ইতিহাসের অনাচার সাম্প্রদায়িকতায় ইন্ধন
মজিবুর রহমান
(প্রধানশিক্ষক, কাবিলপুর হাইস্কুল,কাবিলপুর, সাগরদিঘি, মুর্শিদাবাদ)
ইতিহাসের জনক গ্ৰীক পণ্ডিত হেরোডোটাস (খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৪-৪২৫) তাঁর গ্ৰীস ও পারস্যের মধ্যে সামরিক সংঘাত নিয়ে লিখিত পুস্তকের নামকরণ করেন ‘হিস্টোরিয়া’ (Historia), যার অর্থ সত্যের অনুসন্ধান। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, গ্ৰীক ‘হিস্টোরিয়া’ থেকেই ইংরেজি ‘হিস্ট্রি’ (History) উদ্ভব হয়েছে।বাংলা ভাষায় ‘ইতিহাস’ শব্দটির সন্ধিবিচ্ছেদ করে পাওয়া যায়:ইতিহ+আস। ‘ইতিহ’ শব্দের অর্থ ঐতিহ্য; অতীতের শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, এককথায়, জীবনচর্চা যা ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষিত থাকে তাকেই ঐতিহ্য বলে। এই ঐতিহ্যকে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেয় ইতিহাস। অতীত ছাড়া বর্তমানের নির্মাণ সম্পূর্ণতা লাভ করে না।তাই ইতিহাসের মাধ্যমে অতীত দিনের কথা জানা জরুরি। কিন্তু যেকোনও ঘটনাকে একাধিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার সুযোগ থাকে বলে একই ঘটনার নানান ব্যাখ্যা হওয়া সম্ভব। এখানেই ইতিহাসের মজা; ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে কখনও তর্ক-বিতর্কের অবসান ঘটে না। কিন্তু সমস্ত যুক্তি-পাল্টা যুক্তির প্রর্দশন সত্যানুসন্ধানের লক্ষ্যে হওয়া উচিত।পুরনো দিনের বিকৃত, বিদ্বেষপূর্ণ ঘটনার ঘনঘটা বর্তমান সময়ের সম্প্রীতি নষ্ট এবং ভবিষ্যতে সদ্ভাব সৃষ্টির পথ রূদ্ধ করে। দুর্ভাগ্যবশত, ভারতের ইতিহাস চর্চায় সচেতন ভাবে সত্যের বিকৃতি ঘটানো হয়েছে।লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এই ইতিহাস বিকৃতির জন্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের পাশাপাশি দেশীয় ঐতিহাসিকদের সাম্প্রদায়িক মনোভাবই মূলত দায়ী। সব সম্প্রদায়ের মানুষের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনকে যথাসম্ভব সহজ, স্বাভাবিক ও শান্তিপূর্ণ রাখতে ইতিহাসের এই অনাচার বন্ধ হওয়া দরকার। বর্তমান নিবন্ধে আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠ্য ইতিহাসের দু-চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিকৃতি তথা মিথ্যাচারের প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ যেমন দীর্ঘদিন ভারত শাসন করেছে তেমনি ভারতের প্রচলিত ইতিহাসও তারাই রচনা করেছে। বিভ্রাট বা বিকৃতির সূত্রপাতও সেখান থেকেই। প্রখ্যাত ব্রিটিশ ঐতিহাসিক জেমস মিলের (১৭৭৩-১৮৩৬) একটি বিখ্যাত বই ‘ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাস’। প্রায় বারো বছর ধরে লেখা মিলের এই পুস্তকটি প্রকাশিত হয় ১৮১৭ সালে। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, মিল কখনও ভারতে আসেননি। ভারত ভ্রমণ না করেই ভারতের একটা আস্ত ইতিহাস লিখে ফেলেন তিনি! এই গ্ৰন্থে ভারতীয় সভ্যতাকে তিনটি পর্বে ভাগ করা হয়: হিন্দু যুগ, মুসলিম যুগ ও ব্রিটিশ যুগ। অর্থাৎ, প্রথম দুটি পর্যায়ের নামকরণ শাসকের ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে আর তৃতীয়টি শাসকের জাতির নামে। এই ত্রুটিপূর্ণ ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পর্ব-বিভাজনে ব্রিটিশ-পূর্ব ভারতকে হিন্দু ও মুসলিম যুগে দ্বি-বিভাজিত করে ভারতের বহুধর্মীয় চরিত্রকে অস্বীকার করা হয়েছে। মনে রাখা দরকার, তথাকথিত হিন্দু যুগেও (খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ) মৌর্য, শক, কুষাণ প্রভৃতি বহু অহিন্দু রাজবংশের প্রবল অস্তিত্ব ছিল। এখানে ‘হিন্দু’ শব্দের উদ্ভব নিয়ে দু-এক কথা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না।মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানরা অষ্টম শতাব্দীতে সিন্ধু নদের উপকূলে বাণিজ্য করতে আসে। আরবিভাষীদের মুখে সাধারণত ‘স’-এর উচ্চারণ হয় ‘হ’।সেজন্য ঐ অঞ্চলের অধিবাসীদের আরবের বণিকরা ‘হিন্দু’ বলে অভিহিত করতো।সেই হিসেবে ‘হিন্দু’ শব্দটির উদ্ভবে মুসলমানদের অবদানই বেশি।সনাতন ধর্মবিশ্বাসীদের বোঝাতে হিন্দু শব্দের ব্যবহার শুরু হয় ঊনবিংশ শতাব্দীতে। মিলের পর্ব-বিভাজনে মুসলিম শাসনে ভারতীয় উপমহাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ অমুসলমান প্রজা তথা হিন্দু ধর্মাবলম্বী সাধারণ মানুষের উপস্থিতি ও তাদের সামাজিক প্রভাবের কথা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে।ব্রিটিশ ঐতিহাসিকের বিভ্রান্তিকর পর্ব-বিভাজনকে পরিবর্তন করে এখনকার পাঠ্যপুস্তকে প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগ করা হয়েছে।এটি অবশ্যই একটি সঠিক পদক্ষেপ।
স্যার যদুনাথ সরকার ও ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ মূল ধারার ভারতীয় ঐতিহাসিকরা মধ্যযুগের মুসলিম শাসনকে ‘বিদেশি শাসন’ হিসেবে অভিহিত করেন। সেই ধারা অনুসরণ করে আজও অনেকেই মুসলমানদের ষোলো আনা স্বদেশী হিসেবে গ্ৰহণ করতে আপত্তি করে।একটা ঐতিহ্যশালী জনগোষ্ঠীকে কোনো ভূখণ্ডে কয়েক শতাব্দী ধরে বসবাস করার পরও ‘আইডেন্টিটি ক্রাইসিস’-এ ভুগতে হলে তা যেমন সেই জনগোষ্ঠীকে হতাশ করে তেমনি সেই ভূখণ্ডকেও দুর্বল করে।তুর্কি, পাঠান, মোঘল প্রভৃতি বহিরাগত মুসলিম শাসকেরা ভারত বিজয়ের পর কিন্তু তাদের পুরনো স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেনি। উপমহাদেশেই স্থায়ীভাবে থেকে গেছে।কবির কথায় তারা ‘ভারতের মহামানবের সাগরতীরে...এক দেহে লীন’ হয়ে গিয়েছিল। তাহলে তাদের আর বিদেশী বলা হবে কেন? আর্যরাও উপমহাদেশের আদি বাসিন্দা নয়। তারা বাইরে থেকে এই ভূখণ্ডে এসেছিল। কিন্তু তাদের তো বিদেশী বলা হয় না! আত্মীয়কে অনাত্মীয় মনে করলে মানসিক দূরত্ব বাড়ে; ঐক্যসাধনের প্রচেষ্টা ব্যাহত হয়। উপমহাদেশে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা তথা ইসলামের প্রসারের পেছনে একটি বহুল প্রচারিত ভাষ্য হল- এক হাতে কোরান অন্য হাতে তরবারি।তাই প্রতিহিংসার অগ্নিকুণ্ডের সামনে দাঁড় করিয়ে আজও মুসলমানদের প্রতি ফতোয়া নিক্ষিপ্ত হয়- কোরান ছাড়ো না হয় ভারত ছাড়ো। কিন্তু মুসলিম শাসকের সাথে ইসলাম ধর্মকে অভিন্ন করে দেখার মধ্যেই একটা অসঙ্গতি রয়েছে। আমাদের মনে রাখা দরকার, সরাসরি ইসলাম ধর্মের প্রচার, প্রসার ও প্রতিষ্ঠার জন্য আরব দুনিয়ায় যুদ্ধ হয়েছে সপ্তম শতাব্দীতে। সেই সব যুদ্ধে পয়গম্বর হজরত মুহাম্মদ সা. এবং তাঁর অনুগামী মক্কা-মদিনার খলিফারা নেতৃত্ব দিয়েছেন। সেগুলোই ছিল ইসলামের ধর্মযুদ্ধ। পরবর্তী কালে সংঘটিত আর কোনও যুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি ধর্মের যোগ নেই। মধ্যযুগে বিদেশি মুসলিম শাসক, সম্রাট বা সুলতানরা কেউই এদেশে ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে আসেননি।সাম্রাজ্য বিস্তারের সাধারণ লক্ষ্য নিয়েই তাঁরা এই এলাকা আক্রমণ করেছেন।আরব দুনিয়ার মতো এখানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি। ধর্মগ্ৰন্থ সংবিধানের জায়গা দখল করেনি। দৈনন্দিনকার শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে শাসকদের নিষ্ঠা সহকারে ইসলামী রীতি বা শরিয়ত অনুসরণ করতে দেখা যায়নি।ব্যক্তিগত জীবনে যিনি যতটুকু পেরেছেন ধর্ম পালন করেছেন। ধর্মবিরোধী অনেক কাজও করেছেন তাঁরা।কাজেই, এক হাতে কুরআন অন্য হাতে তরবারি- এই ভাষ্যের মধ্যেই একটা ভ্রান্তি রয়েছে। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার সময় ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হয়েছিল এবং তাতে বিপুল সংখ্যক হিন্দু প্রাণ হারিয়েছিলেন- এমন বক্তব্যও ঠিক নয়। আবার, মুণ্ডচ্ছেদের ভয়ে এই অঞ্চলের মানুষেরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুসলমান হয়েছিলেন- এমন ব্যাখ্যারও যুক্তিগ্ৰাহ্য ভিত্তি নেই।বিপান চন্দ্র,রোমিলা থাপার, হরবংশ মুখিয়া, ইরফান হাবিব প্রমুখ ঐতিহাসিকের গবেষণা প্রমাণ করেছে, তুর্কিদের ভারত অভিযানের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের কোনো প্রতিরোধ গড়ে ওঠেনি। বরং নতুন শাসনব্যবস্থার নিম্নস্তরে স্থানীয় হিন্দুরা আগের মতোই যুক্ত থেকেছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের সমর্থন ও সহযোগিতা ছিল বলেই বহিরাগত বিধর্মীদের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিল। হিন্দুদের ইসলাম ধর্ম গ্ৰহণের ব্যাপারে দেখা যায়, হিন্দু ধর্মের জাতিভেদ প্রথাই মূলত এর জন্য দায়ী। সেই সময় নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ধর্মপালনের কার্যত কোনো অধিকারই ছিল না।বেদ পাঠ করা তো বটেই এমনকি তা শ্রবণ করাও তাদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল।বেদ পড়ার ‘অপরাধে’ তথাকথিত ছোট জাতের জিভ কেটে নেওয়া এবং বেদপাঠ শুনলে কানে উত্তপ্ত শিসা ঢুকিয়ে দেওয়ার মতো অত্যন্ত কঠিন শাস্তি প্রচলিত ছিল। হিন্দু সমাজে তাদের স্থান ছিল খুবই অমর্যাদার।একেবারে মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হত তারা। চরম অপমান, উপেক্ষা ও অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে প্রধানত নিম্নবর্ণের শূদ্ররাই হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে জাতপাতমুক্ত ইসলাম ধর্ম গ্ৰহণ করে। এজন্য হিন্দু ধর্মের সুবিধাভোগী অংশ অর্থাৎ ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়দের মুসলমান হওয়ার তেমন দৃষ্টান্ত নেই। শুধু অন্তজ্য শ্রেণীর হিন্দু নয়, ব্রাহ্মণ্যবাদীদের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে বহু বৌদ্ধ ভিক্ষুকও ইসলামের আশ্রয় নেয়। মৌলভীর দাড়ি, পুরোহিতের টিকির মতো বৌদ্ধ পণ্ডিতরা সাধারণত মুণ্ডিতমস্তক হতেন। এজন্য ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর তাদের পরিচয় হত ‘নেড়ে মুসলমান’। সেই সূত্রেই মুসলমানদের গালি দেওয়ার জন্য আজও ‘ম্লেচ্ছ’, ‘যবন’-এর সঙ্গে ‘নেড়ে’ কথাটা ব্যবহার করা হয়।প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, হিন্দু ধর্মের জাতিভেদ প্রথা প্রাচীন ও মধ্যযুগ পার করে আধুনিক যুগেও সক্রিয় রয়েছে। হরিজনদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য মহাত্মা গান্ধীর আন্দোলন সম্পর্কে আমরা সকলেই অবগত।স্বাধীন ভারতের সংবিধানের রূপকার ডঃ বি আর আম্বেদকরের হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে বৌদ্ধ ধর্ম গ্ৰহণ করার কথাও সকলের জানা। পশ্চিমবঙ্গ সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় এখনও আদিবাসী ও দলিতদের খ্রিস্টান হওয়ার খবর পাওয়া যায়।স্বসম্প্রদায়ের পীড়ন আর ভিন সম্প্রদায়ের প্রলোভন মিলেই সাধারণত ধর্মান্তকরণ সংঘটিত হয়ে থাকে। সম্প্রতি হিন্দুত্ববাদীরা ‘ঘর ওয়াপসি’র নামে কিছুটা জোরপূর্বক ধর্মান্তকরণের কর্মসূচি গ্ৰহণ করছে।
আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রচলিত ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকে একটি সরল সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়- মুসলিম শাসনে প্রচুর মন্দির ধ্বংস করা হয়েছিল।তাই কয়েক শতাব্দী পূর্বে রাজতন্ত্রের যুগে তথাকথিত মন্দির ধ্বংসের প্রতিশোধ নিতে আজকের গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে মসজিদ ভাঙার ষড়যন্ত্র চলে।আর, বিজ্ঞান প্রযুক্তির আধুনিক যুগে মসজিদ-মন্দিরের ধর্মীয় বেড়াজালে ভারতীয় সভ্যতা আটকে থাকে। অর্ধসত্য কখনও কখনও ডাহা মিথ্যার থেকেও ক্ষতিকর হতে পারে। মুসলমান আমলে মন্দির ধ্বংসের অভিযোগের ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটেছে। ঘটনা হল, অভিযুক্ত শাসকেরা যেমন মন্দির ভেঙেছেন তেমনি মসজিদ, মঠও ভেঙেছেন। মন্দির, মসজিদ ও মঠ নির্মাণে রাষ্ট্রের তরফে ভূমিদান ও অর্থসাহায্য করার দৃষ্টান্তও রয়েছে। মুসলমান শাসকদের মতো হিন্দু শাসকদেরও ধর্মশালা নিয়ে কমবেশি একই নীতি গ্ৰহণ করতে দেখা গেছে।যেমন, কাশ্মীরের হিন্দু রাজা হর্ষদেব (রাজত্বকাল ১০৮৯-১১০১) ‘দেবোৎপাটন নায়ক’ নামক একশ্রেণীর রাজকর্মচারী নিযুক্ত করেছিলেন, যাদের দায়িত্ব ছিল হিন্দু মন্দির ও দেবমূর্তি লুন্ঠন বা ধ্বংস করা। আসলে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে রাজা-বাদশারা ধর্মস্থানে আঘাত হেনেছিলেন মূলত আর্থিক, সামরিক বা রাজনৈতিক কারণে; ধর্মীয় কারণ নিতান্তই গৌণ ছিল। তখনকার দিনে বিভিন্ন মঠ-মন্দির-মসজিদে স্থানীয় প্রভাবশালীদের হিসাব বহির্ভূত ধনসম্পদ এবং বেআইনি অস্ত্র লুকিয়ে রাখার রেওয়াজ ছিল। স্বাভাবিক কারণেই সেগুলোর বিরুদ্ধে শাসকেরা কড়া পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করতেন না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, জার্নাল সিং ভিন্দ্রানওয়ালের নেতৃত্বাধীন বিচ্ছিন্নতাবাদী খালিস্তান আন্দোলন দমন করার জন্য ১৯৮৪ সালের জুন মাসে শিখ ধর্মের সবচেয়ে পবিত্র তীর্থস্থান পাঞ্জাবের অমৃতসর স্বর্ণমন্দিরে সেনা অভিযান চালানো হয়, যার পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন ব্লু স্টার’। শিখ ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ নয়, দেশের অখন্ডতা রক্ষার স্বার্থেই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে এই পদক্ষেপ করতে হয়েছিল। অবশ্য জুন মাসের ঐ সামরিক অভিযানের প্রতিক্রিয়াতেই ৩১শে অক্টোবর শিখ দেহরক্ষীদের গুলিতে শ্রীমতী গান্ধী প্রাণ হারান। আমাদের ইতিহাস বইগুলোতে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগের প্রধান প্রবক্তা হিসেবে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকে (২৫.১২.১৮৭৬-১১.৯.১৯৪৮) কাঠগড়ায় তোলা হয়। কিন্তু উপমহাদেশে হিন্দু ও মুসলমানকে পৃথক জাতিতে বিভক্ত করার প্রধান পথিকৃৎ হিসেবে বিনায়ক দামোদর সাভারকরের (২৮.৫.১৮৮৩-২৬.২.১৯৬৬) ভূমিকা নিয়ে কথা হয় না। মন্দের আলোচনা কম হওয়াই ভালো; কিন্তু সব দোষ কেবল নন্দ ঘোষের উপর চাপিয়ে দেওয়াও সঙ্গত নয়।মুসলিম লীগ যখন মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের দাবি করছিল হিন্দু মহাসভা কি তখন মুসলমানমুক্ত ভারত পুনর্গঠনের ভাবনায় উজ্জীবিত ছিল না ? ধর্মীয় পরিচয়ভিত্তিক সংগঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলে মুসলিম লীগ গঠিত হয় ১৯০৬ সালে আর হিন্দু মহাসভা গঠিত হয় ১৯১৫ সালে। স্বসম্প্রদায়ের স্বার্থরক্ষার উপর জোর দেওয়ার পাশাপাশি ভিন সম্প্রদায়ের সঙ্গে দূরত্ব তৈরির অপচেষ্টাও চলতে থাকে। জিন্নাহ যখন কংগ্রেস ত্যাগ করে (১৯২০) মুসলিম লীগে যোগদান করছেন, তখন হিন্দু মহাসভার সভাপতি সাভারকারের ‘হিন্দুত্ব’(১৯২৩) প্রকাশ হচ্ছে। ৩০ ও ৪০-এর দশকে জিন্নাহ যখন পাকিস্তান পাওয়ার জন্য প্যাঁচ কষছেন, সাভারকার তখন ভারতে ‘হিন্দুরাষ্ট্র দর্শন’-এর পাঁক ঘাঁটছেন। জিন্নাহরা খুশি হয়েছেন হিন্দুদের প্রভাবমুক্ত পাকিস্তান পেয়ে আর সাভারকাররা খুশি হয়েছেন হীনবল মুসলমান সহ হিন্দুস্তান পেয়ে। উগ্ৰ হিন্দুত্ববাদীরা এখনও মাঝেমধ্যে ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের দুটি ঠিকানার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়- পাকিস্তান না হয় গোরস্তান। পাকিস্তান-বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুরাও মুসলিম মৌলবাদীদের কাছ থেকে একই রকম ফতোয়া শুনতে অভ্যস্ত- শ্মশান না হয় হিন্দুস্তান। সাম্প্রদায়িকতায় ইন্ধন যোগায় এমন উপাদানকে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা দরকার। বর্তমানকে বিব্রত করে এমন অতীতকে অস্বীকার না করলেও তাকে আদর করা যায় না। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতা দখল করা অথবা ধরে রাখার জন্য বিকৃত ইতিহাসের আশ্রয় নেওয়া অন্যায়। সকল ভারতবাসীর লক্ষ্য হওয়া উচিত ‘মহান ভারত’ গড়ার রসদ সন্ধান। ভারতের ধর্ম-সম্প্রদায়ের সংখ্যাধিক্যকে সমস্যা নয়, শক্তি ও সৌন্দর্যে রূপান্তরিত করতে হবে। আমাদের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়েই মাতৃভূমির শক্তি ও সৌন্দর্যকে বৃদ্ধি করার গুরুদায়িত্ব পালন করতে হবে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct