশুর সামনে উত্তম আদর্শ হিসেবে তুলে ধরুন। মনে রাখবেন কম্পিউটার ও মুঠোফোনে গেম খেলা বা টিভি দেখার অভ্যাস মা-বাবার মধ্যে যত নিয়ন্ত্রিত হবে, শিশুরাও ততই উপকৃত হবে। তাই শিশুদের এ ক্ষতিকর আসক্তি হতে ফেরান। আর যুব সমাজকে এর বিকল্প ভালো কিছুর মধ্যে নিয়োজিত রাখার চেষ্টা করুন। যাতে গেম খেলা থেকে নিজে নিজেই বিরত থাকে ও নিজ থেকেই গেমের প্রতি অনাগ্রহী হয়ে।
শেষপাত:
*”পড়াশোনার ফাঁকে অনলাইন গেমে আসক্তি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের কাছে ‘সর্বনাশা’ গেম বন্ধের আবেদন”, *”অনলাইন গেমের আসক্তিতে বাড়ি-ছাড়া ! ১২ মাস পর উত্তরপ্রদেশ থেকে উদ্ধার কালচিনির নাবালিকা”, *”অনলাইন গেমে ৪০,০০০ টাকা খরচ ! মায়ের বকুনি শুনে আত্মঘাতী ছেলে” ,
*”অনলাইন গেমে আসক্তি, বকাবকিতে দাদাকে ‘কুপিয়ে খুন’,
*মা-কেও খুনের চেষ্টার অভিযোগ যুবকের বিরুদ্ধে” আমরা প্রায়ই টিভি বা খবরের কাগজের হেডলাইনে এই ধরনের এই ধরনের খবরগুলি প্রায়ই দেখতে পাই। করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব পড়লেও ভিডিও গেমের বিশ্বে দেখা গেছে উল্টো চিত্র। যেহেতু করোনার সময় সামাজিক দূরত্বের নিয়মগুলি কঠোর করা হয়েছিল, তাই অনলাইন ভিডিও গেমস খেলার চাহিদা বিশ্বব্যাপী বেড়েছে। আর এই সময় থেকেই ভার্চুয়াল জগতে প্রবেশ করে স্বস্তির স্বাদ খুঁজছেন অধিকাংশ কিশোর কিশোরীরা। আর এদের দেখাদেখি ছোটরাও আকৃষ্ট হচ্ছে। আর এই সকল কারণেই এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ ভিডিও গেম বিক্রি রেকর্ড করেছে, গেমস্ উৎপাদক কোম্পানি গুলি। মোবাইলের ১০ ইঞ্চি স্ক্রিনের মধ্যেই পুরো পৃথিবী। আর এই ভার্চুয়াল আকর্ষণ থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন হয়ে পড়ছে। আর এই আসক্তির প্রবণতা দেখাদিচ্ছে উঠতি বয়সের কর্মজীবী যুবক যুবতীদের মধ্যে। আর এই খেলার ফাঁদে পা দিয়ে তারা অনেক টাকা নষ্ট করছে। যে পরিমাণ অর্থ অপচয় হচ্ছে তা চোখে জল এনে দিচ্ছে। মূলত, Free Fire, Battle Field, COC, PUBG এর মত অনলাইন গেমগুলো বেশি জনপ্রিয়। সেসব খেলার বিভিন্ন ধাপ রয়েছে। ধাপে ধাপে যেতে হবে। এই অ্যাকশন গেমটি খেলতে আপনাকে কিছু ভার্চুয়াল আইটেম কিনতে হবে। যার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। উপকরণ কেনা শুধুমাত্র গেমের পরবর্তী স্তরে অগ্রসর হওয়া সহজ করে তোলে। আর তাই টাকার বিনিময়ে একের পর এক উপকরণ কেনার নেশায় মেতেছে তরুণীরা। কলকাতায় বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত এক যুবকের কথায়, সে “অনলাইন গেম খেলছেন ৫ বছর ধরে। কাজের ফাঁকে অথবা রাত্রে বাড়ি ফিরে বন্ধুদের সঙ্গে স্কোয়াড বানিয়ে অনলাইনে গেম খেলেন তাঁরা। এই গেম খেলতে গিয়ে ইতিমধ্যে প্রায় ২ লক্ষ টাকা খরচ করেছেন”। আর এক যুবক বলেন, “অনেকদিন ধরে এই গেম খেলে আসছি। এর মধ্যে ৮০ হাজার টাকা খরচ করে ফেলেছি।” এইভাবে দেখা যাচ্ছে মোবাইলে অনলাইন গেম খেলার এই প্রবণতা শুধু মাত্র উঠতি বয়সের ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে আর সীমাবদ্ধ নেই। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন যে ভিডিও গেমের অতিরিক্ত আসক্তি বুদ্ধি বৃত্তি বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে সেই সঙ্গে শিশু-কিশোরদের সামাজিকীকরণকে বাধা হয়ে দাঁড়ায় । বিষয়টিকে নিয়ে আমেরিকা, ব্রিটেনসহ ইউরোপীয় বেশ কয়েকটি দেশ বিশেষ ক্লিনিক স্থাপনের পাশাপাশি পর্যাপ্ত মনিটরিং শুরু করলেও এক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে ভারত।
(মতামত ও চিন্তাভাবনা : নিজস্ব )
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct