শাসক ফ্যাসিস্ট হলে, নাগরিকের কর্তব্য কি হবে?
সনাতন পাল
বর্তমানে আমরা ভীষণ সংকটজনক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে চলেছি। কিন্তু কি সেই সংকট? পরিস্থিতি সম্পর্কে অনেকে উদ্বেগ প্রকাশ করছি,আবার একটা বড় অংশের মানুষ শাসকের চাপানো জোয়াল রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের কর্তব্য বলে বয়ে নিয়ে চলেছেন। এটিই তো বাস্তব সত্য যে চেতনার অভাবে পারফিউমের গন্ধে ঘামের গন্ধকে চাপা দিচ্ছে। কি ভাবেই বা এই সংকট থেকে আমরা মুক্তি পাবো? এই মুক্তি পেতে গেলে সবার প্রথমে মানবতার মুক্তি ঘটা দরকার। কিন্তু কোনো শাসক অমানবিক হলে সে এই মুক্তির বিপরীতে কার্য করে থাকে। এই মুক্তির জন্য দরকার প্রকৃত শিক্ষা। মানবতা তো পৃথিবীতে জীবিত সমস্ত সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের মধ্যেই সুপ্ত অবস্থায় থাকে। শিক্ষার কাজ হলো মানুষের মধ্যে মানবতা নামক ঘুমন্ত শিশুকে জাগ্রত করা এবং তাকে পোক্ত করা। কিন্তু কোথাও যদি এমনটা ঘটে যে, সেখানকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ফ্যাসিস্ট-রা দখল করেছে,তাহলে তারা সবার প্রথমে শিক্ষা ব্যবস্থা এবং শিক্ষার সমস্ত উপকরণ কে ধংস্ব করতে বড্ড পরিকর হয়। কারণ তারা ভালো করেই জানে যে, যদি মানবতাবাদ অধিক শক্তিশালী হয়, তাহলে তাদের স্থায়িত্ব কমে যাবে। সেই কারণে মানবতার অক্সিজেন যে শিক্ষা, সেই শিক্ষাকেই তাঁরা দুর্বল করতে চায়। এটাই তাদের স্বাভাবিক কর্মপন্থা। এমনটা ঘটলে ভবিষ্যত প্রজন্মের স্বার্থে নাগরিকদের দায়িত্ব অনেক খানি বেড়ে যায়। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় যখন এই রূপ পচন ধরে তখন সবার প্রথমে টের পায় শিক্ষিত,সংবেদনশীল এবং প্রগতিশীল অংশের মানুষ। তাঁদের মধ্যে থেকে একটা বড় অংশের মানুষ সমাজের বাকি অংশের মানুষকে প্রস্তুত করার চেষ্টা করে থাকে, এই ভেবে যে, তাঁরা যেন রাষ্ট্রীয় কোনো প্রবাকান্ডয় কান না দেয় এবং নিজেরা যেন শাসকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে চেতনায় শান দিয়ে আসন্ন লড়াইয়ের জন্য ভেতর থেকে মজবুত হয়ে নিজেদেরকে তৈরী করতে পারেন । এই রূপ সম্ভবনা তৈরী হলে সবার প্রথমে দরকার বাক্ স্বাধীনতা। যার দ্বারা দেশের বা রাজ্যের সমস্ত নাগরিকদের শাসকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগঠিত হবে। এমন সময়ে
স্বৈরাচারী শাসক নিজের দাঁত এবং নখ বের করে দেয় এবং গণতন্ত্রের উপরে থাবা বসায়। গণতন্ত্র তখন হাঁসফাঁস করে উঠে এবং পরিত্রাণ পেতে চায়। আর তখন শাসক বিরোধীদের মিটিং-মিছিল করার ক্ষেত্রে আসে রাষ্ট্রীয় বাধা আসে, প্রগতিশীল নাটককে বন্ধ করে দেওয়া, প্রগতিশীল এবং আলোড়ন সৃষ্টিকারী গানকে ব্যান্ড করে দেওয়া হয়, শাসক বিরোধী কথা কাগজে লিখলে লেখকের উপরে আক্রমণ নেমে আসে,যত্রতত্র ১৪৪ ধারার ব্যবহার ঘটে। এই সব কিছু করেও যখন শাসক উপলব্ধি করে যে, রক্ষা পাওয়া বোধহয় সম্ভব নয়,তখন তারা ধর্মীয় সুরসুরি দিয়ে মানুষের ভাবাবেগ কে আঘাত করে এবং মানুষের ঐক্যবদ্ধ শক্তিকে ভাগ করে দুর্বল করে দেয়। এই কারণেই বর্তমান সময়ে পুজোতে সরকারি অনুদান, ইমাম ভাতা এসবের আমদানি ঘটেছে। এই কাজের লক্ষ্য না কোনো সামাজিক উন্নয়ন, না কোনো ধর্মের প্রতি আনুগত্য। দেবীর পুজো এবং ইমাম সাহেবরা কেউ সংকটে নেই ,সংকটে আছে শাসক। তাই তো তাঁরা নানা রকম প্রবাকান্ডা ছড়িয়ে জলকে ঘোলা করে সেই ঘোলা জলে মাছ ধরতে চাইছে। শুনলাম দুর্গাপুর থেকে পুজোতে সরকারি অনুদান দেওয়া নিয়ে নাকি কলকাতা হাইকোর্টে মামলা হয়েছে । সাধারণ মানুষ কেউ অনুদানের পক্ষে কেউ অনুদানের বিপক্ষে, ফলে সমাজে মানুষের মধ্যে একটা বিভাজন তৈরির হয়ছে ।
একটা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের অধীনে যে কোনো রাজ্যই হোক আর কেন্দ্রই হোক কোনো একটা নির্দিষ্ট ধর্মকে বাড়তি সরকারি সুবিধা কখনই দেওয়া উচিত নয় । আবার ঐদিকে দিল্লিতে ভারত মহাসভার সভাতে প্রকাশ্যে কেন্দ্রের শাসক দলের নেতার মুসলিম বয়কটের হুমকি দেওয়াও কাজ নয়, শাসকের কাজ হবে ধর্মনিরপক্ষেতার উপরে যেন আঘাত না আসে সেটা দেখা । রাষ্ট্রের কাজ হলো ধর্ম,বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত নাগরিকদের পরিষেবা দেওয়া, মানব সম্পদের উন্নয়নের পরিকল্পনা করা এবং তা কার্যকরি করা। সে সবের নাম নেই। সংবাদ মাধ্যমে আলোচনায় ওঠে আসছে কার্নিভালে কে কি বললেন, কারা কারা গেলেন, মোদিজি কোথায় কোথায় ভাষণ দিলেন- এসব। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন ঝালমুড়ি বিক্রি করতে,এ নিয়ে সমাজ মাধ্যমে ট্রোল হচ্ছে। কিন্তু আলোচনায় আসা উচিত যে রাজ্যে কত কর্মসংস্থান হয়েছে? কত বেকার স্নাতক হয়েও সরকারি চাকরি না পেয়ে টোটো চালাচ্ছেন? কত শিক্ষিত বেকার ঝালমুড়ি আর চপ-ঘুঘনি বিক্রি করছেন? শিল্পায়নে রাজ্যের অবস্থা এতোটা বেহাল কেন, এতে সরকারের জমি নীতি কতখানি দায়ী? মাথাপিছু দৈনিক আয় বাড়ছে না কেন? তোলাবাজি বন্ধ হবে কি করে? দুর্নীতি বন্ধ হবে কি করে? দেশের আর্থিক মন্দা কাটবে কি করে? দেশ কি করলে আরও এগোবে? শিশুদের অপুষ্টি বন্ধ হবে কি করলে? আজও কেন গর্ভবতী জননী অপুষ্টিতে ভোগেন এবং জননী সুরক্ষার জন্য কি কি করলে সন্তান ধারণকারী মায়েদের অপুষ্টি দূর হবে? দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ কে কিভাবে মানব সম্পদের উন্নয়নে কাজে লাগানো যাবে? কি করলে শিক্ষার সামগ্রিক বিকাশ হবে? এক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা কি? কোথায় ঘাটতি? কোথায় দুর্বলতা? এই সমস্ত বিষয় গণমাধ্যমে আলোচনায় আসা দরকার। কিন্তু সে ক্ষেত্রে যথেষ্ট ঘাটতি থাকছে । এর বড় একটা কারণ হলো সরকার গণমাধ্যম গুলিকে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ মনেই করছে না। গণমাধ্যমে কে সরকারের বিজ্ঞাপনের সংস্থায় পরিণত করার রাষ্ট্রীয় সক্রিয়তা লক্ষ্য যাচ্ছে । কোনো গণমাধ্যম শাসকের স্তাবকতা না করলেই সেই সংস্থাকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে, সরকারি বিজ্ঞাপন দেওয়া থেকে ছেঁটে দেওয়া হচ্ছে। এই সমস্ত লক্ষণ ফ্যাসিস্ট শাসকের মধ্যে থাকে । এখন সকলের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে বিচার করুন যে রাজ্যে কি ঘটছে, কেন্দ্রে কি চলছে এবং দুই শাসকের কার্যক্রম দেখে ফ্যাসিস্ট বলে মনে হচ্ছে কি না! যদি ফ্যাসিস্ট বলে মনে হয়,তাহলে আমাদের আগামীকালের কার্যক্রম কি হওয়া উচিত?
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct