স্বপ্ন বিক্রির শব্দ
সনাতন পাল
বাবলুর খুব ইচ্ছে, সে ক্যালকাটা পুলিশে চাকরি করবে। চেহারাটাও পুলিশের উপযোগী । যাতে মাঠ কভার করতে পারে, তার জন্য সে প্রতিদিন ভোর বেলায় উঠে দৌড় প্র্যাকটিস করে। ইতিমধ্যে দুবার পুলিশ লাইনে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু সিলেক্ট হয়নি। তাতে মানসিক ভাবে খানিকটা ভেঙে পড়েছে। এদিকে পাশের পাড়ার রাম বাবুর সাথে বাবলুর পরিবারের আত্মীয়তা বেশ জমে উঠেছে, এক্কে বারে মাখো মাখো। একদিন রাম বাবু বাবলুর চাকুরির সব গল্প শুনে তার বাবা শশধর বাবুকে বললেন,”এতো সহজে কি আর চাকুরি হয়,দাদা! খরচা আছে।”“খরচা! তা কোথায় কি ভাবে করতে হবে?” রাম বাবু বললেন,” রাজি থাকলে বলো, তারপরে সব ভেঙে বলছি।” কয়েক মুহূর্তের মধ্যে শশধর বাবু ভেবে বললেন,” হ্যাঁ, রাজি আছি।”, “বেশ, এবার তাহলে শোনো। নগদ আশি হাজার টাকা লাগবে। চাকুরি একদম পাক্কা।” “বলো কি! একদম পাক্কা!” “হ্যাঁ, একদম পাক্কা।” “সে না হয় বুঝলাম, কিন্ত অতো গুলো টাকা কোথায় পাবো?”সঙ্গে সঙ্গে মা আন্না দেবী পাশ থেকে বলে উঠলেন,”রাজি হয়ে যাও। দরকার হলে বাড়ি বিক্রি করে দেবো।”শশধর বাবু দাঁত খিঁচিয়ে বলে উঠলেন,”বললেই হলো! বলি- বাড়ি বিক্রি করে থাকবে টা কোথায়, শুনি ?”“সে একটা ব্যবস্থা হবেই, তুমি হ্যাঁ বলে দাও।”অবশেষে আশি হাজার টাকাতেই বোঝাপড়া হলো। শশধর বাবু বাড়ির সামনে থেকে দুই শতক জায়গা বিক্রি করে কোনো মতে পঞ্চাশ হাজার টাকা জোগাড় করলেন। বাকি ত্রিশ হাজার টাকা কিছুতেই জোগাড় হচ্ছে না। একদিন হঠাৎ করেই মাথায় বুদ্ধি এলো,”বাবলুর বিয়ে দিয়ে বর পণ হিসাবে কোনো মতে ত্রিশ হাজার পেলেই ল্যাঠা চুকে যাবে।”পরিকল্পনা অনুযায়ী বাইশ বছরের বাবলুর সাথে তৃপ্তির বিয়ে হলো। বর পণের টাকাটা হাতে আসতেই মোট আশি হাজার টাকা চুক্তি মোতাবেক রাম বাবুর হাতে তুলে দিলেন। তার কিছুদিন পরে নিয়োগ হলো। কিন্ত বাবলুর চাকরি হলো না। এরপরে শশধর বাবু, বিনয়ের সাথে রাম বাবুকে বললেন,”টাকাটা ফেরৎ দিন ।”“টাকা ফেরৎ! একটা গেছে তো কি হয়েছে? আরও অনেক সুযোগ আছে। বি এস এফ এ চাকুরি করে দেব।”বাবলুর পরিবার তাতেই রাজি হলো। তারপরে রাম বাবুর পরামর্শ মত বাবলু শিলিগুড়িতে বি এস এফের চাকুরির জন্য লাইনে দাঁড়াল। সে বারও তার চাকরি হলো না। এবার শশধর বাবু কিছুটা রাগান্বিত হয়ে বললেন,”আপনি টাকা ফেরৎ দেবেন! নাকি অন্য ব্যবস্থা করবো?”“কি ব্যবস্থা করবেন? আপনি জানেন! আমাদের দলে কত বড় বড় রথী মহারথী আছে ?”,”তাতে কি হয়েছে? সৎ সাহস থাকলে ডাকুন সবাই কে।”এরপরে একদিন রাম বাবু তার এক লিঙ্ক ম্যানের বাড়িতে পাশের পাড়াতে এসেছে। খবর পেয়ে বাবলু-রা সপরিবারে গিয়ে টাকা ফেরৎ চাইল। বাবলুদের বলা হলো,”ফারদার আর একদিনও যদি এই টাকার কথা বলো, তাহলে তোমাদের খুন করে ইছামতীর চড়ে পুঁতে দেব । সব শুনে সবাই চুপচাপ চলে এলো। তারপরে হঠাৎ করেই একদিন বাবলুর মা এবং মাসি অশোকের বাড়িতে ঐ টাকা উদ্ধার করার অনুরোধ জানিয়ে কেঁদে পড়লেন। মা বয়সী মানুষ কথা বলতে বলতে দুম করে আমার পা চেপে ধরলেন। অশোক বলল,”এ কি করছেন ! উঠুন উঠুন।”অশোক হাত ধরে তুললেন। এই দৃশ্য দেখে অশোকের গর্ভধারিণী মা উত্তেজিত হয়ে বললেন,”হাঁ করে দেখছিস কি, হতভাগা ? যা, যে ভাবে হোক ঐ টাকা উদ্ধার কর।”অশোক বলল ,”এটা সম্ভব নয়, আমি পারব না। মা বললেন,”তুই চেষ্টা করলে সব পারবি।”এদিকে উদ্ধার কার্যে যাওয়ার জন্য আড়াল থেকে গর্ভধারিণী মায়ের ঈশারা। অবশেষে অশোক বলল,”ঠিক আছে, দেখি কি করা যায়। রাম বাবু এদিকে এলে আপনারা জানতে পারলে অবশ্যই আমাকে জানাবেন ।”
একদিন বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ বাসস্ট্যান্ডে অশোক বসে আছে। বাবলু হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল,” গৌড়িয়া মঠের ওখানে একটা বাড়িতে রাম বাবু এসেছে।”সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুরা মিলে তিনটা মটর সাইকেলে চেপে ৯ জন ঐ বাড়িতে গেল । গিয়ে টিনের দরজায় ধাক্কা দিতেই একজন মহিলা মাথা বের করে বললেন,”কাকে চাই?” “রাম বাবুকে চাই।” শুনেই দুম করে মুখের উপরে দরজা বন্ধ করে দিলেন। মুহূর্তের মধ্যেই বাবলু বলে উঠল, ”ঐ দ্যাখ, জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে- রামবাবু, ঘরের ভেতরে খাটের উপরে বসে আছে।”শুনে অশোক ধাম করে টিনের গেটে আবার লাথি মারল। দরজাটা খুলে ভেতর দিকে পড়ে গেল। অশোক-রা ঘরের ভেতরে ঢুকল। রামবাবু কে বলল,”এই যে বাবা, ফ্যানের হাওড়া খাওয়া হচ্ছে! এবার দ্যাখো তাহলে গরম কাকে বলে।”বলেই অশোক তার জামার কলারটা চেপে ধরল। রাম বাবু অশোক কে মেজাজ দেখাল। অশোক মনে মনে ভাবল,”চোরের মায়ের বড় গলা!”মারল কষে এক থাপ্পড়। তারপরে মটর সাইকেল করে রাম বাবু ও তার সঙ্গীকে তুলে আনল । তুলে আনার জন্য কিছু আপত্তিকর পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হলো । এরপরে রাম বাবু কে বাবলুদের বাড়িতে এনে বারান্দার বাঁশের খুঁটির সাথে বাঁধল। অশোক বলল,”আশি হাজার টাকা এই মুহূর্তে ফেরৎ দে।”“টাকা নেই। কোথা থেকে দেব?”“কেন? টাকা গেল কোথায় ?”তারপরে অশোকের মাথাটা ভীষণ গরম হলো। পেটের উপর সেঁটে এক লাথি মারতেই বাঁশের খুঁটি ভেঙে গেল। রাম বাবু চিৎকার করে উঠল,”ওরে বাবারে মরেছি।”পরে বোঝা গেল খুঁটির গোড়াটা পচা। এদিকে এই রোমাঞ্চকর ঘটনা দেখতে পাড়ার প্রায় শো তিনেক লোক হাজির হয়েছেন। সন্ধ্যার খানিকটা আগেই রাম বাবুর সঙ্গীকে ছাড়া হলো টাকা আনতে। সন্ধ্যার আগেই ঐ আশি হাজার টাকা নিয়ে সে হাজির হল। শশধর বাবু পাড়া সুদ্ধ লোকের সামনে টাকাটা গুনে নিলেন। তারপরে তাকে অশোক বলল,”সমস্ত ঘটনার বিবরণ দিয়ে থানায় একটা অভিযোগ জমা দিন। সঙ্গে রামবাবু কেও পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে আসি, চলুন। উনি বললেন,”টাকা পেয়ে গেছি। আমি আর অযথা এসব ঝামেলায় জড়াবো না।”“এমনি ছেড়ে দিলে আমাদের নামে উল্টে ও মিথ্যা অভিযোগ করতে পারে।”শশধর বাবু বললেন,”তাতে আমার কি? তোরা বুঝবি।”
এই কথা শুনে অশোক আকাশ থেকে মাটিতে পড়ল। সে বেশ রাগান্বিত হয়ে বলল,”মানে! এতো স্বল্প সময়ে এতোটা পরিবর্তন!”বহুবার বলার পরেও শশধর বাবু সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলেন না। তারপরে একটা স্ট্যাম্পে যতটা সম্ভব হলো সমস্ত ঘটনার বিবরণ লিখে তাতে উপস্থিত সকলের (যতটা সম্ভব) সই এবং তাতে রাম বাবুর সই নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হলো। রাত নটা নাগাদ থানা থেকে অশোকের কাছে ফোন এলো,”রাম মজুমদার নামে একজন তোমার নামে অভিযোগ করেছে।”ফোনটা আই সি প্রণব বাবু নিজেই করেছেন। শুনে অশোক বলল,”আমাকে ধরার জন্য সরকারি টাকার তেল খরচ করার কোনো প্রয়োজনীয়তাই নেই। আমি নিজেই থানায় যাচ্ছি।”তারপরে সে থানায় গেল। অভিযোগ পড়ে শোনাতেই অশোক বলল,”লো-কাপ খুলতে বলুন, আমি নিজেকে ডিফেন্স করব না।”কিন্ত আই সি সাহেবের আশোক সম্পর্কে ভীষণ ভালো ধারণা। উনি বললেন,”কোথাও সত্য চাপা পড়ে যাচ্ছে।”“আমি থানায় আছি পাড়াতে পুলিশ পাঠান,তারাই নিজে কানে শুনে আসুক।”পুলিশ পাড়ায় গিয়ে সব শুনে শশধর বাবুকে থানায় নিয়ে এলো। আই সি সাহেব সমস্ত ঘটনা ওনার মুখে শুনে বললেন,”যে ছেলেটা জীবনের রিস্ক নিয়ে আপনাদের জন্য এতোটা করল,আর আপনারা তার কথা একবারও ভাবলেন না! যান, যা মুখে বললেন সেটাই লিখে দিন।”তারপরে উনি লিখে দিলেন। অশোকের নামে অভিযোগ খারিজ হল। ঐ দিনই রাত তিনটা নাগাদ পুলিশ বাড়ি থেকে রাম মজুমদার কে গ্রেপ্তার করলেন। খবর পেয়ে অশোক পরের দিন রাম বাবু কে দেখতে থানায় গেল। দূর থেকে দেখেই বলল,”ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা কর, আমার সাথে জীবনে যেন তোর দ্বিতীয় বার আর দেখা না হয়।”এই ঘটনার তিন বছর পরে অশোক হাসপাতালের নীচ থেকে উপরে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। আর রাম বাবু উপর থেকে নীচে নামছে। তাকে দেখে রাম বাবু ঐ যে উপরে দৌড় দিল, বহু বছর পরেও তার সাথে অশোকের আর সাক্ষাৎ হল না। পাড়ার দীনু কাকা একদিন চায়ের দোকানে বলছেন,” এখন ঘুঁষ নিয়ে চাকরির নামে প্রতারণার কথা শুনি আর ভাবি, পেসক্রিপশনটা বোধহয় ঠিকঠাক হচ্ছে না বলেই দিন দিন এসব বেড়ে চলেছে। আবার শশধরের মত স্বার্থপরের কথা ভাবলেও মনে হয়, কেন কেউ কারো জন্য রিস্ক নেবে? ভালো মানুষের জন্য রিস্ক নেওয়াই যায়, কিন্ত স্বার্থপরদের জন্য নয়। আবার এটাও মনে হয় যে এই স্বার্থপর রাও তো মায়ের পেট থেকে এমন হয়ে জন্মায়নি। এই সিস্টেমই তাদের এমন করেছে। তাই রাগ করতে হলে সিস্টেমের উপরেই করা দরকার। কিন্ত সেই মনের জোরটাও কখনও কখনও কমে যায় ।”শুনে পাশ থেকে কেষ্ট কাকা বললেন,” এসব কথা আর ভাবার সময় কোথায়, ভায়া?” কানাই মাস্টার বললেন, “এই জন্যই তো এখন গলি গলি রাম মজুমদারের মত লোকেরা কলার উঁচিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।”
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct