কেন্দ্রের মসনদে দ্বিতীয়বারের মতো ‘সম্রাটের’ ভূমিকায় নরেন্দ্র মোদি। তার শাসনামলে দেশের মুদ্রাস্ফীতি তলানিতে, বৃদ্ধি পেয়েছে বিদ্বেষের মাত্রা। যদিও নির্বাচনে ডাক দিয়েছিলেন ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’। বাস্তবে তার যথার্থ প্রতিফলন না ঘটলেও প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসে নিজের ইমেজ তৈরি করতে সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছেন। তা নিয়ে আলোকপাত করেছেন ড. দিলীপ মজুমদার।
এই দেশের বুকে বিপুল ও নিয়ন্ত্রণহীন নির্বাচনী তহবিল সিস্টেমের নেপথ্যে বিতর্কিত ইলেক্টরাল বণ্ড স্কিম জুড়ে রয়েছে। ২০১৯-২০এর নির্বাচনী বছরে এই বণ্ড থেকে ভারতের রাজনৈতিক দলগুলি পেয়েছিল মোট ৩২৪৯ কোটি টাকা ; যার মধ্যে বিজেপির ছিল ২৬০৬ কোটি টাকা, যেটা মোট টাকার ৭৫%। এই পরিসংখ্যান পুঁজির বিপুল বৈষম্যকে তুলে ধরে। তার চেয়েও সমস্যাজনক বিষয় হল, এই ইলেক্টরাল বণ্ডের টাকা কার কাছ থেকে আসছে তা নিয়ে অস্বচ্ছতা। সেই তথ্য ও পুঁজি অধিগত করার ক্ষমতা থাকবে একমাত্র ক্ষমতাসীন দলের কাছে। এর থেকেই স্বাভাবিকভাবেই বিপুল স্বজনপোষণজনিত ‘ক্রায়োনিজম’ এর সম্ভাবনা থেকে যায় এবং সন্দেহের আওতায় ঢুকে পড়ে যথাসম্ভব ত্রুটি ছাড়াই গোপন চুক্তির চিন্তাও।সুতরাং মোদির দুর্নীতি-বিরোধী স্লোগানকে এখন আরও বেশি করে রাজনৈতিক ভাষ্য ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। খুঁটিয়ে দেখলে এই ভাষ্যের আসলে কোন অর্থই নেই। যদি থাকেই তাহলে সর্বাগ্রে কেন বিজেপিশাসিত কর্নাটক ও গোয়ায় এই দুর্নীতি বিরোধিতা দমন করা হচ্ছে না প্রশাসনিক স্তরে ?সম্প্রতি মোদি যে দুর্নীতি দমনে ইডি ও সি বি আইকে লাগিয়েছেন তা আসলে বিরোধীদের জব্দ করার জন্য। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে কেন্দ্রীয় সরকারের এই দুটি এজেন্সি অ-বিজেপি রাজ্যগুলিতেই দাপাদাপি করছে। দুর্নীতিগ্রস্ত যে সব বিরোধী নেতারা বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে এজেন্সি নীরব থাকছেন। এখানেই ‘ওয়াশিংমেশিন’এর কথা উঠছে।নরেন্দ্র মোদি ঘুষের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে ক্ষমতায় এসেছিলেন। কিন্তু তাঁরই অধীনে থাকা সেন্ট্রাল ভিজিলেন্স কমিশন জানাচ্ছেন যে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মী ও অফিসারদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ভুরি ভুরি অভিযোগ আছে। তাঁদের এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে যে ২০২২ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মী ও অফিসারদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মোট অভিযোগ জমা পড়ে ১ লক্ষ ১৫ হাজার ২০৩টি। সব অভিযোগের তদন্ত করে ইঠতে পারে নি সরকার। মজার কথা হল মোট অভিযোগের ৪৬ হাজার ৬৪৩টি দায়ের করা হয় অমিত শাহের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্মী ও অফিসারদের বিরুদ্ধে। দ্বিতীয় স্থানে রেল এবং তৃতীয় স্থানে ব্যাঙ্ক।
এবার আসছে সি এ জি রিপোর্ট। যে মোট ৮টি ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে সেগুলি হল :
ক] দিল্লির দ্বারকা থেকে গুরুগ্রামের মধ্যে দ্বারকা এক্সপ্রেসওয়ে তৈরির জন্য প্রতি কিলোমিটারে ১৮ কোটি টাকা অনুমোদিত হয়েছিল। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে খরচ হয়েছে কিলোমিটার পিছু ২৫০ কোটি টাকা।
খ] ভারতমালা প্রকল্পে বরাত দেওয়ার প্রক্রিয়াতে অনিয়ম আছে।
গ] জাতীয় সড়কে টোল আদায়ের নিয়ম ভেঙে যাত্রীদের কাছ থেকে ১৫৪ কোটি টাকা টোল আদায় করা হয়েছে।
ঘ] আয়ুষ্মান ভারত -প্রধানমন্ত্রী জন-আরোগ্য প্রকল্পে একটি মোবাইল নম্বরের সঙ্গে সাড়ে সাত লক্ষ মানুষের নাম যুক্ত করা হয়েছে। মৃতদের নামেও স্বাস্থ্যবিমায় চিকিৎসার অর্থ বরাদ্দ হয়েছে।
ঙ] কেন্দ্রীয় সরকারের স্বদেশ দর্শন প্রকল্পের অধীনে উত্তরপ্রদেশে অযোধ্যা উন্নয়ন প্রকল্পে ঠিকাদারদের প্রায় ২০ কোটি টাকার সুবিধা পাইয়ে দেওয়া হয়েছে।
চ] গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক তার পেনশন প্রকল্প থেকে ২ কোটি ৮৩ লক্ষ টাকা অন্য প্রকল্পের প্রচারে খরচ করেছে।
ছ] রাষ্টায়ত্ত সংস্থা হ্যাল-এ বিমানের ইঞ্জিনে নকশা, উৎপাদনে খামতির জন্য ১৫৯ কোটি টাকার লোকসান হয়েছে।আছে রাফাল দুর্নীতির কথা। ৩৬টি রাফাল যুদ্ধ বিমান কেনার খরচ ৪২ হাজার কোটি টাকা। এক ফরাসি সংবাদ মাধ্যম দাবি করেছে ভারতীয় অস্ত্রব্যবসায়ী সুষেণ গুপ্তের বিরুদ্ধে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তের রিপোর্ট চেয়েছেন ফরাসি ম্যাজিস্ট্রেট। ভারত রাফালের বরাত পাওয়ার জন্য এই সুষেণ গুপ্তকেই যুদ্ধ বিমানের প্রস্তুতকারক সংস্থা দাসো অ্যাভিয়েশন বিপুল অর্থ দিয়েছে বলে অভিযোগ ফরাসি তদন্তকারীদের। পাশাপাশি রাফাল কেনার চুক্তিতে দাসো অ্যাভিয়েশনের অংশীদার অনিল আম্বানির ফ্রান্সে পাওয়া কর ছাড় নিয়েও নতুন তথ্য পাওয়া গেছে।আছে নীরব মোদি, মেহুল চোকসি, বিক্রম কোঠারির চু কিত কিত খেলা। এঁরা পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক ও রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে কোটি কোটি টাকা লোপাট করে কি ভাবে পালিয়ে গেলেন বিদেশে, কি ভাবে তাঁদের ধরিলে তো ধরা যায় না, সে এক অপার রহস্য।কর্নাটকের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বি এস ইয়েদুরাপ্পা জমি ও খনি কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত ছিলেন। তাঁর ডায়েরিতে দেখা গেছে বিজেপি নেতা, বিচারক, অ্যাডভোকেটদের প্রচুর ঘুষ দেওয়া হয়েছে। তদন্ত হয়েছে। কিন্তু ইয়েদুরাপ্পা আছেন বহাল তবিয়তে। উত্তরাখণ্ডে মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়ে রমেশ পোখরিয়াল নিশংক জমি ও হাইড্রোইলেকট্রিক দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনিও বহাল তবিয়তে আছেন। কর্নাটকের বেলেরির রেড্ডি ভাইএরা ১৬ হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি অভিযোগে অভিযুক্ত। তাঁদের গায়ে আঁচড় পড়ে না। হিমন্তবিশ্ব শর্মা যখন কংগ্রেসে ছিলেন, তখন জলসরবরাহ কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত ছিলেন। বিজেপিতে গিয়ে ওয়াশিং মেশিনে শুদ্ধ ও কলঙ্কমুক্ত হয়েছেন, যেমন কলঙ্কমুক্ত হয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুকুল রায়, শুভেন্দু অধিকারী ; মধ্যপ্রদেশের শিবরাজ চৌহান, মহারাষ্ট্রের নারায়ণ রানে, অজিত পওয়ার প্রভৃতিরা।কথা উঠছে শিল্পপতি আদানির সঙ্গে মোদির সম্পর্ক নিয়ে। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়ে গৌতম আদানির সঙ্গে মোদির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আদানিরও উথ্থান ঘটতে থাকে।মোদি প্রধানমন্ত্রী হবার পরে আদানিকে মুম্বাই বিমান বন্দর পরিচালনার ভার দেওয়া হয় জিভি গোষ্ঠীকে সরিয়ে। তারপর মোট ৬ টি বিমান বন্দর পরিচালনার ভার দেওয়া হয় আদানিকে। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রেও আদানিকে বিপুল বরাত দেওয়া হয়েছে। এল আই সি, স্টেট ব্যাঙ্ক, পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক, বরোদা ব্যাঙ্ককে বাধ্য করা হয়েছে আদানি গোষ্ঠৌতে লগ্নি করতে।তা হলে না খাউঙ্গা না খানে দুঙ্গার কি হল ? লোকগায়িকা নেহা সিং রাঠোর তাই প্রশ্ন করেন : কাইসন বা তোহারি চৌকিদারিয়া হো ?
।। দ্বিতীয় তরঙ্গ।
নরেন্দ্র মোদির প্রথাগত পড়াশুনো কতদূর, আদৌ আছে কি না, সসব নিয়ে বিতর্ক আছে। সে বিতর্ক বাদ দিলেও আমরা বলতে পারি অর্থনীতিশাস্ত্রে মোদিসাহেবের বিশেষ ব্যৎপত্তি আছে। যাকে বলে মোদির ইকনমিক্স বা মোদিনমিক্স। সেই জ্ঞানের জোরেই তিনি ভারতের পড়ন্ত অর্থনীতিকে বিশ্বের দরবারে উজ্জ্বল করে তুলবেন। অর্থনীতিতেও বিশ্বগুরু হবেন।মৈত্রীশ ঘটক ও উদয়ন মুখোপাধ্যায় বলেন, “ যিনি বলেছিলেন মোদিনমিক্স -এর ম্যাজিক দিয়ে ভারতের অর্থনৈতিক শক্তিকে বিশ্বের দরবারে সগৌরবে প্রতিাষ্ঠিত করবেন, তাঁকে এখন যদি এই বলে বড়াই করতে হয় যে, তাঁর আমলে জিডিপি বৃদ্ধির হার বছরে গড়পড়তা ৭ শতাংশ (বিশ্বব্যাঙ্কের হিসেব ), কিংবা ৭ শতাংশের সামান্য নিচে ( সি এসও-র আগের পরিসংখ্যান, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হ্যাণ্ডবুকের সাম্প্রতিকতম সংস্করণে যা দেওয়া হয়েছে ) অথবা মেরেকেটে ৭.৭ শতাংশ ( সি এসও-র শেষ সংশোধন ), তবে নিতান্ত অন্ধ ভক্ত ছাড়া আর কেউ তাঁর কৃতিত্বে মুগ্ধ হয়ে কি ?” বুক বাজিয়ে মোদি আরও বলেছিলেন তিনি ভারতকে ৫ লক্ষ কোটি টাকার অর্থনীতির দেশ করে তুলবেন। ৫ লক্ষ কোটি টাকার অর্থনীতির দেশ হতে গেলে মাথাপিছু জিডিপি কত হয় ? হয় ৩০০০ মার্কিন ডলারের সামান্য কিছু বেশি। তার মানে কি ? মানে হল প্রতিটি ভারতবাসী হবেন মিলিওনিয়ার। আর যাঁরা এখনই মিলিওনিয়ার আছেন, তাঁরা হবেন বিলিওনিয়ার। আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার মতো ব্যাপার। আসলে ঘটনাটা কি ?
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct