শীতের কম্বল
মোঃ আব্দুর রহমান
শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে সীমু! রাতটা তার একরকম খুব কষ্টে কেটেছে। ঘরে একটাই জীর্নশীর্ন কাথা আছে মাত্র, কিন্তু সেটাও জড়িয়ে দিয়েছে তার অসুস্থ মায়ের শরীরে। অবশ্য তাতেও লাভ হয়নি। কারণ ভাঙা কুঁড়ে ঘর থাকলেও, নেই সে ঘরে ভালো চালা! তাইতো ছাউনির ফাঁক গলে পড়েছে শীতের শিশির। শীতকালেও সেই আষাঢ়ের মতো টপ টপ করে শিশিরে ভিজেগেছে ছেঁড়া কাথা আর বালিশ। আসলেও ওদের কাছে শীত-গ্রীষ্ম সবই সমান!এবার হুক্কুর হুক্কুর কাশতে কাশতে জরিনা বেগম সীমুকে বললো,“মারে আমারে একটু চুলা থাইকা গরম কয়লা আইনা দিবি, অন্তত একটু হাত-পা গুলা ছেঁক দিতাম। ঠান্ডায় সব অবশ হয়া গেছেরে মা!”“ঠিক আছে” বলেই আবার চিন্তার ভাঁজ পড়লো মেয়ের কপালে। কারণ চুলোয়তো আজ দুদিন ধরে হাড়ি চাপেনি! তাহলে কয়লা আসবে কোথা থেকে। গতকাল মায়ের মুখে যে এক টুকরো পাউরুটি তুলেদিয়েছিল সীমু, সেটাতো নিজের অষ্টম শ্রেনীর বইগুলি কেজি দরে বিক্রি করেছে ঐ বারী মিয়ার দোকানে। সেই টাকাতেই কিনেছিল ওটুকু। এছারা তার আর কিছু করারও ছিল না। সারা বছর জরীনা বেগম মতিন মাতুব্বরের বাড়ী কাজ করে তার পড়ার খরচ চালিয়েছে। আজ এক মাস সে ধানের বস্তা তুলতে যেয়ে মাজার ব্যথায় বিছানায় পড়ে আছে। আর বাবাতো সীমুকে রেখে চলে গেছে সেই ছোট্ট বেলায় সড়ক দূর্ঘটনায় । তাইতো দিনে তিনবার বেলতলায় কবরটা দেখে আসে, কাঁদে এবং দুহাত তুলে আল্লাহর কাছে দোয়া করে। আজ আবার মাও অসুস্থ! ডাক্তার বলেছে আর সেভাবে কাজকর্মও করতে পারবেনা জরীনা বেগম। তাইতো সীমুও মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে আর স্কুলে যাবেনা। মায়ের পাশে থাকবে, মায়ের সেবা করবে। কারণ সে ছাড়াতো তার মায়ের আর কেউ নেই! মাকে সে আর কষ্ট দিতে চায় না।
যাহোক মায়ের কথা রাখতে মেচটা হাতে করে বাহিরেগেলো সীমু। যদিও পা তার চলছেনা, মনটাও চাইছে না এই শীতে হাঁটতে। তবুও মায়ের আবদার বলে কথা। কিন্তু সে কি! সমস্ত খড়িগুলি শিশিরে ভিজে আছে। তাই সেভাবে আগুন ধরাতে পারলোনা সীমু। রাগে মেচটা হাত থেকে ছুড়ে ফেলে দিলো। এদিকে ঘরের ভিতরে হুক্কুর হুক্কুর করে কাশছে জরীনা বেগম! “আর বলছে, কইরে সীমু মা আগুনটা আন?” একথা শুনেই মুখে ওড়না চেপে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলো সীমু! ভাবতে লাগলে কী করবে, কী জবাব দিবে সে! ঠিক এর ফাকে কানে ভেসে আসলো মাইকের সুর,” একটি বিশেষ ঘোষনা। আজ সকাল দশটায়, মতিন মাতুব্বর তার নিজস্ব বাসভবনে দুঃস্তদের মাঝে কম্বল বিতরন করবেন...।”শুনেই লাফিয়ে উঠে দৌঁড়ে মায়ের কাছে গেলো সীমু।” মা কোন কয়লা লাগবোনা। তোমার না কম্বলে গায় দেওয়ার খুব শখ। আজকা মাতুব্বর চাচার বাড়ীত কম্বল দিবো। আমি অহনী গিয়া একটা কম্বল নিয়া আইতেছি।” মাও শুনে খুব খুশি হলো। যারে মা যা, তাড়াতাড়ি লইয়া আয়। মাতুব্বর সাহেব কইছিল গতবার দিবার পারে নাই। এইবার আমগোরে ঠিকই একটা কম্বল দিব।” মায়ের কথাশুনে দৌড়ে চিলের মতো ছুটেগেলো মাতুব্বরের বাড়ীর উদ্দেশ্য। চোখেমুখে একটিমাত্র কম্বলের হাতছানি। পাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চয়তা শতভাগ। কারণ তার মা এবাড়ীতেই কাজ করতে যেয়ে আহত হয়েছে। তাকে কম্বল না দিয়ে পারবেইনা। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে হলেও অন্তত একটি কম্বল অবশ্যই দিবে..। বাড়ীর সামনে অনেক মানুষের ভীড়। সবাই একে একে কম্বল নিয়ে হাসিমুখে বাড়ী ফিরছে। সীমু অবাক হলো এখানে এমন লোককেও বিতরন করা হলো, যাদের কেনার সামর্থ আছে। দেয়াও প্রায় শেষ শেষ। তবে আরও বেশ কয়েকটি কম্বল রয়েছে। কি সুন্দর দেখতে! এমন একটা কম্বলই তার মায়ের পছন্দ। যাহোক শেষমেষ মতিন মাতুব্বরের কাছে যেয়ে আমতা আমতা গলায় সীমু বললেন। “চাচা মায়ের শরীরটা খুব খারাপ। শীতে খুব কষ্ট পাইতাছে। যদি একখান কম্বল দিতেন।”মাতুব্বর বললেন,“ ও এই কথা। আরে এই কম্বলেরতো লিষ্ট হয়াগেছে। লিষ্ট অনুযায়ী বিতরণ করমু। আর এই লিষ্টেতো তোমার মায়ের নাম নাই। ঠিক আছে, তোমার মায়রে আগামী বছর একটা দিমুনে। ওহন যাও। আমার মেলা কাম আছে।”এ কথা শুনে আর একটি কথাও বললোনা সীমু। চোখ দুটো তার টলমল করতে লাগলো। অবশেষে লজ্জায়, হতাশায় -অসহায়ের মতো ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে আবার বাড়ীর পথ ধরলেন । এখন সীমুর গতি একদম পিপড়ের মতো। যার চোখে ভাসছে শুধু অসুস্থ মায়ের মুখ! আর পিছনে ফেলে আসা কম্বল!
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct