সময়ের স্বরলিপি
মুসা আলি
___________________
অধ্যায় ১১ কিস্তি ১
মসলন্দপুরে নাটক প্রতিযোগিতায় পরাজয়ের পর প্রশান্ত মাষ্টারের ডাকা ঘরোয়া মজলিসে নতুন মূল্যায়ন শুরু হয়েছে। সেখানেই দেখা গেছে আলিম নামে এক বৃদ্ধের উপস্থিতি। কে এই আলিম? এ উপন্যাসে দ্বান্দ্বিক সূত্রের সঙ্গে তার সম্পর্ক কী? তা নিয়ে কুশিলবরা কী সকলে একমত? ভিতরে বহুজাতিক সংস্থার দেশবিরোধী কালো ছায়া দেখেও পল্লব তা কাউকে বলতে পারল না কেন? প্রশ্ন অনেক। পড়তে পড়তে উত্তরগুলো জানুন।
গণনাট্যের গতিপ্রকৃতিনিয়ে ব্যাঙ্গালোরের সেমিনারে বসে পল্লব দাশ কেবল ভাবছিল, এত কঠিন সময়ে এলাকা ছেড়ে চলে এসে ঠিক করে নি সে। অবশ্য জীবনের নাটকীয় দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে যে সূক্ষ্ম আলোচনা চলছে, তা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। নতুন নাটক লিখতে গেলে এগুলো বেশ কাজে লাগবে। শেষে ভাবল, শুধু শুধু দুর্ভাবনা করে লাভ নেই। যদি কিছু অঘটন ঘটে, এত দূর থেকে তা নিয়ন্ত্রণ করা তার পক্ষে কোনোক্রমে সম্ভব নয়।
টানা এক সপ্তাহ ব্যাঙ্গালোর সেমিনারে বসে সময় কাটানোর পরে ট্রেনে উঠে বসল বাড়িতে ফেরার উদ্দেশ্যে। কেবল মনে হতে লাগল, সোপান নিয়ে। জিৎ-এর প্ররোচনায় ইতিমধ্যে নতুন কিছু ঘটে যায় নি তো? পরের দিন দুপুর একটার মধ্যে বাড়িতে ফেরার পরে পল্লবের ভিতরের টানাপোড়েন বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেল। সন্ধেয় সোপানের ঘরে উপস্থিত হওয়ার জন্যে ভিতরে ভিতরে ছটফট করতে লাগল। স্নান খাওয়া সারতে সারতে বিকেল তিনটে। উঠোনে দাঁড়িয়ে দেখল, দুপুরের সূর্য পশ্চিম দিকে অনেকখানি ঢলে পড়েছে। আবার ঘরের ভিতরে এসে বিছানায় শরীর মেলে দিয়ে সময় গুণতে থাকল। মনের গতির সাথে কিছুতেইপাল্লা দিতে পারছিল না। কেবল মনে হতে লাগল, দিনের মায়া ত্যাগ করে সরে পড়তে সূর্য অহেতুক দেরী করছে। শ্লথ গতির জন্যে বেশ বিরক্ত হল পল্লব। দূরের মাঠে শেষ লালিমা ছড়িয়ে পড়ার দৃশ্য দেখে দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করল। সোপান নাট্যসংস্থার সামনে উপস্থিত হয়ে দেখল, আসিফ আনমনে দাঁড়িয়ে। পল্লবের প্রথম প্রশ্ন, কেমন আছিস্ রে ? মাসিমার শরীর ভালোতো?
হাঁপানির টান হঠাৎ বেড়েছে, ওষুধপুত্র খাইয়ে তেমন কিছু হচ্ছে না।
নতুন কিছু খবর?
রফিক আমাদের গ্রুফ ছেড়ে চলে গেছে।
কী বলছিস তুই?
গেলে তো কিছুই করার নেই।
কোনো কারণ জানতে পারলি?
খুব সম্ভব জিৎ-এর পাল্লায় পড়েছে।
আন্দাজ করে বলছিস?
রফিক তোমার জন্যে একটা চিঠি লিখে গেছে।
পল্লব ব্যস্ত হয়ে বলল, দে আমাকে।
পড়লে সব কিছু জানতে পারবে।
পল্লব চোখ বোলাতে শুরু করল—
প্রিয় পল্লবদা,
জীবন যে কত বিচিত্র হতে পারে, কদিনেই তা টের পেয়েছি। মাঝে মাঝে মানুষকে একেবারে অপছন্দের দিককে কীভাবে গ্রহণ করতে বাধ্য হতে হয়, সেই অভিজ্ঞতাও লাভ করেছি। সামনে বোনের বিয়ে। তুমিও জানতে, আমি তা নিয়ে কত বেশি বিব্রত হয়ে ছিলাম। আসলে মাথার উপরে আব্ব না থাকায় সব ঝুঁকি আমার উপর এসে পড়েছে। পরমেশ্বরকে ধন্যবাদ, শেষ পর্যন্ত জিৎ-এর মাধ্যমে একটা সমাধান সূত্র খুঁজে পেয়েছি। মন খুলে স্বীকার করছি, ওর সাহায্য না পেলে এই আলোটুকু লাভ করা সম্ভব হত না। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে একটু আলোর ঝলকানি কত না আশার সঞ্চার করে। সেই আশা বুকে জড়িয়ে নতুন পথে হাঁটতে বাধ্য হয়েছি। বিশ্বাস করো, তোমাকে ছেড়ে আসতে কিছুতেই মন চাচ্ছিল না কিন্তু দ্বিতীয় পথও খোলা ছিল না। সোপান ছাড়ার প্রশ্নে তোমাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি ভেবেছি। আমার কাঁধে হাত রেখে তুমিই বলেছিলে, আরেকটু চেষ্টা করলে দিব্যি ভালো অভিনয় করতে পারবি। সেকথা আজও ভুলি নি। মসলমপুরে একাঙ্ক নাটক প্রতিযোগিতায় সোপান হেরে গিয়েছিল কিন্তু অভিনয়গুণের জন্যে আমি বিশেষ পুরস্কার পেয়েছিলাম। সবই আজ স্মৃতি। তবুও চিঠি লেখার সময় চোখের জলকিছুতেই বাগ মানছে না।কয়েক ফোটা ঝরে পড়ল তোমার উদ্দেশ্যে লেখা পত্রের উপর। কিছুতেই ভিতরের কান্না চেপে রাখতে পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত তোমাকে ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হলাম। এ অক্ষমতার জন্যে পারলে ক্ষমা করে দিও। পত্র লেখার শেষে কেবল মনে হয়েছে, সামনাসামনি দেখা হলে মাথা উঁচু করে দাঁড়াব কোন মুখে? আগে শুনেছি, অভাব মানুষের মনকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়, এখন দেখছি, তা মুখের ভাষাও কেড়ে নিতে পারে, মাথা নীচু করে চলতে বাধ্য করতে পারে। সেই যন্ত্রণা আমার জীবনে শুরু হয়ে গেছে পল্লবদা।
ইতি—
তোমার নাট্যভাবনা বঞ্চিত রফিক।
গুম হয়ে বসে থাকল পল্লব। একটা সূক্ষ্ম অনুভূতি বার বার ছুঁয়ে যেতে লাগল। আর্থিক অনটনের কারণে এমন একটা টগবগে ছেলে শেষ পর্যন্ত নিজেকে বিলিয়ে দিতে বাধ্য হল। ভাবতে কষ্ট হচ্ছিল পল্লবের। দুচোখ স্থির করে চেয়ে থাকল আসিফের দিকে।
আরেকটা জবর খবর আছে পল্লবদা।
অকপটে বলতে পারিস। বিপদ কখনো একা আসে না। মনে হচ্ছে, খারাপ খবরের সিরিজ চলে আসতে পারে।
সমগ্র এলাকা জুড়ে এতদিনের তৈরি হওয়া সম্প্রীতিতে হঠাৎ যেন টান পড়েছে।
এসব কি বলছিস তুই?
যা বলছি, সবই সত্যি পল্লবদা। হিন্দু মহল্লাগুলোতে সম্প্রীতি ভাঙার জন্যে ভজুজ্যেঠু নিজেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ইতিমধ্যে কয়েক হাজার হ্যাণ্ডবিল ছড়ানো হয়ে গেছে। মাইকেও প্রচার চালানো হচ্ছে। ক্রিকেট ম্যাচ চলাকালীন নাকি কিছু মুসলিম যুবক ভারতকে ভুলে পাকিস্তানকে সমর্থন করে বসেছে। জাতীয় ভাবনা বিরোধী এ মনোভাব রুখতে ছড়ানো হ্যাণ্ডবিলে নানা ধরণের যুক্তি সাজানো হয়েছে। প্রয়োজন হলে পাল্টা আক্রমণে যাওয়ার জন্যে মাইকে বার বার আহ্বান জানানো হচ্ছে।
পল্লব একটু হাসল। দারুণ বিপর্যয়ের মধ্যে মৃদু হেসে নিজেকে শক্ত করে নেওয়ার অভিনব কৌশল। আসিফের গায়ে আঙুলের টোকা দিয়ে বলল, তাহলে গ্রেডবাবু নতুন ইস্যু নিয়ে এভাবে লেগে পড়েছেন?
গতকাল বিকেলের ঘটনাটা আরও গুরুতর। শুনলে ভিতরের ছবিটা তোমার কাছে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
পল্লব আবার চোখ তুলে তাকাল আসিফের দিকে। কেমন যেন এক অদ্ভুত বিমূঢ়তা দ্রুত গ্রাস করল তাকে। মাত্র ক’টা দিনে এত সব পরিবর্তন ঘটে গেল?
তুমি তো ওমর ফারুক স্যারকে চেনো। ইংরেজির শিক্ষক। রতনপুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। গত পরশু স্কুল সেরে বাড়িতে ফিরছিলেন। হঠাৎকরে কয়েকজন এসে তাকে ঘিরে ধরেছিল। ভজু গ্রেড়ও তাদের মধ্যে ছিলেন। তিনিই চড়া স্বরে প্রশ্ন করলেন, ভারতে থেকে এভাবে পাকিস্তানকে সমর্থন করছেন কেন?
ফারুক স্যারও প্রতিবাদ করতে ছাড়েন নি। কিন্তু ভজু তখন নাছোড়বান্দা। গলার স্বর আরও উপরে তুলে বললেন, পরশু বিকেলে পচার চা দোকানে বসে আপনিই বলেছেন, সুইং এর সুলতান ওয়াসিম আক্ৰম একজন বিশ্ববিখ্যাত বোলার।
এতে ভারত বিরোধিতার কী আছে?
ওয়াসিম আক্ৰম কোন্ দেশের লোক?
পাকিস্তানের।
তাকে সমর্থন করে কথা বলার মানে তো পাকিস্তানকেই সমর্থন করা।
প্রসঙ্গটা এভাবে নিচ্ছেন কেন? লিলি, টমসন বা ব্রেটলিও একই মানের বোলার। তাদের নিয়ে আলোচনা করা মানে তো তাদের দেশকে সমর্থন করা নয়। সমীরদাও ওই আসরে ছিলেন।তিনিও মন্তব্য করেছিলেন, রিভার্স সুইং এর ক্ষেত্রে কপিলের চেয়ে ওয়াসিম অনেকখানি এগিয়ে। এটাও তার ব্যক্তিগত মতামত।।
ওই সব হিলুবিলু কথা বলে কচি খোকা সাজার চেষ্টা করবেন না। খবর নিয়ে জেনেছি, ক্রিকেট ম্যাচ চলাকালীন আপনিই বাড়ির সামনে পাকিস্তানের ফ্ল্যাগ তুলেছিলেন।
শুনতে শুনতে পল্লব আশ্চর্য না হয়ে পারল না। আসিফকে উদ্দেশ্য করে বলল, তুই ভারি অদ্ভুত কথা শোনালি রে। দেখছি এ ঘাটনার শিকড় অনেক গভীরে।
আরেকটা গুজব সারা এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে পল্লবদা। কয়েকদিন হল, পাশের গ্রাম থেকে তমাল নামে একটি ছেলেকে পাওয়া যাচ্ছে না। ভজু মাইক লাগিয়ে সর্বত্র প্রচার করেছেন, তমাল উগ্র ভারত সমর্থক ছিল বলেই লোক লাগিয়ে ওমর ফারুক স্যার তাকে গুম করে দিয়েছেন। এর ফলে উত্তেজনার পারদ চড়ছে চড়চড় করে।
একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল পল্লবের বুকের গভীর থেকে। অস্ফুটে বলল, শুনে মনে হচ্ছে, গুজবকে বাস্তব করে তোলার জন্যে কিছু মানুষ উঠেপড়ে লেগেছে।
এ নিয়ে নতুন কিছু ভাবার সময় এসেছে পল্লবদা।
কোন্ পথে ভাবতে হবে, সেটাই তো খুঁজে পাচ্ছি না।
রফিকের ভূমিকা আরও অভিনব।
কী রকম।।
সেও ঘরে বসে নেই। মুসলিম মহল্লাগুলোতে নিজে নেতৃত্ব দিয়ে মিটিং মিছিল শুরু করেছে। ফারুক স্যারকে যে মিথ্যে অভিযোগে ফাঁসানো হচ্ছে, সেই দাবী তুলে ইতিমধ্যে একটা হ্যাণ্ডবিল বাজারে এনেছে। তাতে দাবী করা হয়েছে, অনেক বৈজ্ঞানিক স্তর পার হয়ে ফ্যানটাসটিকস এর পাত্রগুলো বাজারে এসেছে। সেক্ষেত্রে কীটনাশক বীজানু আসার প্রসঙ্গ মিথ্যে গুজব ছাড়া কিছুই নয়। শুনছি, গতকাল বিকেলে পিংপং নিজের গাড়িতে রফিকের বাড়ি পর্যন্ত গিয়েছিলেন। কিছুক্ষণ পরে ড্রিঙ্কস এর গাড়ি ঢুকেছিল সেখানে। রফিকের নেতৃত্ব সব কিছু তদারক করা হয়েছে।
পল্লব আঁৎকে না উঠে পারল না। মনে মনে নিশ্চিত হল পিছনে একটা বড়ো ফ্যাক্টর কাজ করছে। সোপান ছেড়ে রফিকের চলে যাওয়া, সম্প্রীতি নষ্টের জন্যে ভজহরির উদ্যোগ নেওয়া, রফিকের উদ্যোগে পাল্টা প্রেক্ষাপট তৈরি করা— সবই যেন গোপন সূত্রে বাঁধা প্রচেষ্টার একটা অভিনব ছক।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct