খোঁজ
অশোক কুমার হালদার
____________________
মানুষের সমাজে প্রেমের এবং ভালোবাসার অটুট বন্ধনে মানুষ আবদ্ধ রয়েছে। ইহা এমন চিত্রনাট্য মানুষের মনের ভাবাবেগের সঙ্গে যুক্ত অনাদীকাল ধরে বর্তমান রয়েছে। যতদিন এই পৃথিবী থাকবে ততদিন পর্যন্ত মানুষের মনে রঙ্গ মঞ্চের মত স্থির বা মানুষের মন থেকে সরানো যায় না এমন চিত্র চিরকাল বলবৎ থাকবে সমাজ এবং সংসার জীবনে মানুষের মনের চিলেকোঠায় ইহাতে কোন সন্দেহ নাই। এই খোঁজ আগেই ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষত্যে থাকবে। এই খোঁজ ছন্দ নির্ণয় বা মাত্রা নির্দেশ করার মতো খোঁজ করা। সুকুমার বাবুর দুই পুত্র এবং এক কন্যা এবং স্ত্রী এই পাঁচ জনের সদস্যের সংসার রবি এবং ছবি দুই পুত্র, বড় পুত্র রবি এবং ছোট পুত্র ছবি। আর কন্যা কল্যাণী এবং সায়ন্তিকা সরকার স্ত্রী। পোতাশ্রয় যুক্ত শহরে তাদের বসবাস। একবার সমুদ্র বন্দরে একটা বড় মেলা হয়েছিল, সেই মেলায় সুকুমার সরকার বাবু সপরিবারে মেলা দেখতে গিয়েছিলেন। সেই খেলায় তার ছোট পুত্র ছবি হারিয়ে যায়। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। আর কোন সন্ধানী সংস্থা তার খোঁজ খবর দিতে পারেনি। তারপর সুকুমার বাবু হয়তো ভেবেছিলেন যে তার ছোট পুত্রকে কোন জলদস্যু হরণ করে নিয়ে গিয়েছে। তবুও তিনি অন্বেষণ করে চলেছেন। আর মনে মনে এই স্থির করেছেন যতদিন তিনি জীবিত থাকবেন ততদিন এই পুত্রের খোঁজ চালিয়ে যাবেন। সময় আসে, সময় চলেও যায়। কিন্তু নিভূতে এবং লুকায়িত অবস্থান মাতার মন কেঁদেই খুঁজে ফেরে সন্তানকে মনের মধ্যে। এই বেদনার উপশম করার কোন ঔষধ সৃষ্টি হয়নি আজ পর্যন্ত। এদিকে অবিরাম বাবু নিঃসন্তান তার স্ত্রী সুমতিকে নিয়ে ঐ পোতাশ্রয় বন্দরের সমুদ্রের মেলায় গিয়েছিলেন। আর ঐ মেলার ভেতরে ছোট ছেলে ছবি কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিল মেলার এক প্রান্তে। তখন ঐ নিঃসন্তান দম্পতি ঐ শিশু সন্তানকে নিয়ে একটি ডাক্তার বাবুর কাছে গিয়েছিলেন শিশুটির চিকিৎসার জন্য। ডাক্তারবাবু ঐ নিঃসন্তান দম্পতিকে বলেছিলেন যে শিশুটি কোন রোগে আক্রান্ত হয়নি। মা এবং বাবার কাছ থেকে ছাড়াছাড়ি হওয়ার কারণেই বাচ্চাটির মনের এই অবস্থা। এরপর ঐ নিঃসন্তান দম্পতি অনেক চেষ্টা করেছিলেন বাচ্চাটিকে তার মা-বাবার কাছে ফিরিয়ে দেবার। কিন্তু তারাও সফল হননি। এই রূপভাবে কিছুদিন অতিবাহিত হবার পর ছবির পূর্বের স্মৃতি যখন আস্তে আস্তে কমতে শুরু করলো, তখন থেকে নিঃসন্তান দম্পতিকেই পিতা মাতা বলে মেনে নিতে থাকলো।অন্যদিকে ঐ নিঃসন্তান দম্পতি ঐ কুড়িয়ে পাওয়া সন্তান নিজ সন্তান বলে লালন পালন করা শুরু করে ছিলেন। অবিরামবাবু ছিলেন শহরের সবথেকে বড় ব্যবসায়ী। এমনকি তার ব্যবসার বিস্তার সুদূর ইংল্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। একবার অবিরাম বাবু তার স্ত্রী সুমতিকে বললেন যে ব্যবসায়ের কারণে তাকে ইংল্যান্ড যেতে হবে। সুমতি বললেন যে তাহলে সপরিবারে আমাদের যেতে হবে ইংল্যান্ড সঙ্গে ছবিকে নিয়ে। এখনতো সে অনেকটা বড়ও হয়েছে। তাকে কোন ইংল্যান্ডের ভালো কলেজে ভর্তিও করা যাবে তাতে করে তার পড়াশোনার কোন অসুবিধা না হয়। ছবি সহ ঐ দম্পতি ইংল্যান্ডের পথে যাত্রা শুরু করে দিলেন। ইংল্যান্ডে পৌঁছে ছবিকে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করে দিলেন। আর অবিরাম বাবুও আপন ব্যবসায় মন দিলেন। এই ভাবে চলতে শুরু করলো।
এদিকে সুকুমার বাবুর পাঁচ সদস্যের মধ্যে ছোট ছেলে হারিয়ে বুক ভরা ব্যথা নিয়ে সংসারে রয়েছেন কিন্তু এখনই সেই দিনের স্মৃতি মন থেকে হারিয়ে যায়নি। এখন শুধু মনের সঙ্গে ছেলের খোঁজের অন্বেষণ চলছে এবং কখন কখন হতস্থত ভাবে সম্ভাব্য স্থলে খোঁজ খবর নিয়ে চলেছেন। আর অন্যদিকে মাতা ছেলে হারানোর বিরল বেদনায় শুধুই চোখের জল সম্বল করে দিন অতিবাহিত করছেন। আর সঙ্গে রয়েছে আকস্মিক বা অহেতুক ভয়। বর্তমান ছেলে মেয়েদের দৃষ্টি অগোচর হতে দেন না। একটু যদি ছেলে মেয়ে দৃষ্টির অগোচরে চলে যায় তখনই সন্দেহবাদী মন পূর্বের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। যাহা মাতৃ মনে অসহনীয়। এদিকে রবিও বড় হয়ে একটা সরকারী সংস্থায় কর্তব্যরত অবস্থায় কর্তব্য করে চলেছেন। আর সেই সঙ্গে ভাইয়ের হারিয়ে যাওয়ার খোঁজ করে চলেছেন যাতে করে ভাইকে আবার ফিরে পাওয়া যায়। এদিকে মা তার শিশু সন্তানকে হারিয়ে চোখের জলে দিন অতিবাহিত করছেন। এই রকম চলার ফলে মায়ের চোখের সমস্যা শুরু হয়ে গেল। কিছুদিন পর মা আর চোখে দেখতে পায় না। তখন রবি বড় ছেলে তার মাকে বললো যে তোমার চোখের চিকিৎসা করাতে আমি তোমাকে চেন্নাই নিয়ে যাবো। কারণ সেখানে একজন চোখের ডাক্তার বিদেশ থেকে এসেছেন খুব ভালো চোখের চিকিৎসা করছেন, তার কাছেই তোমাকে তোমার চোখের চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাব ভাবছি। আর ঐ কারণে আমি সকল বন্দোবস্ত করে ফেলেছি। সামনের মাসেই ঐ ডাক্তার বাবুর কাছে তোমাকে নিয়ে যাব। যেই রূপ কথা সেই রূপ কাজ মাসের ঐ নির্দিষ্ট দিনে রবি তার মাকে ঐ বিলেত ফেরত ডাক্তারের কাছে মায়ের চোখের চিকিৎসার জন্য নিয়ে গেলেন। হ্যাট, কোট পরা ডাক্তার ভাই ছবিকে রবি চিনতে পারেনি প্রথম দিন প্রথমবার। ছবি তার মাকে প্রথম দিন চিকিৎসায় চিনতে পারেনি। আর মা তো ভালোভাবে চোখে দেখতে পাচ্ছিলেন না। কিন্তু দ্বিতীয় বারে চিকিৎসা করাতে গেলে মা তার হারিয়ে যাওয়া ছেলের চেহারা ঐ বিলেত ফিরোত ডাক্তারের মধ্যে দেখতে পেলেন। মায়েদের শুধু বহিঃদর্শনই থাকে না অন্তদর্শনও প্রখর থাকে।
তাই তার হারিয়ে যাওয়া ছেলেকে চিনতে কোন অসুবিধা হয়নি দ্বিতীয় দেখায়। কারণ একট কালো তিল চিহৃ তার ছোট ছেলে ছবির চিবুকের উপরে ছিল ছোটবেলায় থেকেই। সেই তিল চিহৃই মা ও তার সন্তানের মধ্যে মিলন সেতু গড়ে দিয়েছিল। মা সায়ন্তিকা ঐ চোখের চিকিৎসককে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, যখন চিকিৎসক ঐ রোগী চোখের পরীক্ষা নিরীক্ষা করছিলেন। এমন সময় ঐ রোগী চিকিৎসককে বললেন, বাবা তোমার বাড়ি কোথায়? তোমার পিতার নাম কী? তখন ঐ চিকিৎসক রোগীকে উদ্দেশ্য করে বললেন মা এ সব জানার কি প্রয়োজন? উত্তরে রোগী বললেন যে বাবা, অনেকদিন আগে তোমার মত দেখতে আমার একটি সন্তান মেলাতে হারিয়ে গিয়েছিল। কত খোঁজাখুঁজি করার পরেও আজও তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। আর তারপর থেকে শুধুই চোখের জল সম্বল করে আজও তাকে অন্তর আত্মার মধ্যে খোঁজ করে চলেছি। হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত যা বয়স, তাতে আমার মনে হচ্ছে যে তোমার বয়সের মতোই বয়স হবে। আর দেখতে তোমার মতই হতো আমার হারিয়ে যাওয়া ছেলেটি। হ্যাঁ আর একটা তিল চিহৃ ছিল সেই হারিয়ে যাওয়া ছেলেটির চিবুকের উপরে। আর তোমারও মুখ মন্ডলের চিবুকের উপরে ঠিক ঐ রকমই তিল চিহৃ রয়েছে। এই কথা শুনে ছবি অর্থাৎ ডাক্তার বাবুর পূর্বের স্মৃতি মনে এসে গেল। তখন সে বললো। হ্যাঁ আমি মেলার মধ্যে বাবা-মাকে হারিয়ে এক সময় কাঁদতে, কাঁদতে মেলার এক কোণে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তখন এক নিঃসন্তান দম্পতি শ্রী অবিরাম কোলে এবং স্ত্রী শ্রীমতী সুমতি দেবী আমাকে পিতা ও মাতার মতো আদর, যত্ন, স্নেহ, ভালোবাসা দিয়ে এবং লেখাপড়া শিখিয়ে আজ আমাকে ডাক্তার বানিয়েছেন বর্তমানে স্বর্গীয় অবিরাম কোলে ইংল্যান্ডে বসবাসকালীন অবস্থায় দেহ ত্যাগ করেছেন। কিন্তু মাতা সুমতি দেবী এখন জীবিত রয়েছেন। আর এইভাবেই চিকিৎসা করাতে এসে, গর্ভধারণী মাতা চোখের আলোর রশ্মি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুত্রের সন্ধান পেয়ে গেলেন।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct