সাম্প্রতিক ইতিহাসে তুরস্কের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রবণতা আবার দেখা যাচ্ছে। নানা ধরনের ঝুঁকি মোকাবেলা করে এগিয়ে যাচ্ছে দেশটি। ১৯২৩ সালের ২৪ জুলাই সুইজারল্যান্ডের লুজানে যে চুক্তিটি স্বাক্ষর হয়েছিল, এক বছর পর সেটি শতবর্ষ পার হচ্ছে। এরপর কী হতে যাচ্ছে দেশটিতে? তুরস্ক কি খোলস থেকে বেরিয়ে আবার আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রক শক্তিতে পরিণত হবে? যদিও নতুন বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে সম্ভবত আবির্ভূত হতে যাচ্ছে তুর্কিরা। এ নিয়ে লিখেছেন মাসুম খলিলী। আজ দ্বিতীয় কিস্তি।
এই বিপর্যয়কর পরাজয়ের সমাপ্তি ঘটে ১৯২০ সালে ফ্রান্সের সেভরেসে চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে। সেভরেস চুক্তিতে অটোমান সাম্রাজ্যের বেশির ভাগ অঞ্চল মিত্রশক্তি ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, গ্রিস ও ইতালির কাছে হস্তান্তরের শর্ত ছিল। এই চুক্তিতে ইস্তাম্বুল এবং বসফরাসকে আন্তর্জাতিকীকরণ করা হয়।চুক্তি অনুযায়ী গ্রিস, ইতালি ও ফ্রান্স তাদের নির্ধারিত অঞ্চলগুলো দখল করলে অটোমান সাম্রাজ্যের একটি ছোট অংশ বাকি থাকে। তবে এটি মাত্র এক বছর স্থায়ী হয়। এ ধরনের অপমানকর শর্ত প্রত্যাখ্যান করে, তুর্কি জাতীয়তাবাদী বাহিনী একটি প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে এবং ১৯২১ সালের সেপ্টেম্বরে সাকারিয়ার যুদ্ধে দক্ষিণ-পূর্ব আনতালিয়া থেকে ফরাসি সৈন্যদের বিতাড়িত করে। তুর্কি প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সাথে ইজমির এবং তুর্কি ভূখণ্ডের অন্যান্য অঞ্চলে মিত্রশক্তির লড়াই হয়। তুর্কিরা গ্রিসের সেনাবাহিনীকেও পরাজিত করে। তুরস্ক পূর্ব থ্রেস, বেশ কয়েকটি ইজিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, সিরিয়ার সীমান্ত বরাবর একটি স্ট্রিপ, স্মার্না জেলা এবং বসফরাস ও দারদানেলেস প্রণালীর আন্তর্জাতিক অঞ্চল উদ্ধার করে। এই উন্নয়নগুলো মিত্রশক্তিকে আলোচনার টেবিলে আসতে বাধ্য করে, যার ফলে লুসান চুক্তি এবং বর্তমান তুরস্কের সূচনা হয়।
তুরস্কের রাজনৈতিক ইতিহাসে, প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের পরে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগান সবচেয়ে ক্যারিসম্যাটিক এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। ক্ষমতায় আতাতুর্কের ১৮ বছরের রেকর্ড (১৯২০-১৯৩৮) ভেঙেছেন তিনি। প্রাথমিকভাবে, আতাতুর্কের ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতি চর্চার বিপরীতে, এরদোগান নব্য-অটোমান ও ইসলামী মূল্যবোধের দ্বারা চালিত সংস্কৃতি গড়ে তুলতে চান। তুর্কি বৈদেশিক নীতিও এরদোগানের আদর্শবাদে কিছুটা প্রভাবিত। তুরস্কে এরদোগানের প্রতিপক্ষকে সমর্থন করার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের খোলামেলা আহ্বান সত্ত্বেও, যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ তুরস্কের সাথে সতর্ক সম্পর্ক বজায় রাখছে। যুক্তরাষ্ট্রের সিরিয়ায় কুর্দি পিওয়াইডি-ওয়াইপিজিকে সমর্থন এবং এরদোগানকে উৎখাতের ব্যর্থ অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে বিবেচিত ফতেউল্লাহ গুলেনকে আশ্রয় দেয়া আর সে সাথে তুরস্ক ও তুর্কি সাইপ্রিয়টদের বিরুদ্ধে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে গ্রিস ও সাইপ্রাসকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিঃশর্ত সমর্থন দেয়ার প্রভাব একেপি সরকারের নীতিতে দৃশ্যমান হয়। তুর্কি জনসাধারণের বৃহৎ অংশই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউ-উভয়কেই সন্দেহের চোখে দেখে।
লুজানের চুক্তির অনেক সীমাবদ্ধতার পরও এটিকে একটি কূটনৈতিক বিজয় হিসেবে দেখেছিলেন তুর্কি সেকুলাররা। কারণ এটি অপমানকর সেভরেস চুক্তি বাতিল করেছিল, যা তুরস্ককে ইউরোপ থেকে সরিয়ে এবং মধ্য ও উত্তর আনাতালিয়ায় তুরস্কের ভূখণ্ডকে একটি ছোট অংশে সঙ্কুচিত করেছিল। তবে এরদোগানের নেতৃত্বে তুর্কি নেতৃত্ব সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লুজান চুক্তির গুরুত্বকে প্রত্যাখ্যান করে এর সীমাবদ্ধতার বিষয়গুলো অ্যাড্রেস করার প্রতি মনোনিবেশ করেছে। নিও-অটোমানিজমের উত্থান প্রাথমিকভাবে তুরস্কের সাবেক রাষ্ট্রপতি তুরগুত ওজালের (১৯৮৯-৯৩) সময় হয়। এ সময় লুজান চুক্তি প্রত্যাখ্যানের পক্ষে বিবৃতি দেয়া হয়। উসমানীয় গৌরবের আকর্ষণীয় প্রকাশ, বলকান থেকে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত তুর্কি সার্বভৌমত্ব বিস্তারকারী অটোমান সাম্রাজ্যের মানচিত্র লুজান মানচিত্রকে ছাপিয়ে যায়। নভেম্বর ২০১৫ সালে এরদোগানের একেপি ও জাতীয়তাবাদী এমএইচপির মধ্যে রাজনৈতিক জোট গঠনের পর থেকে, এরদোগানের তুর্কি পুনর্জাগরণ প্রবণতা তুর্কি জাতীয়তাবাদের সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে জুলাই ২০১৬-এ ব্যর্থ অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার পরে, এই সংশ্লেষণ জনসাধারণকে সংগঠিত করতে এরদোগানকে সাহায্য করে। ২০১৬ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর প্রথমবারের মতো, এরদোগান লুজান চুক্তিকে পরাজয় বলে অভিহিত করে বলেন যে, এটি তুর্কি উপকূলের কাছাকাছি অবস্থিত কাস্তেলোরিজোর মতো দ্বীপপুঞ্জের নিয়ন্ত্রণ সুরক্ষিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। এরদোগান লুজান চুক্তিকে ঘৃণ্য সেভরেস চুক্তির একটি সামান্য আপগ্রেড সংস্করণ হিসেবে চিত্রিত করেন। এরদোগান ডিসেম্বর ২০১৭ সালে এথেন্স সফরের সময় তার গ্রিক প্রতিপক্ষ প্রোকোপিস পাভলোপোলোসকে লুসান চুক্তি সংশোধন করতে বলেছিলেন। তুর্কি রাষ্ট্রপতি তার গ্রিক প্রতিপক্ষকে ইজিয়ান সাগর মহাদেশীয় শেলফ সমস্যার একটি ‘ন্যায্য’ সমাধান খুঁজে বের করতে বলেছিলেন, যার লক্ষ্য ছিল তুর্কি এবং গ্রিক মূল ভূখণ্ডের মধ্যে একটি মধ্যম রেখা আঁকা। কিন্তু এরদোগানের সব অনুরোধ এথেন্স প্রত্যাখ্যান করে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct