শংকর সাহা: ‘মা’ শব্দটি ছোট হলেও এর পরিধি বিশাল। “মা” শব্দটি এক গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। মা যেমন আমাদের গর্ভধারিনী অন্যদিকে মায়া ও মমতার এক চির উৎস। সেইসুদূর অতীতকাল থেকে মা ও সন্তানের সম্পর্ক চিরন্তন ও শাশ্বত। উপনিষদে একটি কথা আছে যেখানে বলা হয়েছিলো “ মাতৃ দেব ভব” অর্থাৎ মা দেবী স্বরূপিনী, জীবন্ত ঈশ্বরী। মায়ের অবদান সত্যিই পর্বতসম। প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই বিশেষ দিনটি পালিত হয় মাতৃদিবস হিসেবে। এই বিশেষ দিনটিতে প্রত্যেক সন্তান-সন্ততি মায়ের সন্মানার্থে পালন করে থাকেন মাতৃদিবস। পালিত হয় মাতৃদিবস।
মাতৃদিবসের ইতিহাস বেশ পুরোনো। কথিত আছে, প্রাচীন গ্রীসে সিবেল নামে এক বিশিষ্ট দেবীর উদ্দেশ্যে পালন করা হত একটি উৎসব। বর্তমান সময়ে এই বিশেষ দিনে প্রতিটি সন্তান তাঁদের মায়ের নামে নানান আয়োজন করেন। থাকে নানা উপহার সামগ্রীও। প্রতিটি সন্তানরাই সেদিন মায়ের প্রিয় জিনিসগুলো আনার চেষ্টা করেন। যেন এক উৎসবের বহরে পালিত হয় মাতৃদিবস। কিন্তু এই ভালোবাসা কোনো একটি নির্দিষ্ট দিনের জন্যে সীমাবদ্ধথাকেনা। মায়ের প্রতি সন্তানের ভালোবাসা যেন থাকে প্রতিটি দিনে।তবেই মাতৃদিবসের সার্থকতা বজায় থাকে।
“জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী।“ সংস্কৃতের এই শ্লোকটি হয়তো আমাদের অনেকেই পরিচিত পাঠ্যবইতে পড়ার সুবাদে। ‘ভূমে গরীয়সী মাতা ‘এই কথাগুলো হয়তো আমাদের কণ্ঠস্থ করতে হয়েছিল পরীক্ষায় ভালো নম্বর তোলার সুবাদে কিন্তু এর অন্তর্নিহিত অর্থ কি আজও হয়তো বা আমরা অনেকেই জানি না ?আজকাল দৈনন্দিন জীবনে অনেক সময় দৈনন্দিন সংবাদপত্রের পাতায় দেখা যায় অশীতিপর বৃদ্ধারা নিজেরাই নিজেদের সন্তানের কাছে অত্যাচারিত হচ্ছেন, উপেক্ষিত হয়েছেন। অনেক সময় তাদের জীবনের শেষ ঠিকানা হয় বৃদ্ধাশ্রম। এমন খবরে অনেকে হয়তো ভাবেন তাদের জীবনের শেষঠিকানা কি এমন হতে পারে ? সেক্ষেত্রে প্রতিটি সন্তানদেরই দায়িত্ব নিতে হবে বৃদ্ধ বয়সে মায়ের সমস্ত দেখভালের। কখনই সেই সন্তান সেই মহৎ দায়িত্ব থেকে যেন অব্যাহতি না চায় তবেই তো উৎসবের আয়োজনে সার্থক হয়ে উঠবে মাতৃদিবস।
আজও সমাজে দেখা যায় অনেক বাড়িতে বয়স্করা অত্যাচারিত হচ্ছেন। অনেক সময় কারো কারো শেষ জীবনে স্থান হয় বৃদ্ধাশ্রমে। অনেক সময় পথেঘাটে, বাসে-ট্রেনে চলতে গিয়ে বয়স্করা অনেক রকম সমস্যায় পড়েন। কোনো কোনো সহৃদয়বান ব্যক্তি হয়তো সেইসময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। তাদের প্রতি তাদের পরিবারের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ আছে অন্যদিকে সমাজের প্রতিটি মানুষেরও এ বিষয়ে দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ থাকাটা প্রয়োজন। আমরা সকলে সামাজিক মানুষ আর তারাও আমাদের সমাজের অংশ। মাতৃদিবসে হোক এই আমাদের অঙ্গীকার। বস্তুত আমাদের প্রত্যেকের জীবনে মায়ের ভূমিকা এক অপরিসীম। শত কষ্ট করে তিনি মানুষ করেছেন আমাদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন জীবনে। যেমন শৈশবের দিনগুলোতে আমাদের প্রত্যেকেরই নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হয় মায়েদের উপরে অন্যদিকে ঠিক তেমনি ভাবে বৃদ্ধ বয়সে মায়েদেরও একমাত্র অবলম্বন হল নিজের সন্তানরা।সন্তানের এ যেন এক মহান দায়িত্ব। আমরা সাংসারিক ও পারিবারিক পরিমন্ডলে থেকে যত ডিগ্রিধারী হই না কেন নিজের আদর্শ ও মহানুভবতায় সমুজ্জ্বল থাকাটাই আসল শিক্ষা।
আজ সময় বদলেছে। বদলেছে আমাদের রুচি ও মননশীলতার। আজ আধুনিকতায় স্পর্শ লেগেছে সবকিছুতে। মাতৃদিবস আজ পালিত হয় অনেক জায়গায় অনেক ঘটা করে। ছবি তুলে দেদার সোস্যাল নেটওয়ার্ক সাইসেটেও অন্যদের দেখানো হয়। তবে মাতৃদিবস পালনের তাৎপর্য এই ক্ষুদ্রগণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ না। মাতৃদিবস মায়ের সম্মানার্থে এক সম্মানজনক অনুষ্ঠান। আমাদের প্রত্যেকের জীবনে মা যে জায়গা নিয়ে আছেন তা উপলব্ধি করাই যেন মাতৃদিবস পালনের এক গভীর তাৎপর্য। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো আমরাও যেন বলতে পারি, “মায়ের প্রাণে তোমারি লাগি/ জগত মাতা রয়েছে জাগি”।
লেখক প্রাবন্ধিক ও নাট্যকর্মী
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct