সন্ন্যাসী কাউরী: কর্মজীবন থেকে অবসর নিলেও কর্তব্যে অবিচল। স্কুল এবং ছাত্র-ছাত্রীদের স্বার্থে চক ডাস্টার হাতে নিয়ে নিরন্তর ক্লাস করে চলেছেন তিনি। তিনি স্কুলের প্রিয় শিক্ষক, শিক্ষারত্ন গৌতম কুমার বোস।
‘শিক্ষকের কখনও অবসর হয় না’ এই কথাটা সব সময় বলতেন তিনি। বলতেন এই বিদ্যালয়-ই আমাদের ভাত ঘর। আমাদের জীবনে সুখ সমৃদ্ধি, মান-সম্মান, যশ খ্যাতি যা কিছু সবই এই বিদ্যালয় থেকে। কাজেই বিদ্যালয় এবং ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য শেষ দিন পর্যন্ত কাজ করে যেতে হবে। কর্মজীবনে তো করে দেখিয়েছেন, কর্মজীবন থেকে অবসর নেওয়ার পরেও আজও তিনি সেই দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। চাকরি হিসেবে নয়, আসলে শিক্ষকতাকে তিনি গ্রহণ করেছিলেন ব্রত হিসেবে। তাই গত জুলাই মাসে কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণ করলেও আজও তিনি চক ডাস্টার হাতে বিদ্যালয়ে নিরন্তর পাঠদান করে চলেছেন। স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে এরকম এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন পূর্ব মেদিনীপুর জেলার পাঁশকুড়া ব্লকের শ্যামসুন্দরপুর পাটনা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক শিক্ষারত্ন গৌতম কুমার বোস । তিনি হয়ে উঠেছেন সকলের শ্রদ্ধাভাজন, জ্ঞান তাপস গৌতম, এলাকার মানুষের আপনজন। দায়িত্ব ও কর্তব্যে এক নিরলস পথযাত্রী গৌতম কুমার বোস।
১৯৮৮ সালের ২৫ মে, অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার কোলাঘাটের সাহাপুর গ্রাম থেকে শিক্ষার প্রদীপ্ত মশাল হাতে নিয়ে শিক্ষকতাকে ব্রত হিসেবে গ্রহণ করে জীববিদ্যার শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন পাঁশকুড়া ব্লকের শ্যামসুন্দরপুর পাটনা উচ্চ বিদ্যালয়ে। তিনি তার কর্ম জীবন থেকে অবসর নিয়েছেন ৩১ জুলাই, ২০২৪ এ । দীর্ঘ ছত্রিশ বছর দু মাস ছয় দিন শিক্ষকতা করছেন একই বিদ্যালয়ে। গৌতম বাবুর কাছে বিদ্যালয় হয়ে উঠেছে মাতৃসম এক পবিত্র মন্দির। কেবল শিক্ষাদান-ই নয়, দুঃস্থ ও অসহায় ছাত্র-ছাত্রীদের জৈন বুক ব্যাঙ্কের মাধ্যমে বিনামূল্যে বই প্রদান, ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা গড়ে তোলা, সামাজিক ও পরিবেশ চেতনার প্রসার, কন্যাশ্রী যোদ্ধাদের উৎসাহ দান, বছরভর বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি গ্ৰহণ, ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়া সচেতনতার প্রচার, শরীর সুস্থ রাখতে যোগাভ্যাস, বাল্যবিবাহ ও জল অপচয় রোধ সচেতনতা গড়ে প্রভৃতি ক্ষেত্রে অগ্ৰণী ভূমিকা পালন করে চলেছেন তিনি।
কেবল বিদ্যালয়েই নয়, বিদ্যালয়ের বাইরেও নানান সামাজিক কাজকর্মের সাথে নিজেকে যুক্ত রেখেছেন তিনি। লোকহিতৈষণায় সমর্পিত প্রাণ আজ, শিক্ষক গৌতম কুমার বোস। দুস্থ অসহায় দুর্গত মানুষের পাশে থেকে শিবজ্ঞানে জীবসেবায় বারে বারে আত্মনিয়োগ করেছেন তিনি। কখনো ঘুর্ণিঝড় বন্যা বিধ্বস্ত মানুষের পাশে, কখনো ক্যান্সার ও থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীর পাশে, আবার কখনো জঙ্গলমহলে আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় দুর্গত মানুষের পাশে তিনি দাঁড়িয়েছেন ত্রাতার ভূমিকায়। হয়ে উঠেছেন মানবতার মূর্ত প্রতীক। গৌতম বাবুর কল্যাণময় মানব হৃদয় সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষের কাছে আজ কাঙ্ক্ষিত বস্তু। কখনো কোলাঘাট থেকে, কখনো মেদিনীপুর শহর থেকে খোয়া ওঠা পথ ধরে নির্দিষ্ট সময়ে এসেছেন বিদ্যালয়ে। সময়ের গণ্ডির মধ্যে তিনি কখনও আবদ্ধ ছিলেন না। স্কুলের স্বার্থে, ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থে রাত পর্যন্ত কাজ করেছেন, কখনও বিদ্যালয়ে রাত্রিযাপন করেছেন। অবসর গ্রহণের দিন তিনি বিদ্যালয়ের সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীকে খায়িয়েছিলেন বিরিয়ানি।
সমাজ ও শিক্ষার প্রতি গৌতম বাবুর স্বতঃস্ফূর্ত আকর্ষণ এবং দায়বদ্ধতা-ই সমাজ তাঁকে পৃথকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সত্যি তিনি শিক্ষারত্ন, সমাজসেবী, লোক হিতৈষী। শিক্ষা ক্ষেত্রে অসামান্য কৃতিত্বের জন্য ২০১৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার গৌতম কুমার বোস কে শিক্ষারত্ন সম্মান প্রদান করেন। মেদিনীপুর ক্যুইজ কেন্দ্র সোস্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি প্রদান করেছেন ‘আচার্য রত্ন সম্মাননা’। কোলকাতা জৈন বুক ব্যাঙ্কের পক্ষ থেকে পেয়েছেন ‘সেরা শিক্ষক সম্মাননা’ , কোলকাতা বিনোদ বিহারী বাগ ট্রাস্ট থেকে পেয়েছেন ‘বিদ্যাসাগর শিক্ষারত্ন সম্মাননা’। সমাজে নানান সামাজিক কাজকর্মের জন্য পেয়েছেন ‘সমাজসেবী সম্মাননা’ ও ‘বিশেষ শিক্ষক সম্মাননা।’ গৌতম কুমার বোসের হৃদয় পুষ্প উদ্যানে ছাত্র-ছাত্রীরা ছিল শ্রেষ্ঠ ফুল। তাই তিনি শিক্ষক হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীকে বই, অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছেন। দিয়েছেন সুচিন্তিত উপদেশ। জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে ছাত্র-ছাত্রীদের পেছনে তিনি লেগে থাকতেন। এই আদর্শ শিক্ষকের অগণিত ছাত্রছাত্রী দেশে বিদেশে স্ব স্ব ক্ষেত্রে আজ প্রতিষ্ঠিত।
গত ১২ই নভেম্বর বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে হরিসাধন পাহাড়ি সাংস্কৃতিক মঞ্চে আয়োজন করা হয় আনুষ্ঠানিক বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অগণিত প্রাক্তন বর্তমান ছাত্রছাত্রী। উপস্থিত ছিলেন প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষক শিক্ষিকাগণ। সেই অনুষ্ঠানে গৌতম কুমার বোস মহাশয় এর বিচিত্র কর্মজীবন সংবলিত একটি স্মরণিকা প্রকাশ করে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। প্রায় ৩০০ পাতার স্মারক গ্ৰন্থটি সম্পাদনা করেছেন বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক দেবাশিস পাল। প্রকাশক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সেক্ গোলাম মুস্তাফা। ওই অনুষ্ঠানে গ্ৰন্থটি উদ্বোধন করেন জৈন বুক ব্যাঙ্কের কনভেনর শ্রী সুশীল গেলরা। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কবি সাহিত্যিক প্রধান শিক্ষক প্রশ্ন কুমার করিয়া বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সেক্ গোলাম মুস্তাফা , সহকারী প্রধান শিক্ষক শুভঙ্কর দত্ত, প্রাক্তন শিক্ষক শীতল চন্দ্র মাইতি, সিদ্ধিনাথ মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষা উমা ঘোষ, আরিহান্ট কোঠারি সহ অন্যান্য বিশিষ্ট জনেরা।
স্মরণিকায় উঠে এসেছে গৌতম কুমার বোস মহাশয়ের শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি নানান সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সেবামূলক কর্মকাণ্ডের কথা। তিনি যেমন ছিলেন বজ্রের মতো কঠিন তেমনি কুসুমের মতো কোমল। তাঁর কঠোর অনুশাসন ও শৃঙ্খলাপরায়ণতার জন্যই সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী হয়ে উঠেছে অসাধারণ। প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন নিজেদের কর্ম ক্ষেত্রে। শান্ত সৌম্য ঋষি সম কর্মজীবনে গৌতম বোসের প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, নিরলস সেবা, শ্রম, ঐকান্তিক নিষ্ঠা, নান্দনিক বোধ, সংস্কৃতিময় মানসিকতা, সৃজনশীল চরিত্র সুষমা সর্বোপরি নিয়মানুবর্তিতা সকলের কাছে শিক্ষণীয় । জ্ঞানালোকের ঝর্ণাধারায় স্নাত পবিত্র ও অসাধারণ ব্যক্তিত্ব গৌতম কুমার বোসের জীবনাদর্শই শিক্ষা দেয় মাটির কাছাকাছি থেকেও কিভাবে আকাশকে ছোঁয়া যায়। সুমহান অনুভবে নিরহংকার পাণ্ডিত্যে ও উদার হৃদয়বত্তায় তিনি ছিলেন অনন্য সাধারণ। নানান স্মৃতিচারণায় ও স্মরণিকা গ্রন্থে উঠে এসেছে গৌতম বাবুর অসামান্য অবদানের কথা, কৃতিত্বের কথা। সেদিনের বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠান দুপুর থেকে সন্ধ্যা গড়িয়ে গেলেও ধৈর্যচ্যুতি ঘটেনি কচিকাঁচাদের। দূর দূরান্ত থেকে এসেছেন প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা, রোদের মধ্যে বসে থেকেছেন , দাঁড়িয়ে থেকেছেন দীর্ঘক্ষণ। কেবল শ্রদ্ধার মানুষটিকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। “আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ ধূলার তলে” -এই আকুতি ধরা পড়েছে তাদের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ ও উপস্থিতিতে।
সত্যি তিনি শিক্ষারত্ন, আদর্শ শিক্ষক। মানুষ গড়ার প্রকৃত কারিগর। সমাজে আজ তাঁর মতো শিক্ষককে ভীষণ প্রয়োজন। যাঁর জীবনাদর্শ ও জীবনাচরণ-ই প্রেরণা জোগায় ছাত্রছাত্রীদের। দিশা দেখাবে আগামী প্রজন্মকে।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct