সময়ের স্বরলিপি
মুসা আলি
___________________
অধ্যায় ২ কিস্তি ১
(মসলন্দপুরে নাটক প্রতিযোগিতায় পরাজয়ের পর প্রশান্ত মাষ্টারের ডাকা ঘরোয়া মজলিসে নতুন মূল্যায়ন শুরু হয়েছে। সেখানেই দেখা গেছে আলিম নামে এক বৃদ্ধের উপস্থিতি। কে এই আলিম? এ উপন্যাসে দ্বান্দ্বিক সূত্রের সঙ্গে তার সম্পর্ক কী? তা নিয়ে কুশিলবরা কী সকলে একমত? ভিতরে বহুজাতিক সংস্থার দেশবিরোধী কালো ছায়া দেখেও পল্লব তা কাউকে বলতে পারল না কেন? প্রশ্ন অনেক। পড়তে পড়তে উত্তরগুলো জানুন।)
মাত্র তিন মাস বয়স হয়েছে। তাতেও কম অগ্রগতি হয়নি। বিবেক দেবনাথের দেওয়া জায়গায় মাটি ফেলে বাঁশের খুঁটি দিয়ে একটিমাত্র ঘর তৈরি করা হয়েছে। সংস্থা চললে পরে আরও ভালো ব্যবস্থা করা যাবে বলেই সকলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গতকাল খুঁটির ফাঁকে ফাঁকে কঞ্চি দিয়ে ঘিরে তার উপর কাদা লেপে দেওয়া হয়েছে। ঘরের ভিতরে কয়েকটা আসবাবপত্র রয়েছে এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে। নাটকের কিছু সরঞ্জাম এককোণে পড়ে রয়েছে। কদিন আগে কেবল মনের আবেগে আসিফ নিজের হাতে লেখা একটা পোষ্টার ঢোকার মুখে টাঙিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। ছেলেটা এসব দিকে খুব উদ্যমী। টানা হাতে লিখেছে ‘প্রিয় নাট্যসংস্থা সোপান’। তার নীচে বড়ো করে লেখা “প্রথম প্রযোজনা— ‘জীবনের শপথ’।”
একটু আগে দেবু এসে দাঁড়াল ঘরের সামনে। দুচোখ জুড়িয়ে দেখল হাতে লেখা পোষ্টারটা। ভাবল, আরেকটু শিল্পসম্মত হলে মানাতো বেশ। তবুও আসিফের জন্য একটা সন্তুষ্টি তার মনের ভিতরে জায়গা করে নিল। নাটকের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা না থাকলে এটুকু করতে পারত না। তার নিজের চিন্তা, হাতে লেখা পোষ্টারে খুব বেশি দিন চলবে না। একটা বড়ো সাইনবোর্ড দরকার। সামনে টাঙিয়ে রাখলে পথচলতি মানুষ জানতে পারবে, ঘরটা কেন গড়ে উঠেছে। ভাবল, পরের মাসে নিজের খরচে একটা বড়ো সাইনবোর্ড তৈরি করে এনে সকলকে তাক লাগিয়ে দেবে। প্রত্যেকে ভাবতে পারবে যে সেও নাটক নিয়ে আন্তরিকতা দেখাতে এতটুকু কম যায় না। অচেনা কৌতুহলের মজা তার ভিতরে। তাতেই বুঁদ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। একটু পরে ঘরের মধ্যে ঢুকল। চারদিকে এলোমেলো করে এটা ওটা ছড়ানো। নিজেই চেয়ারগুলো ঘরের এককোণে গুছিয়ে রেখে দিল। স্টেজক্রাফটগুলো রাখল পশ্চিমদিকে। কঞ্চির বেড়ার পাশে। আসতে এত দেরি করছে কেন সকলে? এই সুযোগে চা খেয়ে নিলে কেমন হয়? আনমনে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। দীপ আর সুমন এসে দাঁড়াল তার সামনে। —ফিরে যাচ্ছিস কোথায়?
কেউ আসে নি, ভাবলুম, লালুদার দোকান থেকে চা খেয়ে আসি।
তোর জন্যে ভালো সুযোগ পেয়ে গেলুম রে।
চা খাওয়ানোর কথা বলছিস ?
দুজনে মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। দেবু হাসল মুখ টিপে। —এক কাপ চা খাওয়াকে ভালো সুযোগ বলে ভাবছিস?
বেকারদের এটুকুও কে দেয় বলতো?
তা বলেছিস ঠিক।
তাহলে চল্। তোর পয়সায় এক কাপ করে চা মেরে আসি।
দুকাপ চায়ে এমন কী খরচ?
দেখছি, বেশ তো উদার হয়ে গিয়েছিস। ভিতরে অন্য ইচ্ছে তাড়া করছে না তো?
দীপ প্রস্তাব দিল, দোকানের ছেলেটাকে বললে তো চা দিয়ে যেতে পারে।
দেবু গলা চড়িয়ে বলল, শুনতে পাচ্ছিস কালু, এখানে তিনটে চা দিয়ে যা।
দীপ বলল, কটা বাজে রে? আসার সময় ঘড়িটা আনতে ভুলে গিয়েছি।
ছ’টা চল্লিশ।।
তাহলে একটু পরে সকলে এসে যাবে। ভিতরে গিয়ে বসি চল। ততক্ষণ টিকিটের হিসেবটা সেরে ফেলি। পল্লবদা এলে রিয়ার্স শুরু করব।
ঘরের মধ্যে তিনজনে জাঁকিয়ে বসল। সকলে খুব সিরিয়াস, বিশেষ করে দেবু। টিকিট বিক্রি করতে গিয়ে সে খুব বেশি সফল হতে পারে নি, তাই নিয়ে একটা চাপা হতাশা গ্রাস করে আছে তাকে। তবুও হার মানতে নারাজ। ভিতরের বিমূঢ়তার ছবি তার মুখে নেই। পকেট থেকে খাতা বের করে হিসেবে মন দিল। দীপ দুচোখ খাড়া করে চেয়ে থাকল তার দিকে। এত গভীর মনোযোগ নিয়ে সে যোগ বিয়োগ করছিল যে দীপ তা তির তির করে গিলছিল। শেষে বলল, হ্যারে, তোর সব টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে? আরও নিবি নাকি? আমার কাছে আছে।
দেবু কোনো উত্তর দিল না, মুখে তির্যক হাসি ফুটিয়ে দীপের দিকে চেয়ে থাকল। গ্রামে নাটকের শো করতে গেলে টিকিট বিক্রি করা যে কত কঠিন, তা সে খুব করে বুঝতে পেরেছে। তখনও তার কাছে পঞ্চাশ টাকার টিকিট পঁচিশটা রয়ে গেছে। টিকিট বিক্রি করতে করতে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে চেয়েছে। কিন্তু পারে নি। নাটকের ব্যাপারে কেউ কোনো আগ্রহ দেখাতে চায় না। অনেক খোসামোদের পরেও রাজি হতে চায় নি। এমন কী, পনেরো টাকার সব টিকিট বিক্রি করতে পারে নি সে।
সুমন গম্ভীর হয়ে বলল, তাহলে দশ টাকার টিকিট সব শেষ?
দেবু হাসল একটু। কী উত্তর দেবে ভেবে পেল না। নাটকের টিকিট যে বাকিতে দিতে হবে, তা আগে কোনোদিন ভাবে নি। অথচ তাৎক্ষণিক অভিজ্ঞতা সেই কঠোর বাস্তবতা তুলে ধরছে। দিলে যে সে টাকা নাট্যসংস্থার তহবিলে আর ফিরে আসবে না, তা বুঝতে পেরেছে দেবু। মেঘ দেখলে বোঝা যায়, বৃষ্টি নামবে, না নামবে না। বাকিতে নেওয়া লোকগুলোর মুখে বৃষ্টি না হওয়ার মেঘ দেখতে পেয়েছে দেবু। তার মনে হয়েছে, মাত্র ক’টা টাকার জন্যে তারা তাকে এড়িয়ে চলতে পারে। হঠাৎ দেখা হলে হয়তো নাটক ভালো হয়েছে বলে অনেক প্রশংসা করবে কিন্তু যাতে টাকা না চাইতে পারি, তার জন্য তা উপযুক্ত বাহানা মাত্র। মিথ্যে প্রশংসাটুকু ফাউ পাওনা হিসেবে রয়ে যাবে। তাকে এত সব নিয়ে ভাবতে হচ্ছে অথচ কাউকে এসব বলে মনের যন্ত্রণা দূর করার কোনো উপায় নেই। তুষের আগুনে ধিকিধিকি পুড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। তবুও মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, সবে বেরিয়েছে, কবে ফিরবে জানি না।
দীপের বুকের গভীর থেকে একটা বড়ো ধীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল। তার ছোট্ট মন্তব্য, এভাবে চললে তো কস্টিং উঠবে নারে। জানিস দেবু, আমরা এখনও নাটকের ব্যাপার নিয়ে সাধারণ মানুষকে ঠিকমতো বোঝাতে পারলুম না। তাদের ধারণা, আমরা যারা নাটক করি, সব দায় আমাদের। এ নাটক না দেখলে তাদের কোনো অসুবিধা নেই। এটা যে জনজাগরণের অন্যতম প্রধান মাধ্যম, তা আজও তাদের বোঝানো গেল না। আর কবে বুঝবে? মুখটা গম্ভীর করে ভিতরে প্রবল হতাশা নিয়ে উদাস হয়ে বসে থাকল দীপ। আসিফ ঢুকল ঘরে। তার মনে পেখম তোলা ময়ুরীর আনন্দ। একেবারে বিন্দাস মানসিকতা। গুণ গুণ করে হিন্দী গানের সুর ভাঁজছে। সকলে পরিস্থিতির চাপে দুমড়ে মুচড়ে গেলেও আসিফ সব সময় নিজেকে খাড়া রাখার চেষ্টা করে। এটাই তার স্বভাব। অন্ধকারের ভ্রকুটি কিছুতেই তাকে স্পর্শ করতে পারে না। হিন্দী গানের সুর বাদ দিয়ে ঘরের এককোণে দাঁড়িয়ে আপন মনে বলল, ‘হও ধর্মেতে ধীর, হও কর্মেতে বীর, হও উন্নত শির, নাহি ভয়।
সুমন না হেসে পারল না। দুর্যোগে অবিচল থাকার অভ্যেসকে আসিফ বেশ আত্মস্থ করে ফেলেছে। এজন্যে যে ভিতরের শক্তি লাগে, তা তার আছে। অতশত ভাবার প্রয়োজন বোধ করে না সে। ভেড়ার পাল তাড়ানোর মতো ভিতরের শেষ সম্বল দিয়ে সে সব প্রতিকূলতাকে পরাস্ত করতে চায়। নাটকে ঢোকার পর থেকে এটাই তার নতুন বোধ। কিন্তু যখন কোনো বিষয় নিয়ে ভাবতে শুরু করে, তখন সে সব ফেলে রেখে বিষয়টাকে মাথার উপর তুলে নেয়। নিজের বোঝা হিসেবে ভাবে। একাই বইতে হবে, সেই প্রতিজ্ঞায় মগ্ন থাকে। এমনি দুই বিপরীত মানসিক নেশা নিয়ে অন্যদের কম ঝামেলা সহ্য করতে হয় নি। তাতেও আসিফ এতটুকু দমে যায় নি। নিজেকে এতটুকু পাল্টানোর প্রয়োজন বোধ করে নি। সুমনের খুব রাগ হচ্ছিল আসিফের হাবভাব দেখে। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, বাছাধন তো বেশ গানে মশগুল, কটা টিকিট বিক্রি হল শুনি? এত ফুরফুরে মেজাজে থাকিস কী করে রে ?
আসিফ কোনো উত্তর দিল না। সুমনের কথাগুলো কানে নিল কিনা, তা কেউ জানতে পারল না। দেবুর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আমার নামে তিনশ’ টাকা জমা কর। তারপর দেখছি, আরও কী করা যায়। যত জাগাতে পারব, তত বেশি আগ্রহ হয়ে লোক টিকিট কিনবে।
বাকিরা অবাক আসিফের ভাবভঙ্গী দেখে। তাকে পয়মন্ত ছেলে হিসেবে ভাবতে শুরু করল সকলে। কেউ না পারলেও আসিফ যে পেরেছে, তা তার মনোভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। দেবু শুধু অবাক হল না, দারুণ খুশি হল তার সাফল্যে। আসিফ পেরেছে যখন তারাও পারবে আগামি দিনে। হিসেবের খাতায় আসিফের নামে জমা করে দিয়ে দেবু বাহবা দিয়ে বলল, তোকে ধন্যবাদ দিতে হয় রে। তাহলে পঁচিশ টাকার টিকিট সব শেষ? তোর সাফল্যে আমরাও গর্বিত।
আসিফের গলার স্বরে হতাশার সুর। —ভাবলি কী করে এত বড়ো সাফল্য নিয়ে ? বাড়িতে বাড়িতে গিয়েছি, কেউ নিচ্ছে না টিকিট। বেশি অনুরোধ করলে মুখ ঘুরিয়ে সরে পড়ছে। তারা নাটকের কথা শুনতেই চায় না। অন্য প্রসঙ্গে আলোচনা করলে গুটিয়ে না থেকে মন খুলে কথা বলছে কিন্তু নাটকের প্রসঙ্গ বলতে শুরু করলেই এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন এসব কথা বলে তাদের বিব্রত না করাই ভালো। আর ভাবতে পারল না আসিফ। বুকের গভীর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct