“সবার উপর মানুষ সত্য, তাহার উপর নাই”
বিবর্ণ বর্ণের বিবর্তন বাঞ্চনীয় বর্তমানে
মাসউদ আলাম
আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র
প্রাথমিক স্কুল থেকেই বর্ণমালার সাথে আমারা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বর্ণমালার পরিচয়তো আছে কিন্তু ইদানীংকালে বর্ণভেদের আভাস ও সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে দিকবিদিকের অন্তরালে। বর্ণভেদ শুধু বর্ণমালার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, মানুষের চিন্তার মধ্যেও প্রসার ও পরিসর করেছে। বিভেদের বিভব এই শতকেও যদি চলমান হয় তাহলে,আগামী আগন্তুক ভবিষ্যৎ কি প্রকট প্রশ্নের দ্বারে নয়......?
প্রিয় কবি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছেন- “মানুষের মরণ আমাকে বড় আঘাত করে না,করে মনুষ্যত্বের মরণ দেখিলে”।
সভ্যতার সভ্য সূচনায় মানব স্বভাবের অনুকূল সরলতার প্রবাহ দেখা যেত, যাহা আজও ইতিহাসের পাতায় অবক্ষেয় প্রতীয়মান। কুৎসিত, মন্দ হলেও মানবতার ছায়াতলে আশ্রয় পেয়েছিল স্বল্প সময়ের জন্যেও। চিন্তা ধারায় পরিবর্তন আসার ফলে সভ্যতার আধুনিক যুগের গুপ্ত প্রয়াস প্রকাশ পাওয়ার আভাস ওঠে।
জীবনের পরিবর্তন এবং সমাজের বন্ধন ছিঁড়ে মানুষ লক্ষ্যকে বক্ষে ধারণ করার সাহস পেয়েছে, পরিবর্তন ও বিবর্তনের ধারা যুগের প্রান্তরে গতি বেয়ে আজও অব্যাহত, অদূর ভবিষ্যতেও চলমান থাকবে। বিবর্তনের ক্রমান্বয় সাধনের প্রচেষ্টায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বলেছেন “গুণমান হইলেই মানে সব ঠাই, গুণহীন সমাদর কোন খানে নাই”।
সভ্যতার সুচারুরূপে বন্ধন যেন ছিন্নতার বেগে চলেছে আগাম দূরে- “আমি জানি বা জানিনা” প্রশ্নের সঠিক ও ন্যায় উত্তর জনসমাবেশ ও জনরোষে দেওয়া সত্যিই কষ্টকর, ধর্মিয় আবেগ রোষানলের প্রান্তরে দাঁড়িয়ে।
ভাবাবেগের আঘাত হবে বলে উত্তরের সংমিশ্রণ ঘটে যায়, যাহা নির্ভর করে ভাবনার গহীনে নয়, ধর্মের অঙ্গনে। এই চিন্তা ধারা সার্বভৌম এবং গণতান্ত্রিক দেশে বসবাসরত সাধারণ মানুষের জন্য শুধুই কি কলঙ্ক! নাকি আগামী প্রজন্মের জন্য অপ্রীতিকর প্রণয়।
যেখানে ভারতীয় সংবিধানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে বাক স্বাধীনতার কথা, ধারা নম্বর(১৯-২২ এর মধ্যে)।
কৌশল ও কুশলতা ভাবনার অন্তরে যেন জায়গায় নেই...!
অবাক চিত্ত আকৃতিতে আক্রমণের অভিপ্রায়ে রুষ্ট রাক্ষসী চেহারা...!
শুভ উপলব্ধি পথে এই সংকীর্ণ ক্ষুদ্রতা বাধা হয়ে দাঁড়ায়, অসীম চেতনা জাগ্রত থাকলে সাম্প্রদায় চেতনা কুণ্ঠিত অবস্থায় বিলুপ্তির পথে অগ্রগামী হবে।
শুধু সাম্প্রদায় চেতনা নয় ব্যক্তি চেতনাও বৃহৎসত্তায় মিলিত হয় বলেই মানুষ অবিচ্ছেদ্য পূর্ণতা, যেথায় পরাভব নেই, কারণ সাধনা হওয়া দরকার সর্বমানবের সাধনা।
“আর নয় ভেদাভেদ,অভেদ থাকি মোরা, গোষ্ঠী দন্দে, জাতি নন্দে, এইতো সারা”।।(সংগৃহীত)
এই ব্যাধির প্রতিষেধক প্রকৃত জ্ঞান ও উদারনৈতিক পন্থার আশ্রয় নিতে হবে, পাশাপাশি মূল্যবোধের ভাবাদর্শে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সুশীল ও কুশিল সমাজ নির্মাণে অগ্রসরতার মূল ধায়ায় হলো শিক্ষা, জরাজীর্ণ চক্রভেদের বিহ্বল নিবন্ধনে নয়, অলংকার প্রজ্বলিত আশা করা যায় শুধুমাত্র শিক্ষার ছায়া তলে বসে। ছন্দ ও বন্ধন এর সূত্র রেখা যদি নড়ে বসে, তাহলে ইতি কথার অন্তঃসার প্রাণবন্ত হয় না সাধারণত, অজ্ঞতার ভেলায় ভেসেই শুধুমাত্র “বিবর্ণ” নামের দ্বীপের সন্ধান পাওয়া যায়!!
যাহার কাঙ্খিত সাক্ষী প্রমাণিত ইতিহাসের পাতায়। দিবালোকে ও অন্ধলোকে ঘ্রাণ পাওয়া যায় আজও যাহার শিরে আছে “বর্ণ”.....।
“ধর্মের দ্বেষী ছোঁয়া আর আবেগের মায়া” কোনদিন সুফল বয়ে আনে না, ধর্মের শিক্ষা প্রয়োজন, করে আয়োজন, বিকল্প যেন না হয় বিয়োজন। আকুতিও আর্তনাদ ধর্মের উপরে, এই কল্পনার ভাবধারা ও বাস্তবায়ন যেন আজ বিলুপ্তির পথে..!
বাস্তবতার বাস্তব চিত্র দাঁড়িপাল্লায় নয়, যেন মাঝি-মাল্লা নিয়ে গেছে নদীর অকূলে। দায়বদ্ধতার সম্যক ভার যদি দেখিতে চাও লালকেল্লার পাদদেশে না গেলেও হবে, ভিন্নার্থক রঙে বিবর্ণ হয়ে স্বজনবিয়গের আত্মনির্ভরই যথেষ্ট। কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন- “আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই! বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী,অর্ধেক তার নর ”।
সংস্কৃতির প্রকৃত রুপ সংরক্ষণের দায়িত্বভার বিজ্ঞজনের তত্ত্বাবধানে থাকবে ইহাই অনুকূল, কিন্তু দিগবিদিকের দর্শনের ছোঁয়া লেগেছে প্রতিকূলতার ছিন্ন মনোবাঞ্ছা, শত প্রাণপণ চেষ্টা যেন বিফল নামের নদীরই দোষ। ভিন্ন আঙ্গিকে চলার মত ও পথ থেকে বাঁচায় শ্রেয়, স্বামী বিবেকানন্দ
বলেছেন- “শিক্ষা হচ্ছে মানুষের মধ্যে ইতিমধ্যে থাকা উৎকর্ষের প্রকাশ।” (Education is the manifestation of perfection already in man”)
উম্মুক্ত হয়ে চলা ও আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অন্তর্নিহিত শক্তির দিকে তাকাতেই হয়, এটি যেমন একটি প্রক্রিয়াশীল, ঠিক তেমনই আধুনিক বৈজ্ঞানিক সময়ে মুখোমুখি হওয়ার জন্য একটি স্ব-বিকশিত সর্বজনীন পদ্ধতি। কাকু জেঠুদের অন্দরের কথা, বাস-ট্রেনের উপচে পড়া ভিড়ের নিরলস প্রচেষ্টায় প্রাণপণ বাঁচিয়ে তোলার অভিজ্ঞতা এবং রঙ্গ রাজনীতির প্রেক্ষাপট দর্শন করে আমার একটাই প্রশ্ন--বাকস্বাধীনতা কি আবারও রক্ত দিয়ে অর্জন করতে হবে....? প্রশ্নটা বাস্তবিক ও তাৎক্ষণিক রূপকথার সাথে কিছুটা হলেও মিল আছে তবে, বাকস্বাধীনতার অর্থ এই নয় যে, তীব্র আক্ষেপ ও আক্রোশে যা ইচ্ছা তাই বলা, ব্যাক্তি স্বাধীনতার জন্য স্বীয় প্রয়োজনটুকু তো বলতে পারা।
মানুষের শ্রেষ্ঠ ধর্ম বলে যদি কিছু থাকে তা হলো মানবতা। মানব আর মানবতা এই শব্দ দুটি একে অন্যের সাথে ওতোপ্রতভাবে জড়িত।
অর্থাৎ, মানবতা ছাড়া মানুষ হয় না। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এই “মানবতা” শব্দটি শুধুমাত্র খাতা কলম আর বইয়ের পাতায়। বাস্তব প্রয়োগ এর চূড়ান্ত অনুশাসন আমাদেরকেই করতে ও মানতে হবে, যদিও মানবতা ঢেকে গেছে ছলনার চাদরে আর ছলনার জন্ম হয়েছে মানবতার অনাদরে। দিগ্বিদিকের ললাট ক্ষত কণ্ঠ ও অবাঞ্ছিত রূপ আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় পান্ডুলিপির জোয়ারে, শায়িত কলমকে, শায়িতদের জন্য দন্ডায়মান হতে।
কবি জসীমউদদীন বলেছেন- “আমার এ ঘর ভাঙ্গিয়াছে যেবা, আমি বাধি তার ঘর, আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর ”।
রাজনীতি কি সামঞ্জস্যবিধান কারী নাকি বিরোধ ও বিভেদ সূচক প্রক্রিয়া- এই প্রশ্নটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রশ্নের সাথে সম্পৃক্ত... এর উত্তর আজও নিরলস প্রত্যাশার প্রান্তরে এককভাবে দাঁড়িয়ে।
দেশ ও জনগণের সর্বাধিক কল্যাণ এবং অগ্রগতির মশালকে কার্যত সামর্থ্য করার ক্ষমতা রয়েছে রাজনীতি ও রাজনৈতিকদের ।
কোনা দেশের রাজনীতি যদি হয় নীতিহীন, পচনগ্রস্ত; তবে সে দেশটির অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকেও সেই সংক্রমণ থেকে রক্ষা করা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ে। একইভাবে, কিছু কিছু সীমাবদ্ধতার পরও, রাষ্ট্র পরিচালনব্যবস্থা হিসেবে পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত গণতন্ত্রের কোনা বিকল্প ব্যবস্থা নেই।
দায়িত্বশীলতা যার প্রধান ও অপরিহার্য শর্ত। সমাজ ও রাজনীতির চলমান ধারা ও ভাবধারা কি প্রশ্নোঊর্ধ্ব কোনাে বিষয়? এর জবাবে অনেকেই না বলতে সংকোচবোধ করবেন, তবে বাস্তবতার দৃশ্য দূরদর্শন এর পর্দায়।
সমাজ ও রাজনীতি যেমন একে অপরের পরিপূরক, তেমনি তাদের চরিত্র ও ধারা -এই বৈশিষ্ট্য দুয়ের গতিপথের নির্ধারক। ফলে সমাজ ও রাজনীতি বিপথগামী হচ্ছে কি না, তার জন্য চাই পাহারাদার। এ দুটি ক্ষেত্রে যেমন পাহারাদারের ভূমিকায় অবতীর্ণ নির্বাচিত সরকার, তার অধীন সহায়ক সংস্থাগুল, তেমনি দ্বিতীয় পাহারাদার, সমাজভাবনায় ভাবিত বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, সংবাদপত্র ও সাংবাদিক এবং শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিত্বদের সমবায়ে গড়ে ওঠা সুশীল সমাজ, এমনকি গােষ্ঠীবদ্ধহীন কোন ব্যক্তিবিশেষও।
গণতন্ত্রের ইতিহাস, বিশেষত সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাস আমাদের এ ধারণাই দিয়ে থাকে। সৌজন্যে রীতিসিদ্ধ পদ্ধতি ও আদর্শ রাজনৈতিক প্রকৌশল ভিন্নমতের কঠোরতাকে কিছুটা হ্রাস করে। ব্রিটেন ও আমেরিকার আইনসভার রীতিসিদ্ধ ও রীতি বহির্ভূত প্রয়োগ গুলি এই ধরনের প্রবণতার প্রতিফলন।
এজাতীয় পরিমিত আদর্শ (Moderating Norms) এর অভাবে আফ্রিকা ও এশিয়ার স্বাধীন কিছু দেশগুলিতে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কার্যকারী করতে অল্প হলেও অসুবিধার সম্মুখ সমরে দাঁড়াতে হয়।
গণতান্ত্রিক দেশের দলীয় রাজনীতিতে পক্ষ-বিপক্ষ থাকবেই ক্ষমতার শৃঙ্গে পৌঁছাতে দৌড়ঝাঁপ এবং রাজনৈতিক কৌশল-প্রকৌশল ব্যবহার হবেই; কিন্তু তা দেশাত্মবোধকে স্বার্থকভাবে বিসর্জন দিয়ে নয়।
ধর্মীয় উদারতা ও উদারনৈতিক পন্থাকে বাঁচানোর দায়িত্ব আমাদের সবারই। সমাজের কিছু রীতি-নীতি,আচার-আচরণ থাকে আর এই গুলি হলো প্রথা, প্রথাগুলো ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ থেকে সৃষ্টি যা মানুষ পালন করে থাকে। সংস্কৃতি একদিকে শিক্ষাকে প্রভাবিত করে অন্যদিকে শিক্ষা সংস্কৃতির লালন ও উন্নয়ন সাধন করে। বিবর্ণ ও ভিন্নার্থক রং এই সংস্কৃতি এবং সামাজিক মূল্যবোধের বিকাশে সবাইকে রঙিন যেন না করে।
সর্বোপরি বড়ু চণ্ডীদাস বলেছেন- “সবার উপর মানুষ সত্য,তাহার উপর নাই ”।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct