পশ্চিমবঙ্গ একটা কৃষি কেন্দ্রিক রাজ্য যেখানে প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ গ্রামীণ অঞ্চলে বসবাস করে এবং কৃষিকাজের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে যুক্ত থাকে। আমাদের বঙ্গ অর্থনৈতিক ক্ষমতা অনুযায়ী ভারতবর্ষের ষষ্ঠতম রাজ্য। কৃষিক্ষেত্রের অবদান হিসেবে যদি দেখি, তাহলে ধান উৎপাদনে পশ্চিমবঙ্গ প্রথম স্থান অধিকার করে থাকে। রাজ্য স্তরে মোট দেশজ পণ্য উৎপাদনে (GSDP), কৃষিক্ষেত্রের ২০ শতাংশেরও বেশি অবদান আছে। তাই রাজ্যে কৃষকবন্ধু প্রকল্পে কৃষক পেনশনও চালু করা অপরিহার্য কিনা তা নিয়ে লিখেছেন মোঃ সাহিদুল ইসলাম।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার কৃষক উন্নতি প্রকল্প হিসেবে ২০১৯ সালে ‘কৃষকবন্ধু’ প্রকল্প চালু করে। যার মুখ্য উদ্দেশ্য হলো চাষিদেরকে খরিফ চাষ ও রবি চাষের সময়ে ১ একর (৫ বিঘা) বা তার বেশি জমিতে চাষ করে থাকলে প্রতিবছর ১০ হাজার টাকা এবং ১ একরের কম হলে ৫ হাজার আর্থিক সহায়তা করা হয়। যে অর্থ সরাসরি চাষিদের ব্যাঙ্ক একাউন্টে চলে আসে। এছাড়াও, এই প্রকল্পের অধীনে নথিভুক্ত কোনো চাষির অকাল মৃত্যু অর্থাৎ ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সের মধ্যে হলে সরকার এক কালীন ২ লক্ষ্য টাকা দেবে। সম্প্রতি দুয়ারে সরকার অভিনব ক্যাম্পের মাধ্যমে এ পর্যন্ত প্রাই ৭০ লক্ষের ও বেশি চাষি নথিভুক্ত হয়েছে কিন্তু কতজন এইপ্রকল্পের সুবিধা পেয়েছেন সেটা ধোঁয়াশাই আছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই কিঞ্চিৎ আর্থিক সহায়তা কি যথেষ্ট? অকাল মৃত্যু ছাড়া, ৬০ বছর বয়সের অধিক ওই সব বৃদ্ধ চাষি পরিবারের সামাজিক সুরক্ষার কি হবে? আমাদের রাজ্যে কমবেশি ৭৫ লক্ষ পরিবার সরাসরি কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত। এদের মধ্যে প্রায় ৭০ লক্ষ চাষি ক্ষুদ্র ও মাঝারি চাষি পরিবার। তাহলে সরকার কি ওই সব সাধারণ দরিদ্র চাষিদের ভবিষৎ দৈন্যপীড়িতের ব্যাপারে অসংবেদনশীল? ভবিষৎ এর কথা যুক্তির খাতিরে ছেড়েই দিলাম, বর্তমান পরিস্থিতিতে কৃষিক্ষেত্রের কি অবস্থা সেটা আমরা সকলেই অবগত। কৃষি উপকরণ যেমন সার, বীজ কীটনাশক ইত্যাদির মূল্য যে হারে বেড়ে চলেছে, কৃষি পণ্য দ্রব্যের সঠিক মূল্য সে হারে চাষিরা পাচ্ছে না। দ্রুত আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে একদিকে যেমন অনিয়মিত বৃষ্টি, অন্যদিকে ভূগর্ভস্থ জলও চাষ বাসের জন্যে যথেষ্ট পরিমানে প্রাপ্ত হচ্ছে না, যার ফলে শস্য উৎপাদনে বাধা-বিঘ্ন হয়ে পড়ছে এবং অনেক সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে খুব ক্ষতি গ্রস্থ হয় চাষি । অভুতপূর্বভাবে কৃষক আত্মহত্যা থেকে শুরু করে কৃষক আন্দোলন প্রতিনিয়ত ঘটেই চলেছে। একদিকে যেমন ক্রমাগত কৃষিতে লোকসানের কারণে হাজারো চাষিসহ কৃষিমজুর গ্রাম ছেড়ে শহরাঞ্চলে কাজের সন্ধানে ছুটে চলেছে, আধুনিক টেকনোলজির যুগে যুবক সম্প্রদায় কৃষি ক্ষেত্র থেকে বিমুখ হয়ে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময়ে, পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থা চুক্তি ভিত্তিক চাষবাসকে উৎসাহ করছে , জমির মালিকানা কৃষকের অধিকার শেষ হয়ে কুক্ষিগত হয়ে পড়ছে। কৃষকের সার্বিক উন্নয়নে সরকারি ব্যর্থতার সুযোগে অনিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থা চাষিদের কে আরো পঙ্গু করে দিচ্ছে। দালাল ও ফড়েদের অত্যাচারের ও কোনো অন্ত নেয়, তারাও ছদ্ববেশে চাষিদের রক্ত চুষতে ছাড়ছেনা এমনকি যেকোনো সব্জী মান্ডি গেলেও তাদের দিদার পাওয়া যায়।
পশ্চিমবঙ্গ একটা কৃষি কেন্দ্রিক রাজ্য যেখানে প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ গ্রামীণ অঞ্চলে বসবাস করে এবং কৃষিকাজের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে যুক্ত থাকে। আমাদের বঙ্গ অর্থনৈতিক ক্ষমতা অনুযায়ী ভারতবর্ষের ষষ্ঠতম রাজ্য। কৃষিক্ষেত্রের অবদান হিসেবে যদি দেখি, তাহলে ধান উৎপাদনে পশ্চিমবঙ্গ প্রথম স্থান অধিকার করে থাকে এবং সেই সাথে শাক-সবজি উৎপাদনেও অনেক এগিয়ে আছে। রাজ্য স্তরে মোট দেশজ পণ্য উৎপাদনে (GSDP), কৃষিক্ষেত্রের ২০ শতাংশেরও বেশি অবদান আছে। হয়তো কৃষিক্ষেত্রকে আরো বেশি মুনাফা অর্জনের উৎস হিসেবে গড়ে তুলতে ভিন্ন ভিন্ন প্রকল্প ও পরিকল্পনা প্রস্তাবনা ও ব্যাবস্থাপনা করা হয়েছে কিন্তু ব্যবস্থাপনা অর্থলোভী পুঁজিবাদী সমাজের সহায়ক হিসেবে গড়ে উঠেছে। এটা হয়তো অনেকেই দাবি করে থাকে, সর্বাঙ্গীন কৃষিক্ষেত্রের উন্নতি হয়েছে, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির প্রয়োগ এবং গবেষণাগার ও কর্মশালা অনেক স্থাপন করা হয়েছে স্বাধীনতার পর থেকেই। কিন্তু যারা এই ক্ষেত্রর প্রধান নায়ক অর্থাৎ কৃষকশ্রেণী, তারা কি আজ অর্থ-সামাজিক ভাবে আগাতে পেরেছে যেমনটি অন্যান্য শ্রেণীর মানুষ গুলি আছে। আজও আমাদের পশ্চিমবঙ্গ চতুর্থ স্থানে রয়েছে মহিলা চাষি আত্মহত্যায়। ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্য মূল্যে বৃদ্ধির যুগে, পশ্চিমবঙ্গে চাষিদের গড় মাসিক আয় মাত্র ৬৭৬২ টাকা যেখানে হরিয়ানা, পাঞ্জাব বা মেঘালয়ের মতো রাজ্যের চাষিদের ২০ হাজারেরও বেশি। জাতীয় স্তরে গড় আয় যদি দেখি, তাহলেও সেটা পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় প্রায় দেড় গুণ বেশি (১০২১৮ টাকা) । এই স্বল্প বিস্তর আলোচনার সাপেক্ষ্যে আমরা সম্ববত খুব সহজেই চাষিদের কি অর্থ-সামাজিক অবস্থা সেটা উপলব্ধি করতে পারছি। একদিকে যেমন কৃষিক্ষেত্রকে উন্নত করতে হবে, তেমনি চাষিদের অর্থ-সামাজিক-মানব উন্নয়নের দিকে আরো বেশি ধ্যান দিতে হবে। খাঁচার উন্নতির সাথে সাথে পাখিটার দিকেও দেখতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা হিসেবে, চাষিদের জন্যে অতি শীঘ্রই বিনা শুল্কে স্পেশাল পেনশন যোজনা শুরু করা উচিত। সরকারি কর্মচারী বা অন্যান্য বিত্তশালী শ্রেণীর সাথে তুলনা করা বাহুল্য নয় কিন্তু মানব উন্নয়ন সূচকের নিরিখে ও জনকল্যাণকর রাষ্ট্র তথা রাজ্য হিসেবে আমরা দরিদ্র-পীড়িত চাষি যারা অবিরাম অক্লান্ত পরিশ্রম করে পুরো মানব জাতি সহ বিশ্বের খাদ্য উৎপাদনে কর্মরত, তাদের সর্বাঙ্গীন বিকাশ ও সামাজিক পেনশন কে অস্বীকার করতে পারি না।
গবেষক, ইনস্টিটিউট অফ রুরাল ম্যানেজমেন্ট আনন্দ, গুজরাত
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct