কোভিড-১৯ মহামারির প্রায় তিন বছর পেরিয়ে গেছে। এরপরও ২০২২ সালে চিকিৎসা ক্ষেত্রে বছরের সেরা উদ্ভাবন নির্বাচন করতে গেলেই অবশ্যই আসবে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত নানা গবেষণা। তবে করোনা মহামারিকে পাশ কাটিয়ে চিকিৎসার অন্যান্য ক্ষেত্রেও সমান তালে চলছে গবেষণা, বিজ্ঞানীরা আমাদের উপহার দিয়েছেন দারুণ সব উদ্ভাবন! সায়েন্টিফিক আমেরিকান, পপুলার সায়েন্স ও কোয়ান্টা ম্যাগাজিনের নির্বাচিত চিকিৎসাক্ষেত্রে ২০২২ সালের দারুণ সব উদ্ভাবন থেকে সেরা সাতটি নিয়েই আজকের এ আলোচনা করেছেন ফৈয়াজ আহমেদ...
থ্রিডি প্রিন্টেড কৃত্রিম কান
যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর প্রায় ১,৫০০ জন মানুষ কানের পিনা বা কর্ণছত্র (কানের বাইরের অংশ) তৈরি না হওয়া কিংবা অনুন্নত কর্ণছত্র অবস্থায় জন্ম গ্রহণ করে। কর্ণছত্রের এমন অবস্থায় দেখতে খারাপ লাগার পাশাপাশি কোনো কিছু শোনার ক্ষেত্রেও মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটে। তবে এবার খুব বেশি কাটাছেঁড়া ছাড়াই প্রোটিন, হাইড্রোজেল ও রোগীর টিস্যু নিয়ে অবিকল জীবন্ত মানুষের মতোই কর্ণছত্র তৈরি করেছে নিউ ইয়র্কের প্রতিষ্ঠান ‘থ্রিডি বায়ো থেরাপিউটিকস’। তারা এ প্রতিস্থাপনকৃত কর্ণছত্রের নাম দিয়েছে ‘AuriNovo’। রোগীর যে কানের সম্পূর্ণ গঠন সম্পন্ন হয়েছে তা থেকে থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের মাধ্যমে হুবহু অপর একটি কান তৈরি করা হয় এবং রোগীর চোয়ালের উপরে স্থাপন করা হয়। এ বছর জুনে মেক্সিকোর এক মহিলার দেহে প্রথম এ কৃত্রিম কর্ণছত্র স্থাপন করা হয়। কৃত্রিম নাকসহ অন্যান্য বৃহৎ অঙ্গ প্রতিস্থাপন পদ্ধতিতে এই থ্রিডি প্রিন্টেড প্রযুক্তি কাজে লাগানোর সম্ভাবনা দেখছে প্রতিষ্ঠানটি।
দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধিতে স্থায়ী লেন্স
লেজার সার্জারির মাধ্যমে চোখের ক্ষীণ দৃষ্টি কিংবা অ্যাস্টিগমেটিজম রোগের চিকিৎসা করা সম্ভব। তবে এখানে রোগীর কর্নিয়ার কিছু অংশ তুলে ফেলা হয় এবং এতে রোগীর চোখ সর্বদা শুষ্ক থাকার একটা সম্ভাবনাও তৈরি হয়। তাই এর বিকল্প হিসেবে আসে লেন্স প্রতিস্থাপন পদ্ধতি। এ বছর মার্চ মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ফুড এন্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) উন্নত প্রযুক্তির একটি লেন্স অনুমোদন করেছে। এর নাম ‘EVO Visian Implantable Collamer Lenses‘। লেন্সটির মাধ্যমে বড় কোনো সার্জারি ছাড়াই ক্ষীণদৃষ্টি ও অ্যাস্টিগমেটিজম উভয় রোগের চিকিৎসা করা সম্ভব। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ৮৮% রোগীর ক্ষেত্রে সন্তোষজনক ফলাফল দেখা গেছে। এমনকি লেন্সটি কিছু পরিমাণ অতিবেগুণি রশ্মি প্রতিরোধ করতেও সক্ষম।
আলঝেইমার্স রোগের নতুন ঔষধ
ডিমেনশিয়ার সবচেয়ে সাধারণ রুপটি হচ্ছে আলঝেইমার্স, যেখানে ব্যক্তির চিন্তাশক্তি কমে যাওয়ার পাশাপাশি ব্যক্তির সামাজিক ও আচরণগত দক্ষতাও হ্রাস পায় অনেকাংশে। আলঝেইমার্স আক্রান্ত ব্যক্তিদের মস্তিষ্কে বিটা অ্যামাইলয়েড নামে একধরনের আঠালো পদার্থ তৈরি হয়, যা মস্তিষ্কের মাঝে জমা হতে থাকে। ফলে মস্তিষ্কের কোষগুলো ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। এ বছরের সেপ্টেম্বরে ঘোষণা আসে- ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ‘Lecanemab’ ঔষধ মস্তিষ্কের কোষগুলোর কার্যক্ষমতা হ্রাসকে বাধা দিতে পারে। এটি বিটা অ্যামাইলয়েডকে আক্রমণ করতে সক্ষম। মনে করা হচ্ছে, ২০২৩ এর শুরুর দিকে অনুমোদন পেতে পারে এ ঔষধটি। এটি অনুমোদন পেলে আলঝেইমার্সে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা হ্রাসকে বাধা দিতে পারে এমন দ্বিতীয় অনুমোদিত ঔষধ হবে ‘Lecanemab’। তবে এ ঔষধের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় কয়েকজনের মৃত্যুকে ঘিরে কিছুটা বিতর্কের গুঞ্জনও শোনা যাচ্ছে।
মারাত্মক চুল পড়া রোগের প্রথম অনুমোদিত ঔষধ
যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন বয়সী প্রায় ৩ লাখ মানুষ ‘অ্যালোপেসিয়া এরিয়াটা’ রোগে আক্রান্ত। এ রোগে দেহের ইমিউন সিস্টেম এর আক্রমণে মাথার ত্বকসহ সারাদেহের বিভিন্ন স্থানে মারাত্মক চুল পড়তে দেখা যায়। নাক ও কানে চুলের অনুপস্থিতিতে এলার্জিসহ শ্রবণে ব্যাঘাত পর্যন্ত ঘটতে পারে। চোখের পাতায় চুলের অনুপস্থিতি ধূলাবালির ফলে চোখের নানা রোগ ঘটায়। প্রচুর পরিমাণে এই চুল পড়া রোধ করতে এ বছর যুক্তরাষ্ট্রের ফুড এন্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) প্রথম কোনো ঔষধকে অনুমোদন দিল। ইলি লিলি ও ইনসাইটের তৈরি ঔষধ ‘Olumiant’ মারাত্মক চুল পড়া রোধের দীর্ঘমেয়াদী সমাধান হতে পারবে বলেই আশা করা হচ্ছে।
কম সময়ে অত্যাধুনিক এমআরআই
রোগনির্ণয় ব্যবস্থায় এমআরআই প্রযুক্তি এক আস্থার নাম। তবে ঘণ্টাখানেক এর মতো সময় কিংবা কিছু ক্ষেত্রে তারও বেশি সময় ধরে চুপচাপ মেশিনের মধ্যে শুয়ে থাকাটা বিরক্তিকরই বটে! জি. ই. হেলথকেয়ারের অত্যাধুনিক প্রযুক্তির এমআরআই প্রযুক্তি রোগীর এই সমস্যাকে একটু হলেও লাঘব করতে সক্ষম।সেপ্টেম্বর মাসে এ প্রযুক্তির অনুমোদন দেয় এফডিএ। পরীক্ষার সময় অর্ধেকে কমিয়ে আনার পাশাপাশি টিস্যু, হাড় কিংবা টিউমারের সূক্ষ্ম বিষয়াদি দক্ষতার সাথে তুলে ধরে রোগ নির্ণয়ে দারুণ ভূমিকা রাখবে ‘AIR Recon DL’ এমআরআই প্রযুক্তি।
মৃত শূকরের জীবিত অঙ্গ!
কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে মৃত্যুর এক ঘণ্টা পরও জীবিত থাকছে শূকরের অঙ্গ। কল্পকাহিনীর কোনো গল্প নয় এটি! ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা রক্ত ও পুষ্টি সমৃদ্ধ একটি মিশ্রণ শূকরের রক্তনালিতে প্রবেশ করিয়ে এ সফলতা পেয়েছেন। তারা এ মিশ্রণের নাম দিয়েছেন ‘OrganEx’। তবে এটি প্রয়োগের ফলে শূকরের মধ্যে প্রাণের কোনো অস্তিত্ব ফিরে আসেনি। মানুষের দেহে বিভিন্ন অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে এ আবিষ্কার দারুণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে। এর ফলে প্রতিস্থাপনের আগে দীর্ঘক্ষণ ধরে বিভিন্ন অঙ্গকে জীবিত রাখার সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে।
আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সাহায্যে প্রোটিনের ত্রিমাত্রিক কাঠামো উন্মোচন
কোনো প্রোটিনের কাজ কী তা জানার জন্য এর গঠন জানার কোনো বিকল্প নেই। কোনো সুস্থ কিংবা অসুস্থ ব্যক্তির দেহে কোনো প্রোটিন কীভাবে কাজ করে তা জানার জন্যে প্রথমত বিজ্ঞানীদের ঐ প্রোটিনের আণবিক গঠন জানার প্রয়োজন হয়। তবে হাজার হাজার অ্যামাইনো অ্যাসিডের সিকুয়েন্স থেকে প্রোটিনের ত্রিমাত্রিক কাঠামো বের করা বিজ্ঞানীদের কাছে বেশ ঝামেলার কাজ! তবে এ ঝামেলা থেকে রেহাই পেতে এ বছরের শুরুর দিকে গুগলের কোম্পানি ‘ডিপমাইন্ড’ একটি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। ‘AlphaFold’ নামের এ প্রযুক্তি প্রায় ২০০ মিলিয়ন প্রোটিনের ত্রিমাত্রিক কাঠামো বের করতে সক্ষম হয়েছে। জীববিজ্ঞানের গূঢ় রহস্য সমাধানের পথে অভাবনীয় এক সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে ‘AlphaFold’। চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিভিন্ন ঔষধ উৎপাদনে এ প্রযুক্তি দারুণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct