বসিরহাট : সকাল হলেই শুরু হয় ঠক ঠক শব্দ। চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। সাংসারিক কাজের ফাঁকে ফাঁকে নিপুণ হাতে গামছা তৈরি করেন হালিমা বেগম। গামছা তৈরি করে সংসারে সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে তার এ প্রচেষ্টা। গামছা বুনেও সংসারে ফিরছে না সচ্ছলতা।তারপরেও করোনা আতঙ্কে জেরবার আমরা।
বসিরহাটের খিদিরপুর গ্রামের গামছা কারিগর পঞ্চার্ধ্ব হালিমা বেগমের সঙ্গে কথা বললে তিনি এ কথা জানান। অনেকটা হতাশার সুরে হালিমা বেগম বলেন, আগে আমাদের এখানে অনেকেই গামছা বুনতো। প্রায় বাড়িতে চার পাচটি করে তাঁত ছিল। সকাল হইলেই সকলেই আনন্দকরে গামছা বুনতো। কিন্তু লোকসান হতে হতে এখন আর কেউ গামছা বুনতে চায় না। কয়েকটি পরিবার এখন আমার মতো কষ্ট করে যাচ্ছে। আমাদের তো বাইরে কেউ কাজে নেবে না। তাই পুরানো এই পেশাই জুড়ে আছি।
তিনি জানান, প্রতিদিন চারটি করে গামছা তৈরি করতে পারেন। আর মাঝারি সাইজের একটি গামছা ১২৫ টাকা দরে বিক্রি করা হয়।পানিতর গ্রামের ষাটোর্ধ্ব শাহজাহান মালী বলেন, গামছা তৈরির জন্য ব্যবহৃত সুতা ও রঙের মূল্য বেড়েছে। সেসঙ্গে শ্রমিকের মজুরিও বেশি দিতে হয়। গামছার দাম দিন দিন কমে যাচ্ছে। ফলে গামছা বুননের কাজ না করে অনেকে অন্য পেশা বেছে নিয়েছেন।তিনি জানান, আগে এ গ্রামে পাঁচশ কারিগর গামছা বুনতো। এখন কমতে কমতে তা দশ থেকে বারো জনে ঠেকেছে। একটি গামছা তৈরি করতে দুই ঘণ্টা সময় লাগে। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, বসিরহাটের ঐতিহ্যবাহী মুন্সির গামছা শিল্প আজ মৃতপ্রায়।
এক সময় এখানের পাঁচটি গ্রামের শতভাগ পরিবারের জীবিকা নির্বাহের প্রধান উৎস ছিল এ শিল্প। দিন দিন নিঃস্ব হয়ে পড়েছে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা। বন্ধ হয়ে গেছে এলাকার নব্বই শতাংশ তাঁত। শাহজাহান মালী বলেন, গামছা বুননের পেশা আমাদের বাবা-দাদাদের সময় থেকে দেখে আসছি। বলা যায়, এটা আমাদের আদি পেশা। তাই এখানকার প্রায় প্রতিটি পরিবারের প্রত্যেক সদস্যই এই গামছা বুননের সঙ্গে জড়িত ছিল।
একই সুরে শাহজাহানের ছেলে জিয়াদ মালী বলেন, বর্তমানে এ কাজে পেট চলে না। সেসঙ্গে ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার খরচসহ দৈনন্দিন জীবনে ব্যয় মেটাতে হিমশিম খেতে হয়। লাভ নেই বললে চলে। সরকারি সহযোগিতা ও কোন সংস্থা থেকে স্বল্প সুদে ঋণ পেলে তাঁতশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে পারতেন তাঁতীরা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, দেভোগ,কঠুর, শ্রীরামপুর,রামনগর গ্রামে এখন আর আগের মতন তাঁতের ঠক ঠক শব্দ শোনা যায় না।
আধুনিকতার ছোঁয়া আর গামছা তৈরির প্রধান উপকরণ সুতা, রঙের অত্যাধিক মূল্য বৃদ্ধি ও শ্রমিকের মজুরি বাড়ার কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় লাভের পরিবর্তে লোকসান গুণতে হচ্ছে তাঁতীদের। অনেকেই এ পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে গামছাপল্লির নব্বই শতাংশ তাঁত। আর যে কয়েকটি পরিবার টিকে আছে তাও বন্ধের উপক্রম হয়েছে। আগের মতন বাড়ির আঙিনায় চরকায় রঙবেরঙের সুতা গুটিতে গুছিয়ে দেওয়া দৃশ্য এখন আর নেই বললেই চলে।
এ পেশা টিকে থাকা অনেকেই বলেন, লাভ বেশি না হওয়ার কারণে অনেক তাঁতী গামছা বোনা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন। অন্যদিকে মেশিনের তৈরি গামছার দাম কম হওয়ায় হাতে বোনা গামছার চাহিদাও কমেছে। গামছা তাঁতীরা জানান, ভালো সবচেয়ে বড় গামছা দুশো টাকা পিস। ছোট পরেরটা ১২৫ টাকা পিস। সাড়ে তিন হাত লম্বা চওড়া এক গজ ৮০ টাকা পিস।
পানিতর এলাকার ব্যবসায়ী মামুন মোল্লা বলেন, বিভিন্ন এলাকায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে অসংখ্য হস্তচালিত তাঁতশিল্প গড়ে ওঠে। বুননের ঐতিহ্য প্রায় দু’থেকে আড়াইশ বছরের পুরনো গামছাশিল্প। একসময় এ এলাকার প্রতিটি পরিবারে তাঁত ছিল। এখন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছু পাল্টে যাচ্ছে। এখানকার গামছা দেশের ঐতিহ্যবাহী বুননশিল্পের একটি। কিন্তু সুতার মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা কারণে এখানকার তাঁত ও তাঁতীর সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। ফলে আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে এই ঐতিহ্যবাহী বুননশিল্পটি। তাই এখন এই শিল্পকে জাগিয়ে তুলতে প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা।
তাদের সহযোগিতায় এই শিল্প আবার ফিরে পেতে পারে তার পুরনো ঐতিহ্য এবং সেই সঙ্গে তাঁতীরাও আবার ফিরে আসতে পারেন।তবে তাঁত সমিতির সম্পাদক কৌশিক দত্ত বলেন, বসিরহাটের গামছার ঐতিহ্য রয়েছে। এর কদর রয়েছে দেশজুড়ে। গামছা শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা কিছুটা পিছিয়ে যাচ্ছে বলে জানতে পেরেছি। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের উন্নয়নে কাজ করা হবে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct