স্বপ্নের চোরাবালি
আহমদ রাজু
‘ভালবাসলে এমন হয়।’‘থাই বলে....’তার কথা শেষ করতে না দিয়েই বললাম,’এটাকে ভালবাসা বলে- বন্ধন বলে।’‘যদি থাই হয় তা হইলে হামি দেশে যাইয়া থাকিবো কীভাবে?’আমি পকেট থেকে বাবার দেওয়া কলমের একটা বের করে মার্টিনা স্মিথের হাতে দিয়ে বললাম,’এটা রাখো; আমার ভালবাসার চিহ্ন।’‘পেন!বিউটিফুল।’‘রাতে বাবা দুটো পেন কিনেছে। এটা তোমার জন্যে।’‘থ্যাংকউ। থোমার এ উপহার হামার কাছে সারা জীবন থাকিবে।’‘কলমটা তোমার কাছে থাকলে আমার কথা মনে পড়বে।’‘তুমার স্মৃতি নিয়া যাইতাছি থারপরও ফিরে যাইতে হামার কষ্ট হইবে।’‘আমরা দু’জনতো এক হবোই। তুমি যত তাড়াতাড়ি পারো....।’আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই মার্টিনা স্মিথ বলল,’তুমাকে ওসব নিয়ে চিন্তা খরিতে হইবে না। তুমাকে খাছে ফাইবার জন্যে যা কিছু খরিবার দরকার সব খরিবো।’‘আজ তাহলে তোমাকে যেতেই হচ্ছে?’‘এঠাই যে বাস্তব। বলিয়াছিলাম পাঁচটায় ফ্লাইট। হাসলে হামি ভুল দেখিয়াছিলাম। ফ্লাইট বিকেল চারটায়। হামাকে এখন বিদায় নিতে হইবে। হোটেলে কিছু খাজ বাকী রহিয়াছে।’হঠাৎ মন খারাপ হয়ে যায় আমার। বললাম,’কী বলছো!আরো কিছুক্ষণ থেকে যাও।’‘না প্রিয়। ফাদার-মাদার চিন্তায় থাকিবে। হামি খুব তাড়াতাড়ি ফিরিয়া আসিবো বলিয়া বাহির হইয়াছি।’‘আবার কবে দেখা হবে?’চোখে জল এসে যায় আমার।মার্টিনা স্মিথের চোখও ছল ছল। বলল,’থুমি যেন হামাকে ভুলিও না। তুমার ফোনের অপেক্ষায় থাকিবো।’‘তোমাকে ভুলে যাবো সেটা কীভাবে সম্ভব?’‘চলো উঠি’বলে মার্টিনা স্মিথ উঠে দাঁড়ায়। আমিও সাথে সাথে উঠে দাঁড়াই। আমাকে কোন কিছু বোঝার সুযোগ না দিয়ে সে আমাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো কেঁদে ওঠে। আমি সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করি। কী বলে সান্ত্বনা দেবো তাকে? আমি নিজেও কান্না ধরে রাখতে পারছি না। ক্ষণেক পরে নিজেকে সামলে নিয়ে মার্টিনা স্মিথ চোখ মোছে। বলল,’বালো থাকিও। তুমার হপেক্ষায় থাকিবো।’হাঁটতে হাঁটতে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছি। একটা সিএনজিকে ইশারা করতেই পাশে এসে দাঁড়ায়। মার্টিনা স্মিথ তাতে উঠতে যাবে এমন সময় বললাম,’সাবধানে যেও। ভুলে যেওনা যেন।’মার্টিনা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,’খী ভলিতেছো এসব? তুমাকে কী ভুলা যায়?’‘আসি।’বলে গাড়িতে উঠে। আমি দাঁড়িয়ে থাকি নীরবে। গাড়িটি সম্মুখ দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় বাতাসের বেগে।মার্টিনা স্মিথকে বিদায় দিয়ে মন খারাপ করে হোটেলে ফিরে আসি। আমেরিকা আমার স্বপ্নের দেশ। শুধু আমার কেন, সমস্ত বাঙালির-ই স্বপ্নের দেশ। আমার সাথে সেই দেশের একজন মেয়ের সম্পর্ক হয়েছে এর চেয়ে খুশির বিষয় আর কি হতে পারে। মার্টিনা স্মিথকে বিদায় দিয়ে মন ভারাক্রান্ত হলেও আনন্দও কম লাগছে না। যাই হোক না কেন, সে দেশে যেয়ে আমার সাথে টেলিফোনে কথা বলবে- নিয়ে যাবার জন্যে কাগজপত্র পাঠাবে। এখন ঘড়ির কাটা চারটার ওপর। তাকে নিয়ে বিমানটা বোধকরি এইমাত্র আমেরিকার উদ্দেশ্যে উড়াল দিয়েছে। আমি উৎফুল্ল মন নিয়ে যাই শিশু পার্কে। রাতের গাড়িতে বাড়ি ফিরবো, অন্তত বিকেলটা যেন ভালভাবে কেটে যায়। আজ রবিবার, তবুও কেন জানি প্রচুর ভীড় পার্কের গেটে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি- যখন এসেছি তখন না দেখে ফিরবো না। ভীড় ঠেলে যখন ভেতরে প্রবেশ করি তখন ঘেমে নেয়ে একাকার। এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ পেছনের পকেটে হাত দিয়ে অনুভব করি, মানিব্যাগটা নেই। উদ্ভ্রান্তের মতো সারা পার্কে- গেটের বাইরে খুঁজে ফিরি; কোথাও নেই।ক্লান্তি এবং অবসাদে মাথা ঘুরে ওঠে আমার। সমস্ত পৃথিবী অন্ধকারে ছেয়ে যায়। যে অন্ধকারে মনে হয় কেউ আমার জন্যে অপেক্ষায় থাকবে আলোর প্রদীপ জ্বেলে। আমি কী কখনও সেই আলোর নাগাল পাবো নাকি অন্ধকারে থেকে যাবো বাকিটা সময়?
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct