বাবরি মসজিদ-রামমন্দির বিবাদ এখন স্তিমিত। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বিষয়টির ফয়সালা করা হলেও তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। যদিও ভূমিপুজোর মাধ্যমে রামন্দিরের যাত্রা শুরু হয়ে গেছে। অযোধ্যায় অতীত হয়ে উঠছে বাবরি মসজিদের ইতিহাস। কিন্তু মানুষের মধ্যে এখনও বাবরি মসজিদ-রামমন্দির নিয়ে বিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকৃত সত্য উদঘাটনের আগ্রহ অব্যাহত রয়েছে। তাই রামের ইতিহাস থেকে শুরু করে রামমন্দির, বাবর থেকে শুরু করে বাবরি মসজিদ- সমগ্র বিষয়টি নিয়ে এই অনুসন্ধিৎসু প্রতিবেদনটি লিখেছেন দিলীপ মজুমদার। দ্বাদশ কিস্তি।
উত্তরপ্রদেশের শাসন ক্ষমতায় বিজেপি। সে রাজ্যের রাজ্যপাল ১৯৯১ সালের ৭ অক্টোবর এক অধ্যাদেশ জারি করলেন। Land Acquisition Act of 1894, Sec. (4) Sub-sec, (1) অনুযায়ী এই অধ্যাদেশ। অধ্যাদেশজনিত নোটিশের বিজ্ঞাপন উত্তরপ্রদেশ সরকারের পর্যটন সচিব অলোক সিনহা ৯ অক্টোবর ও ১১ অক্টোবর শুধুমাত্র ফৈজাবাদের ‘জনমোর্চা’ ও ‘নইলোগ’ নামক দুটি পত্রিকা্য় প্রকাশ করেন। নোটিশে বলা হয় : বাবর-ই-মসজিদ ছেড়ে মসজিদের সামনে পূর্বদিকে ৪টি প্লটের ২৭৭৪ একর জমি অযোধ্যায় তীর্থযাত্রীদের স্বার্থে পর্যটনের উন্নয়নের জন্য রাজ্য সরকার অধিগ্রহণ করছে। প্লটগুলি হল : Plot No. 159, 160, 171 , 172 .
উক্ত চারটি প্লটই বিতর্কিত, এলাহবাদ হাইকোর্টের বিচারাধীন। তীর্থযাত্রীদের সুবিধার কথা বলা হলেও আসল উদ্দেশ্য যে ভিন্ন সে কথা সাংবাদিক দেবাশিস ভট্টাচার্য বিশ্লেষণ করে বলেছেন. ‘ বিজেপি সরকার বিশ্ব হিন্দু পরিষদ নিয়ন্ত্রিত রামজন্মভূমি ট্রাস্টকে সে জমি দান করবে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ওই জমির উপর প্রস্তাবিত ২৭০ ফুট লম্বা মন্দিরের সিংহদ্বার, গোপুরম ও নৃত্যগৃহ তৈরি করবে। তারপর বিধানসভায় বিল এনে বাবর-ই-মসজিদ অধিগ্রহণ করবে রাজ্য সরকার। বলা হবে রামজন্মভূমি কমপ্লেক্স গড়ার জন্য মসজিদের এলাকাও দরকার। অর্থাৎ দুদফায় জমি অধিগ্রহণ হবে। তারপর ওই জমি আবার বিশ্ব হিন্দু পরিষদকে রাজ্য সরকার দেবে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বাবরি মসজিদ চত্বরে গড়বে গর্ভগৃহ। প্রস্তাবিত মন্দিরের ৩টি অংশ সিংহদ্বার, গোপুরম ও নৃত্যগৃহের সঙ্গে গর্ভগৃহকে জুড়ে দেওয়া হবে। আর এস এস নেতারা এই ছক কষেছেন। কার্যকর করতে বলেছেন বিশ্ব হিন্দি পরিষদ ও মুখ্যমন্ত্রীকে।’ ( আজকাল, ২৭.১০.১৯৯১ )
জমি অধিগ্রহণের পাশাপাশি শিলান্যাস স্থলের ( রাজীব গাঁধীর প্রধানমন্ত্রীত্বকালে ১৯৮৯ সালের ৯-১০ ডিসেম্বর বাবর-ই-মসজিদের পূর্বে প্রায় ১৫০ ফুট দূরে বিতর্কিত জমিতে শিলান্যাস হয়েছিল ) উত্তর-পশ্চিমে ৫০ ফুট দূরে রামগোপাল তেওয়ারি, কেশব দাস, ফলাহারিবাবা প্রমুখদের ঘর তথা মন্দিতগুলিও ভেঙে দেয় বজরং দলের কর্মীরা।
১৯ অক্টোবর রাজ্য সরকারের অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে লক্ষ্মৌতে সচিবালয়ের সামনে উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মন্ত্রী শারদানন্দ আঁচল, বিধানসভার সদস্য হীরালাল যাদব, সমাজবাদী জনতা দলের নেতা ডি কে আনন্দসহ বহু বিশিষ্ট হিন্দু-মুসলিম নেতা গ্রেপ্তার বরণ করেন। তাঁদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন অক্ষয় ব্রহ্মচারী। প্রতিবাদ আন্দোলনে শ্লোগান ছিল, ‘সর্ব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করো, রাম নামে কলঙ্ক মাখিয়ো না’।
২১ অক্টোবর রাম আশ্রে দাসের সঙ্কটমোচন মন্দিরের পূর্বদিকের পাশে সাক্ষীগোপাল মন্দিরের লাগোয়া দক্ষিণে ও আগের বারের শিলান্যাস স্থলের ২৫ ফুট উত্তরের জমিতে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতারা সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে শঙ্খ-ঘন্টা বাজিয়ে ‘ভূমিপূজার’ কাজ শেষ করেন। ১০টা ৪১ মিনিটে শুরু হয় খনন কাজ।
সেই দিনই জমি অধিগ্রহণের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আবদুল হাসিম এলাহবাদ হাইকোর্টে যে মামলা এনেছিলেন, তার শুনানি চলছিল। হাসিমের বক্তব্য ছিল : অধিগৃহীত জমি ওয়াকফ বোর্ডের সম্পত্তি, তাই সে জমি অধিগ্রহণের জন্য সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি করা অবৈধ। রাজ্য সরকারের পক্ষে অ্যাডভোকেট জেনারেল ভি কে এস চৌধুরী শুনানিতে অংশগ্রহণ করেন। দিনভর শুনানি চলে। তারপর হাইকোর্ট নির্দেশ দেন : বিজ্ঞপ্তির ভিত্তিতে ২১ অক্টোবর পর্যন্ত রাজ্য সরকার যেন জমি অধিগ্রহণ না করেন।
আরও দুটি পৃথক রিট আবেদন আদালতে পেশ হয় ২৫ অক্টোবর। একটি খালিদ ইউসুফের ও অন্যটি রামানন্দী আখড়ার। দুটি আবেদনেই বলা হয় যে উক্ত জমি ওয়াকফ বোর্ডের সম্পত্তি, তা রাজ্য সরকার অধিগ্রহণ করতে পারেন না। বিচারপতি এস সি মাথুর, ব্রিজেস কুমার এবং এস এইচ রাজাকে নিয়ে গঠিত স্পেশাল বেঞ্চের এক অন্তর্বর্তী রায়ে বলা হয় : অধিগৃহীত জমির মালিকানা হাতবদল করা যাবে না ; তবে রাজ্য সরকার তীর্থযাত্রীদের জন্য অস্থায়ী ছাউনি তৈরি করতে পারবেন।
২৯ অক্টোবর আবার প্রতিবাদের ঢেউ উঠল। অযোধ্যা থেকে ৬৫ কিমি দূরে অধিগ্রহণের প্রতিবাদ জানালেন রাষ্ট্রীয় মোর্চা ও বামজোটের নেতা ও কর্মীরা। প্রায় ৫০০ মানুষ জমায়েত হয়েছিলেন সমাবেশে। তাঁদের দাবি ছিল সংবিধান অনুযায়ী আইনের শাসন।
২৯ অক্টোবর আরও একটা ঘটনা ঘটল।
এদিন কানপুরের ইকবাল কুরেশি এলাহবাদ হাইকোর্টের লক্ষ্মৌ ডিভিশন বেঞ্চে পেশ করেন একটি রিট আবেদন। আবেদনে তিনি প্রতিশ্রুতিভঙ্গের জন্য উত্তরপ্রদেশের সরকারকে বরখাস্ত করার কথা বলেন। ২৫ জুন সরকার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা তাঁরা পরের দিন অর্থাৎ ২৬ জুনই লঙ্ঘন করেন।
৩০ অক্টোবর করসেবকদের স্মরণে অযোধ্যায় পালিত হয় ‘শৌর্য দিবস’।
৩১ অক্টোবর আবার উত্তপ্ত হয়ে ওঠে অযোধ্যা। সন্ত-নেতৃত্ব ও প্রশাসনকে হতচকিত করে মসজিদে হানা দেয় একদল করসেবক। নিরাপত্তা বেষ্টনিকে অগ্রাহ্য করে একদল মসজিদের ভেতরে ঢুকে রামলালার মূর্তির সামনে শুরু করে দিয়েছেন রাম-ভজন। আর একটি দল ১৭ জন সদস্য নিয়ে মসজিদের চূড়ায় উঠে ভেঙে দেন তিনটি গম্বুজ, উড়িয়ে দেন ‘জয় শ্রীরাম’ লেখা তিনটি পতাকা। অন্য আর একটি দল মসজিদের বাইরের প্রাচীরের একাংশ বিনষ্ট করে দেন। জনা কয়েক করসেবক শিলান্যাসস্থলের চারপাশে মন্দিরের ভিত খুঁড়তে থাকেন।
এসব সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে মসজিদের সামনে ভিড় বাড়তে থাকে। নিরাপত্তাবাহিনী অবশ্য তৎপর হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। পতাকা নামিয়ে নেওয়া হয় মসজিদ থেকে। করসেবকদের বুঝিয়ে নিরস্ত করা হয়। বিকেলবেলা যৌথ তথ্যানুসন্ধানী দল পরিদর্শনে এলে তাঁরা বজরং বাহিনীর হাতে আক্রান্ত হন।
লক্ষ্মৌ বেঞ্চ ২৫ অক্টোবর যে রায় দিয়েছিলেন তার বিরুদ্ধে নাহিদ ইয়ার খানের পেশ করা রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের মুখ্য বিচারপতি রঙ্গনাথ মিশ্র এবং বিচারপতি টি কে থোম্মেনকে নিয়ে গঠিত একটি ডিভিশন বেঞ্চ উত্তরপ্রদেশ সরকার, মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিং, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও ফৈজাবাদের জেলাশাসকের কাছে এক নোটিশ পাঠান।
নাহিদ খান জনস্বার্থে জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত রাজ্য সরকারর ৭ ও ১০ অক্টোবরের বিজ্ঞপ্তিকে চ্যালেঞ্জ
জানিয়ে আবেদনে বলেন, জমিটি জনস্বার্থে অধিগৃহীত হয় নি। আসলে রাম মন্দির তৈরির জন্য সরকার বিশ্ব হিন্দু পরিষদের হাতে জমিটি তুলে দিতে চান।
১৯৯১ সালের ২ নভেম্বর।
দ্বারকাপীঠের শঙ্করাচার্য স্বামী স্বরূপানন্দ সরস্বতী অযোধ্যায় ভেঙে ফেলা মন্দিরগুলি নতুন করে গড়ে দেবার দাবি জানান। তিনি বলেন এ কাজ করে হিন্দুধর্মের ভাবমূর্তি নষ্ট করা হয়েছে।
২ নভেম্বর অযোধ্যা ইস্যুতে দিল্লিতে জাতীয় সংহতি পরিষদের বৈঠক বসে। সকাল সাড়ে দশটা থেকে দেড়টা, দুপুর তিনটে থেকে রাত পৌনে নটা পর্যন্ত বৈঠক বসে প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাওএর সভাপতিত্বে। বলা হয়, ‘ অযোধ্যা সম্পর্কে এলাহবাদ হাইকোর্টের বকেয়া মামলাগুলির রায় লঙ্ঘন করা হবে না। অধিগ্রহণ সম্পর্কে রায়ও মানা হবে।’
বিশ্ব হিন্দু পরিষদের বিষ্ণু হরি ডালমিয়া ব্যতীত আর সকলেই সে প্রস্তাবে সই করেন।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
এর আগের পর্বগুলি পড়ুন:
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১১
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১০
রাম, রামায়ণ ও বাবরি মসজিদ নিয়ে রাজনীতির নেপথ্যে/১
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct