সামাজিক মাধ্যম কতটা সামাজিক
সেখ মিসবাহুল আলম
অত্যাধুনিক প্রাযুক্তিক উৎকর্ষতায় তথ্যপ্রযুক্তির অনিয়ন্ত্রিত উত্থানে বর্তমানে তৈরী হয়েছে ইন্টারনেট বা অান্তর্জালে জড়িয়ে থাকা কল্পিত এক মায়াবী জগৎ যার মাধ্যমে মানুষ মুহূর্তেই বিভিন্ন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট ব্যবহার করে একে অপরের সাথে খুব সহজেই যোগাযোগ করতে পারেন।প্রিয়জনকে মুহূর্তেই পাঠাতে পারেন লিখিত বার্তা থেকে অডিও,ভিডিও বার্তা পাশাপাশি ছবি,গান,সিনেমা থেকে ডিজিট্যাল টাকা থেকে খুশির উপহার থেকে আরও অনেক কিছুই।সকালে ঘুম ভাঙ্গা থেকে রাত্রে ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত শিশু থেকে শুরু করে কিশোর কিশোরী,তরুণ তরুণী থেকে মাঝবয়সি নারী পুরুষ এমনকি বয়স্কদের একাংশও ইমেইল,হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক,টুইটার,ইনস্টাগ্রাম,ইউটিউব,গুগল প্লাস, লিংকেডিন,ভাইবার,টিকটক ইত্যাদি জনপ্রিয় সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইট ব্যবহার করতে করতে প্রয়োজনাতিরিক্তভাবে মনের অজান্তে সহজেই আসক্ত হয়ে পড়ছেন।
ছোট্ট বেলার হারিয়ে যাওয়া বন্ধুকে কিংবা কৈশোরে ভালো লাগা প্রথমাকে ফিরে পাওয়ার নির্মল আনন্দ স্মৃতি সামাজিক মাধ্যমই আমাদের ফিরিয়ে দেয়।প্রিয় বন্ধুকে জন্মদিন কিংবা ঈদ, পূজা,বড় দিনের শুভেচ্ছার রঙ বেরঙের ই-কার্ড বিনা পয়সায় বিনা দেরিতে তার ইনবক্সে পৌঁছে যায়।দুনিয়ার কোন এক কোণে ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ খবর মুহূর্তে ভাইরাল হয়।যেকোন ব্যক্তি স্বাধীনভাবে নিজস্ব মতামত জনতার দরবারে জানাতে পারেন।প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার আগে পাবলিক রিভিউ রেটিং দেখে কেনার সিদ্ধান্ত বর্তমান প্রজন্ম সহজেই নিতে পারেন।নতুন কোন পণ্যের বিজ্ঞাপন থেকে অসহায় গরীব মানুষের চিকিৎসার জন্য সাহায্যের আবেদন এই সামাজিক মাধ্যমেই ছবি সহ একাউন্ট নং পোস্ট করে দূরে থেকেও সহজেই সাহায্যের ই-হাত বাড়ানো সম্ভব।করোনা মহামারীতে বাড়িতে বসেই শিক্ষকদের ই- ক্লাস করে প্রায় দুবছর পড়ুয়ারা দিব্যি লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন।বাজারে না গিয়েও ই-বাজার আপনার দুয়ারে হাজির হয়ে আপনাকে পরিষেবা দিয়েছে।জনমত গঠনে সামাজিক মাধ্যম প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দলের কাছেও দুর্দান্ত একটা ই-প্লাটফর্ম যেখান থেকে সহজেই ভোট প্রচার থেকে প্রিয় নেতার বক্তব্য সরাসরি সমর্থকদের দেখানো হয়।বাড়িতে বসেই পরিবার থেকে অফিস থেকে রাজনীতির গুরুত্বই পূর্ণ ই-মিটিং গোপনীয়তা বজায় রেখেই করা যায়।এক কথায় ইন্টারনেটের দৌলতে সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইট বর্তমান প্রজন্মের কাছে জীবনযাত্রার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।যোগাযোগ ও বন্ধন এক নয়।সামাজিক মাধ্যম সহজে একে অপরের সাথে যোগাযোগ ঘটিয়ে দিচ্ছে এটা ঠিক।তবে এ যোগাযোগে কোনো বন্ধন তৈরি হচ্ছে না।বরং পারিবারিক,আত্মীয়তা ও বন্ধুত্বের সম্পর্কে যে বন্ধন রয়েছে সেই বন্ধনেও শৈথিল্য দেখা দিয়েছে।প্রযুক্তির প্রতি আসক্তি তৈরি হয়েছে,মানুষে মানুষে সম্পর্কের ভিত দুর্বল হয়ে পড়েছে। সামাজিকতার অনুষঙ্গ হচ্ছে ভদ্রতা,সভ্যতা,আনন্দ,বেদনা ও সমবেদনায় পারস্পরিক বোঝাপড়া।ব্যক্তি নয়,সমষ্টিই এখানে বড় কথা।সামাজিক মাধ্যমগুলো এ সত্যকে অস্বীকার করে চলেছে।বিচ্ছিন্ন দ্বীপের অধিবাসী যেন প্রত্যেক ব্যক্তি।একঘরে থেকেও তারা বিচ্ছিন্ন,এক আড্ডায় থেকেও সবাই সবার কাছ থেকে দূরে।ইমেইল,ফেসবুক,টুইটার,ইউটিউবে বুঁদ হয়ে আছে প্রতিটি প্রাণ।কেউ কারও সঙ্গে ভাববিনিময় করছে না,কথা বলছে না।এতে কারও কোনো অসুবিধাও হচ্ছে না!
এভাবে সমাজে জন্ম নিচ্ছে বিচ্ছিন্নতা ও অসহিষ্ণুতা।সামাজিক মাধ্যমেও এরই প্রতিফলন দেখা যায়।ফেসবুকের কথাই ধরা যাক।সবচেয়ে জনপ্রিয় এ সামাজিক মাধ্যমের শক্তিমত্তা সম্পর্কে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।এ শক্তির অপব্যয়ই বেশি হচ্ছে।বিদ্বেষ,রুচিবিকৃতি উগ্রবাদ ছড়ানোর হাতিয়ার হয়ে উঠেছে ফেসবুক।মতভিন্নতাকে স্বীকৃতি জানিয়ে মাওসেতুং বলেছিলেন, ‘শত ফুল ফুটতে দাও।’ মতের ও সৌন্দর্যের বৈচিত্র্যের সহাবস্থানেই সভ্য হয়ে উঠে সমাজ।শত ফুলের বদলে শত হুল ফুটছে ফেসবুকের অবয়বজুড়ে।রুচিশীল তর্ক সেখানে বিরল।যে কোনো বিষয়ে মতভিন্নতা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পর্যবসিত হয় কদর্য গালমন্দে।ধর্ম ও লিঙ্গের মতো সংবেদনশীল বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে অনেকেই শালীনতার সীমা অতিক্রম করেন।তারকা বা বিশিষ্ট কোনো ব্যক্তির চরিত্র হননের পালা শুরু হলে বিপুল উৎসাহে সেখানে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েন।ট্রলের মাধ্যমে বিপন্ন করে তোলেন সেই ব্যক্তির জীবন।ব্যক্তিটি যদি নারী হন,তাহলে আক্রমণের মাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে যায়।‘ট্রল’ নামে অভিহিত এ অনাচারকে ‘ভার্চুয়াল গণপিটুনি’ আখ্যা দেওয়াই সঙ্গত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মন না চাইলেও সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইট আমার আপনার পবিত্র মন মননে অবাঞ্ছিত অপ্রয়োজনীয় ভালো মন্দ অনেক কিছুই ঢুকিয়ে দেই।এতে করে কোন কাজের প্রতি যে ফোকাস থাকে না অনেক সময়ই সেই ফোকাস থেকে আমাদের মন দূরে সরে যায়।খুব বেশি সামাজিক মাধ্যমে সময় দিলে দিলের মধ্যে কোথাও যেনো একটা অপ্রয়োজনীয় দ্বন্দ্ব কাজ করে যা আমাদের শান্ত ও স্থির চিত্তকে অনেকসময় অশান্ত ও অস্থির করে তোলে।আমরা অনেকে সামাজিক মাধ্যমে এতটাই বুঁদ থাকি যে নাওয়া খাওয়া থেকে প্রসাব পায়খানা করতেও অনেকটা ‘ইচ্ছাকৃতভাবে’ ভুলে যায়।সারাক্ষণ মোবাইলের ক্ষতিকর আলোর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মানসিক স্বাস্থ্যের সাথে চোখের স্বাস্থ্যেরও যে কতটা ক্ষতি হয় আমরা বোধদয় কেউই তার খবর রাখি না।
বর্তমানে অধিকাংশ অভিভাবকেরই সময়ের অভাব।এ ঘাটতি পূরণ করার জন্য সন্তানের বস্তুগত চাহিদা মেটান তারা।সৃজনশীল বই পড়া বা খেলার মাঠে যাওয়ার কোনো তাগিদ যেন শিক্ষার্থীদের নেই।ঘরে অভিভাবকরা যে যার ডিজিটাল ডিভাইস নিয়ে ব্যস্ত, সন্তানরাও তাই শিখছে।এ দৃশ্য এখন দুর্লভ নয় যে, একটি পরিবারের প্রত্যেক সদস্য নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত; কেউ কম্পিউটারে,কেউ ল্যাপটপে,কেউ মোবাইল ফোনে।ইমেইল,ফেসবুক,টুইটারে,হোয়াটসঅ্যাপে সরগরম সবাই,কারও সঙ্গে কথা বলার সময় নেই।এরকম বিচ্ছিন্নতা পরিবারের প্রত্যেকটি ব্যক্তিকে পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে। সন্তানরা স্কুল কলেজের বই পড়া বাদ দিয়ে কখন যে মোবাইল গেমের আসক্তি ছাড়িয়ে অল্প বয়সেই পর্ণগ্রাফিতে আসক্ত হচ্ছে ধ্বংসাত্মক এইসব বিষয়েও বেশিরভাগ শিক্ষিত অভিভাবকরা আধুনিক জীবনের ব্যস্ততার ছেঁদো যুক্তিতে দায়িত্বজ্ঞানহীনের মত এড়িয়ে যাচ্ছেন! সৃজনশীলতা ও মননশীলতা অন্য প্রাণী থেকে মানুষকে আলাদা করেছে। সামাজিক মাধ্যম এক্ষেত্রেও হানা দিয়ে মানুষকে অনুভূতিহীন করে তুলছে।আনন্দ,বেদনা,ভালোবাসা,অভিমানের মতো মানবীয় অনুভূতি গুরুত্ব হারাচ্ছে।জ্ঞানের পরিধিও সংকুচিত হচ্ছে।নতুন শব্দ,শব্দের অর্থ জানার জন্য অভিধানের সাহায্য এখন কেউ নেয় না।গুগল ট্রান্সলেটরের সাহায্য নিতে অভ্যস্ত হচ্ছে সবাই। এমনকি অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকাও ডিজিটাল ডিভাইসে শব্দার্থ দেখে শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন।এটি শিশুদের সঙ্গে প্রতারণা ছাড়া কিছু নয়।এভাবে একটি অর্ধশিক্ষিত প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে। সভ্যতার আদি যুগ থেকেই মানুষ সামাজিক জীব।সামাজিক মাধ্যমের দৌরাত্ম্য মানুষের এ চিরন্তন পরিচিতির সামনে প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে দিয়েছে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct