বাংলা ভাষায় গজল গানে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রচারক হলেন কাজী নজরুল ইসলাম। প্রকৃত পক্ষে তাঁকেই গজল রীতির গীতরচনার প্রবর্তক বা পথিকৃৎ বলা যায়। নজরুল তাঁর সংগীত জীবনের প্রারম্ভিক বছরগুলিতে যে জাতীয় গজল সংগীত রচনা করে গিয়েছিলেন তার প্রত্যেকটির বাণীবন্ধনের ভিতর প্রেমের আকুতি অতিস্পষ্ট। আর সে প্রেম জলজ্যান্ত ধরা-ছোঁয়ার অনুভবের শিহরণ জাগানো প্রেম। তাঁকে নিয়ে লিখেছেন নারায়ণ চৌধুরী।
জল’ শব্দটি আরবী-পারসিক শব্দসূত্র থেকে আহৃত। আরবীতে গজল বলতে বোঝায় এক শ্রেণীর আয়ত-চক্ষু লঘুচপল গতিবিশিষ্ট শৃঙ্গযুক্ত ছোট আকারের হরিণ। কিন্তু পারসিক ভাষায় তার অর্থ সম্পূর্ণ আলাদা— গজল বলতে ফার্সিতে বোঝায় প্রেমসংগীত, যারআয়তন দশ- বারো লাইনের সীমাতেই সীমিত। তার বেশি হওয়াও সম্ভব। গজলের প্রথম দুই পংক্তি সুছাঁদ ছন্দ ও লয় বিশিষ্ট, অন্ত্যমিলযুক্ত, তাকে বলা হয় মাতলা; পরবর্তী পংক্তিগুলিকে বলে ‘মাকতা’। ফার্সিতে এ দুটি শব্দের অর্থ যথাক্রমে আরোহণ ওঅবরোহণ। পারসিক কবিরা গজল গীত রচনায় শিল্প নৈপুণ্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে গেছেন। হাফিজ ও ওমর খৈয়ামের বেশির ভাগ রুবাই বা দিন ওয়ানই ছিল গজলের আঙ্গিকে রচিত। ভারতবর্ষীয় অনুষঙ্গ উর্দু ভাষায় গজল গীতরীতির সর্বশেষ চর্চ হয় এবং উনিশ শতকীয় ফার্সি-উর্দু কবি গালিব (১৭৯৭-১৮৬৯) এই রীতির রচনায় চূড়ান্ত সার্থকতা অর্জন করেন। উর্দু ভাষায় সংবদ্ধ গালিবের গজল গানগুলি আজও শিল্পসিদ্ধির তুঙ্গস্পর্শী দৃষ্টান্তরূপে পরিগণিত হয়ে থাকে। গালিবের দৃষ্টান্তের অনুসরণে পরবর্তী কালের খ্যাতনামা উর্দু কবি মুহাম্মদ ইকবাল, ফৈয়াজ আহমদ ফৈয়াজ প্রমুখ গজলগীত রচনায সর্বশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেন।বাংলা ভাষায় গজল গানে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রচারক হলেন কাজী নজরুল ইসলাম। প্রকৃত পক্ষে তাঁকেই গজল রীতির গীতরচনার প্রবর্তক বা পথিকৃৎ বলা যায়। এর আগে উনিশ শতকীয় কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার (১৮৩৭-১৯০৭) প্রাচীন পারসিক কবি হাফিজের ভাবে ভাবিত হয়ে তৎসৃষ্ট গজলধর্মী রুবাইগুচ্ছের অনুসরণে ‘সদ্ভাবশতক’ নামে একখানি কবিতা পুস্তকের প্রচার করেন। (১৮৬৯)। কিন্তু ‘সদ্ভাবশতকের’র রচনাগুলি আদৌ প্রেমমূলক ছিল না, ছিল প্রচণ্ড রকমের নীতিমূলক, কখনও-কখনও ঈশ্বরীয় চেতনায় ভরপুর। রুবাই-এর দ্ব্যর্থব্যঞ্জকতাজ্ঞাপক অবস্থান— অর্থাৎ ইচ্ছা করলে একই রচনাকে ঈশ্বরস্তোত্র অথবা দয়িতার প্রতি প্রেম নিবেদন ভাষায় দ্বৈধতা— কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের কবিতায় খুঁজে পাওয়ার যো ছিল না, কেননা কৃষ্ণচন্দ্র প্রকটভাবেই ছিলেন একজন ব্রাহ্মভাবাপন্ন সুনীতিবাদীআচার্যস্থানীয় ব্যক্তি। তার দৃষ্টিতে নীতির যে স্থান ছিল, প্রেমের স্থান ছিল তার অনেক অনেক নীচে, কিংবা প্রেমের আদৌ কোন স্থান ছিল না তাঁর জীবন পরিকল্পনার ছকের ভেতর। ভাগবত চিন্তাচেতনাই তার অধিকাংশ সময় ব্যয়িত হতো বলে অনুমান হয়।কিন্তু নজরুলের জীবনের ছাঁচ তো মোটেই তেমন নয়, বরং খতিয়ে দেখলে তার জীবনাচরণের ধারাকে তার সম্পূর্ণ বিপরীত ভাবাই সংগত। নজরুল এই শতকের বিশের দশকের পরিধিমধ্যে, অর্থাৎ তাঁর সংগীত জীবনের প্রারম্ভিক বছরগুলিতে যে জাতীয় গজলসংগীত রচনা করে গিয়েছিলেন তার প্রত্যেকটির বাণীবন্ধনের ভিতর প্রেমের আকুতি অতিস্পষ্ট। আর সে প্রেম ঈশ্বরীয় প্রেম নয়, জলজ্যান্ত ধরা-ছোঁয়ার অনুভবের মানবমানবীর মধ্যেকার রক্তমাংসের শিহরণ জাগানো প্রেম।ইংরেজিতে যে ধরনের কাব্য বা গীত রচনাকে sensous এমন কি sensual বলা হয় নজরুলের গজল গানগুলি অধিকাংশই ওই বর্গের রচনা। নারীর প্রতি তার দয়িতের অথবা তদ্বিরীতে প্রেমিকের প্রতি প্রেমিকার চাওয়া পাওয়ার বাস্তবতাকে অন্য কিছু ভেবে সূফী কিংবা বৈষ্ণবীয় কুহকে মজার বিভ্রান্তির কোনই অবকাশ নেই নজরুলের এই গজল গীতরচনাগুলিতে। এগুলির আবেদন জানিয়ে-শুনিয়েই জৈব ভাবদ্যোতনায় ভরা, আরও খোলাখুলি বলতে গেলে বলতে হয়, দেহগত বাসনা-কামনায় রঙিন। দয়িতার চোখের অপাঙ্গ দৃষ্টির মোহ, তার অঙ্গের সুবাস বুক তরে গ্রহণ করবার ব্যাকুলতা, তাকে ছুঁয়ে দেবার চকিত স্পর্শসুখ, তার বিলোল কটাক্ষে অভিভূত বোধ করবার মদিরতা —এই সব এবং এই জাতীয় আরও সব পার্থিব অনুভূতি নজরুলের গজল রচনার কথাবস্তুর মধ্যে এমন ওতপ্রোতভাবে অনুলিপ্ত হয়ে আছে যে, সে সব গানকে স্বর্গীয়ভাবদ্যোতক মনে করার কোনই কারণ নেই। বরং আষ্টেপৃষ্টে সেগুলি মতাভাবে দরদর— এরূপ মনেকরলেই সেগুলির যথাযথ পরিচয় দেওয়া হয় বলে আমাদের ধারণা।তা বলে নজরুলের এই বর্গের রচনাগুলি স্থুলভাষান্বিত ভাবার আদৌ কোন যুক্তি নেই। এগুলির বেশীর ভাগই অপূর্ব কাব্যস্থাদমণ্ডিত। চিবিয়ে চিবিয়ে উপভোগ করবার মত স্বাদ সেগুলির ভাবব্যঞ্জনা। ‘আমারে চোখ, ইশারায় ডাক দিলে হায় কে গো দরদী’ ‘এত জলও কাজল চোখে পাষাণী আনলে বল কে’, ‘প্রিয় যেন প্রেম ভুলো না এ মিনতি করি হে’, ‘চেয়ো না সুনয়না আর চেয়ো না এই নয়ন পানে’, ‘কেন আন ফুলডোর আজি এ বিদায় বেলায়’ প্রভৃতি গজলগুলির ভাব-মাধুর্যের কোন তুলনা হয় না। রূপজ কামনা বাসনাররূপায়ণমূলক রচনা হলেও এগুলির মধ্যেও এক ধরনের সূক্ষ্মতা আছে, যার আবেদন কাব্যভাবগ্রাহীর কাছেই শুধু ধরা পড়া সম্ভব। প্রেমের আর্তি, মিলনের ব্যাকুলতা, বিরহের বেদনা, বঞ্চিত হওয়ার দীর্ঘশ্বাস, ভালবাসার প্রতিদান না পাওয়ার হৃদয়ের শূন্যতা— সবরকমের অনুভবই এই গানগুলিতে অনবদ্য বাণীরূপ পেয়েছে। ইন্দ্রিয়জ চাওয়া-পাওয়ার গীতরচনা হলেও এগুলির মধ্যে মোটাদাগেরসংবেদনশীলতার পরিমাণই বেশি। ব্যাপার কিছু নেই বরং সূক্ষ্ম সংবেদনশীলতার পরিমাণই বেশি।মনে হয় এই গানগুলি রচনার কালে নজরুল জ্ঞাত বা অর্ধজ্ঞাতসারে গালিবের গজল-রচনাদর্শের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। গালিবের মতই তাঁরও গজল গানে জৈব কামনা-বাসনার ভোগারতি, কিন্তু তা বেদনার ধূপের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। পার্থিব ভালবাসার গান হলেওপ্রতিপদে সে গান কান্নায় বিধুর।নজরুল গজল গানের সুরের কাঠামো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সে দিকটা বাণীর চেয়েও বোধ হয় বেশি অনুধাবনযোগ্য। বস্তুত নজরুলের গজলের সুরের আকর্ষণের কোন পরিমাণ হয় না। আমরা এখন এই অনুশীলনেই কিছুটা সময় নিয়োজিত করতে চাইছি।শোনা যায় মধ্যযুগের প্রথিতযশা কবি-সুরকার আমীর খসরু (১২৫০-১৩১২ খ্রিস্টাব্দ) এদেশে প্রথম গজল গানের প্রচলন করেন। তিনি এটি পারস্য দেশ থেকে আমদানি করেন। শুধু গজল নয়, সেই সঙ্গে নাত. গীত, কাওয়ালি, মসনতী, কাসিদা, রুবাই জাতীয় অপেক্ষাকৃত হালকা ধরনের প্রেমগীতিও তিনি অনেক রচনা করেছিলেন। তবে যেহেতু ওই কালটা ছিল মূলত ধ্রুপদের ব্যাপক চর্চার কাল এবং খেয়ালের উত্তব ও প্রাথমিক বিকাশের যুগ, সেই কারণে গজলগীত, কাওয়ালি-মসনভী-কাসিদা শ্রেণীর লঘুহ্বরের মনোহর গানশ্রুুতিমধুর হলেও সে যুগের ‘গীতামোদিদের মধ্যে তেমন প্রচার লাভ করতে পারেনি। কাওয়ালি-গীত গজল-নাত শ্রেণীর গানের আদর হয় আরও অনেক, অনেক কাল পরে। তবে কথা এই খসরুর রচিত গজল গান তাঁর সময়ে তেমন জনপ্রিয়তা অর্জন করতে নাপারলেও সেগুলির বাণী-সৌন্দর্যে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না।
আমীর খসরুর রচিত গজল গানের একটি ‘শ্যের’ বা স্তবক—আমার অবুঝ হৃদয় কেনওই নিষ্ঠুর স্বভাব নারীর পিছু বৃথা ধায়?হায়, আমার এই রক্তাক্ত হৎপিণ্ডকেন ফিরে ফিরে তার অন্বেষণ করে?খসরুর প্রবর্তিত গজল গানের এই সুন্দরে ঐতিহ্যের সার্থক উত্তরসূরী হলেন গালিব, যক, ইকবাল, ফৈয়াজ, নজরুল প্রমুখ কবিকুল। এঁদের ভিতর নজরুলকে বাদ দিলে আর সকলেই উর্দু ভারষার কবি— একমাত্র নজরুলই বাংলা বাষায় এই জাতের গান লিপিবদ্ধ করে বাঙলা গানের সম্পদ দৃষ্টিগ্রাহ্যরূপে বৃদ্ধি করেছিলেন। তার গজল গানের কথা যেমন মধুর, সুরের মনোগ্রাহিতাও তেমনি অকাট্য। তুলনামূলক বিচারে সুরের আবেদনটাই যেন সমধিক অপ্রতিরোধ্য বলে মনে হয়। শেষোক্ত বিষয়টির পরীক্ষণের ক্ষেত্রে এলে দেখা যায় অর্থাৎ নজরুলের গজলের সুরের গঠন নাড়াচাড়া করলে বুঝতে পারি, সাধারণত ভৈরবী, ভীমপলশ্রী, কাফি, খাঁঢ়, পাহাড়ি, পিলু, গারা, জিলা. ধানী, বিহারী প্রভৃতি অপেক্ষাকৃত হালকা কিন্তু প্রাণমাতানো রাগ.রাগিণীগুলিকে অবলম্বন করেই নজরুল তার গজল গানের কলেবর গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন্ এই সব রাগ-রাগিণীর ভিতর যে-একটা waiting বা কান্নাপ্রবণতার ভাব নিহিত আছে সেইটিকে তিনি গজলের মত প্রেমগীতির ভাব পরিস্ফুটনের সমধিক উপযোগী হবে না মনে করেই বারে বারে তিনি এই সব রাগ-রাগিণীর দ্বারস্থ হয়েছিলেন। এই ক্ষেত্রেও দেখতে পাই নজরুল আমীর খসরুরই পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলেন। কেননা খসরুও তাঁর গজল গানের সুর রূপায়ণে পিলু, গারা বা খারা, সুহা, সুখরাই, ফেরদৌস প্রভৃতি অপেক্ষাকৃত লঘু রসের হদয়কাড়া রাগ-রাগিণীগুলিই ব্যবহার করেছিলেন। আর এই সব রাগের প্রায় সব কটিই তিনি স্বয়ং উদ্ভাবন করেছিলেন। (পারসিক ‘মোকাম” কিংবা স্বরভঙ্গীর দ্বারা কমবেশী প্রভান্বিত হয়ে) সুরের সম্যক মনোযোগী পরীক্ষণে। এবারে গজল গানের কাব্যের কাঠামোটির আরও একটু কাছে এগিয়ে সামথিক মনোযোগী পরীক্ষণে প্রবৃত্ত হওয়া যাক। এ প্রসঙ্গটির আভাস গোড়ায় কিছু দিয়েছি; এখন সেটিকেআরও একটু বিস্তারিত করবার পালা।গজল গান একটি বিশেষ রীতিতে রচিত ও গীত হয়। এর অস্থায়ী অংশ ছন্দোবদ্ধ ও মোটামুটি মধ্যম বা দ্রুত লয়ে গায়। পরের অংশগুলি কয়েকটি অন্তরার সমষ্টি মাত্র। এই সব অন্তরার পদ গাইবার সময় তাল থেকে সরে যাওয়া হয় এবং কতকটা বিলম্বিত ঢংয়ের আবৃত্তির ধরনের সুর করে কথাগুলি উচ্চারণ করা হয়। বলা যেতে পারে এই অংশগুলি হল সুরবদ্ধ আবৃত্তি। গজলের এই অংশগুলোকে বলা হয় শ্যের’ বা ‘শেয়র’। ‘শ্যের’ অংশ এক-এক দফা গাইবার পর অস্থায়ীতে ফিরে যাওয়া হয় এবং অস্থায়ীর ‘মুখপাতটি’ আরশ হওয়ার পর পুনরায় তালের আবর্তন শুরু হয়ে যায় এবং তাতে করে গানের বাণীর সঙ্গে মিলিয়ে বেশ একটা ছন্দোঝঙ্কারের সূত্রপাত হয়। গানের সঙ্গে তবলার ঠেকা চলতে থাকাকালে এই পর্বে তবলিয়ার মনে বিশেষ একটা স্ফূর্তির ভাবের সঞ্চার হয়, কেননা সঙ্গীতকারের এই অংশে তার স্বকীয় নৈপুণ্য দেখাবার সবিশেষ অবকাশ ঘটে। এ অনেকটা ঠুংরীর মুখপাতের অংশ চক্রাকারে পুনরাবৃত্ত হওয়ার সময় ছন্দের নিপুণ কাজের মত। তবে ঠুংরীর সঙ্গে গজলের এই অংশের তালক্রিয়ার প্রধান তফাত এই যে, ঠুংরী গাওয়া হয় সাধারণত দাদরা বা আদ্ধা তালে, আর গজল গাওয়া হয় প্রায়শ সাদামাটা কাহারবা তালে।
নজরুল তাঁর গজল গানগুলির প্রচার করেন বিশেষ দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে তিরিশের দশকের গোড়ার কয়েক বছর পর্যন্ত। মুখ্যত, তাঁর নিজের গলা এবং সুরসুধাকর দিলীপকুমার রায়ের কণ্ঠের দৌলতে গানগুলি সাধারণ্যে ব্যাপক প্রচার লাভ করে। আর গ্রামোফোন রেকর্ডে শ্রীমতী আঙ্গুরবালা দেবী, শ্রীমতী ইন্দুাবালা দেবী ও শ্রীমতী কমলা ঝরিয়ার অপূর্ব কণ্ঠসম্পদ মারফত গানগুলির প্রভাব সর্ব বিস্তৃত হয়, সকল স্তরের মানুষের মধ্যে বিস্তৃত হয়। গানগুলি তাদের সহজ কথা ও সুরের আবেদনে এতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, কলকাতা শহরের উচ্চশিক্ষাভিমানী ধনাঢ্যের ড্রয়িং-রুম থেকে শুরু করে শহর ও শহরতলীর কারখানার শ্রমজীবী মানুষের স্তর অতিক্রম করে গ্রামের গরুর গাড়ির গাড়োয়ানের মুখে পর্যন্ত এসব গানের কলি সতত গুঞ্জরিত হয়ে ফিরতে থাকে। নজরুল-সৃষ্ট গজলে সুর ও তার স্বরমাধূর্ষে উচ্চ-নীচের ব্যবধান ঘুচে যায়- বালীগঞ্জের সচ্ছল গৃহস্বামী বা স্বামিনীর রুচিশোভন বৈঠকখানায় পিয়ানো বা অর্গানে যেমন এ গানের সুর ধ্বনিত হওয়াটা কারও কাছে আশ্চর্য ঠেকে না তেমনি আশ্চর্য ঠেকে না গ্রামগঞ্জের বিড়ি মজুরের মুখে ওই সুরের নিয়ত সঞ্চরণ। শ্রম-অপনোদনের এক মোক্ষম দাওয়াই তুলে দিয়েছিলেন শ্রমিক বন্ধুদের হাতে নজরুল এই বিনোদনী গানগুলির মাধ্যমে।এক সময়ে নজরুল অগণিত গজল গান লিখেছিলেন হাটে মাঠে ঘাটে গৃহকোণে সর্বত্র এই গানগুলির সুর ভেসে ভেসে ফিরছে। একটা সময় গেছে যখন আকাশে বাতাসে কান পাতলেই গজল সুরের অনুরণন শুনতে পাওয়া যেত। নজরুলের এই জাতীয় রচনার মধ্যে যেগুলি সবচেয়ে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিল তার কয়েকটির প্রথম কলি একটু আগে উল্লেখ করেছি। আরও কয়েকটির উল্লেখ করছি, ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুলশাখাতে দিসনে আজি দোল’, ভুলি কেমনে আজো যে মনে বেদনা সনে রহিল আঁকা” ‘কে বিদেশী বন-উদাসী বাঁশের বাঁশী বাজাও বনে’, “বসিয়া বিজনে কেন একা মনে পানিয়া ভরনে চল লো গোরী”, ‘কেন কাদে পরাণ কী বেদনায় কারে কহি”, “কেউ ভোলে না কেউ ভোলে, অতীত দিনের স্তুতি”, ‘পথ চলিতে যদি চকিতে কভু দেখা হয় পরাণ প্রিয়’, ‘নহে নহে প্রিয় এ নয় আঁখি জল”, ‘পাষাণের ভাঙালে ঘুম কে তুমি সুরের ছোঁয়ায়”, “মোর ঘুমঘোরে এলেমনোহর নমো নম”, ইত্যাদি।এর ভিতর বাণীর দ্যোতনার দিক দিয়ে শেষোক্ত গান দুটিকে কাব্যগীতির পর্যায়ে ফেলা যায়, তবে সুরের চালে গজলের আমেজ অতি স্পষ্ট। আর এক অর্থে সব প্রেমগীতিই তো কাব্যগীতি তা সে গজল শ্রেণীর হোক আর অন্য কোন শ্রেণীরই হোক। গজল গানের বৈশিষ্ট্য মূ লত তার সুরের চালে, গায়নের পদ্ধতিতে। সেই বিচারে শেষের গান দুটিকে গজল আখ্যা দেওয়া যাবে।পাঠকের জ্ঞাতার্থে এখানে তিনটি গজলের অংশ বিশেষ তুলে দিচ্ছি তাদের স্বরূপ বোঝানোর জন্য। অবশ্য উদ্ধৃতিতে শুধু কথার সৌন্দর্যই ধরতে পারা যাবে, সুরের সৌন্দর্য কানে না শুনলে অনুধাবন করা অসম্ভব। গান শ্রুতিসাপেক্ষে শিল্প, আলোচনায় তার সামান্য অংশই অনুভবগম্য __চেয়ো না সুনয়না আর চেয়ো না এই নয়ন পানে।জানিতে নাইকো বাকী সই ও আঁখি কী জাদু জানে।একে এ চাউনি বাঁকা সুর্মা আঁকা তায় ডাগর আঁখি,বাধতে তায় কেন সাধ, যে মেরেছে এ আঁখি বাণে?কাননে হরিণ কাঁদে সলিল ফাঁদে ঝুরছে শফরী,বাঁকায়ে ভূরুর ধনু ফুল অতনু-কুসুম শর হানে।ইত্যাদি।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct