স্বপ্নের চোরাবালি
আহমদ রাজু
‘থাক বাবা যা গেছে...।’‘ওটাতো আমি ভুলে গেছি। আজ হঠাৎ মনে পড়লো তাই বললাম। ও কি যেন বলছিলি..’‘বলছিলাম আমি কবে আসবো?’‘আমি আছি, তুই আজ কাল যখন সময় পাস তখনই চলে আসিস।’‘আচ্ছা আব্বা। তাহলে আমি এখন রাখি?’‘আচ্ছা রাখ।’বলে বাবা ফোন রেখে দেন।আমি পুলকিত মন নিয়ে বাড়ি ফিরে আসি। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিই, আগামীকাল রাতেই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হবো। খুলনা থেকে ঢাকায় তিনটি পরিবহন যাতায়াত করে। বলাকা, দ্রুতি, সৌখিন আর সোহাগ। আমি বরাবরই বলাকা পরিবহনে যাতায়াত করি। এর অবশ্য কারণও আছে, চেয়ার কোচ বলাকা আর সৌখিন পরিবহনের আছে। বলাকা পরিবহনের কোচ অপেক্ষাকৃত আরামদায়ক। যদি অন্য কোন পরিবহনে ভাল কোচ থাকতো তাহলে হয়তো দ্বিতীয়বার ভেবে দেখতাম। বাবার টাকা, আমার সমস্যা কোথায়। বাবা আমাকে কখনও বলেননি নরম্যাল কোচে যাতায়াত করতে। তাছাড়া তিনি কখনও চেয়ার কোচ ছাড়া যাতায়াত করেন না। তার ছেলে হয়ে আমি নরম্যাল বাসে ঢাকায় গেলে তার সম্মান থাকবে বলে আমার মনে হয় না। যথারীতি কাউন্টার মাষ্টারকে বলি আগামীকাল রাতে একজন মহিলা ঢাকায় যাবে, ভাল সিট দিতে। সে বলল, রাতে টিকিট কেটে রাখবে সকালে এসে আমি যেন নিয়ে যাই। আগের দিন বলার কারণ, যাতে ভাল সিট পাই। তা না হলে দিনের দিন ভাল সিট নাও থাকতে পারে। তাছাড়া আর একটা চিন্তা মাথার চারপাশে ঘুরঘুর করতে থাকে। এবার আমার পাশে কে বসবে? সে অল্প বয়সী কোন সুন্দরী মেয়ে- নাকি মায়ের বয়সী কেউ! এমন চিন্তায় যখন আমি অস্থির তখন নিজেই নিজের মনকে বোঝাই- যা হোক একটা কিছুতো হবেই। এত চিন্তা করে কাজ কি?ঢাকায় যাবার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হবার সময় বাবাকে কি কি কথা বলতে হবে মা সব বারবার বুঝিয়ে দিলেন। গাড়ি থেকে গাবতলী নেমে সোজা হোটেলে যেন চলে যাই, সে কথাও বলতে ভুললেন না। আর আমি যেন বাইরের কোন খাবার না খাই তার জন্যে কয়েকটা রুটি, ডিম-আলুভাজি করে আমার ব্যাগে ভরে দিলেন। বাড়ির সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যখন বাস কাউন্টারে এসে দাঁড়িয়েছি তার কিছুক্ষণ পর কাক্সিক্ষত বাসটি সামনে এসে দাঁড়ায়। বাসে ওঠার পর সুপারভাইজার আমার কাছ থেকে টিকিটটা নিয়ে সিট দেখিয়ে দিলেন। সাথে থাকা ব্যাগ মাথার ওপর বাংকারে রেখে সিটে বসে পড়ি।গাড়ি চলছে তার নিজস্ব গতিতে। পাশে কে বসেছে এতক্ষণ খেয়ালই করিনি। আর আমার মনের ভেতরে যা-ই সৃষ্টি হোক না কেন; সেটা বাস্তবায়ন করতে গেলে নিজেকে সামলাতে পারি না। বিশেষ করে যতই মন চায় মেয়েদের সংস্পর্শে আসতে- কাছে আসলে ততই নিজেকে সরিয়ে নিই। কেন এমন হয় তা জানি না। তা না হলে এতদিন মনে মনে যেমনটি চেয়েছিলাম ঠিক তেমন একটা মেয়ে আমার পাশের সিটে বসে আছে অথচ আমি তার দিকে খেয়ালই করিনি! ইতিমধ্যে গাড়িটা যশোর শহরের মনিহারে এসে দাঁড়িয়েছে।’ইঠা খোন্ জাইগা?’কথাটা কানে যেতেই সঞ্চিৎ ফিরে পাই। আমি মেয়েটার দিকে এক নজর তাকাই। হঠাৎ মনের ভেতর এক অন্য রকম অনুভূতি দোলা দিয়ে যায়। তবে কিসে যেন মিলছে না মনের সাথে। আসলে প্রশ্নের সাথে চেহারার কোন মিল নেই। সাদা ধবধবে গায়ের রং, সোনালী চুল, জিন্স প্যান্ট আর সাদা টি শার্ট, একদম বিদেশী, অথচ বাংলায় কথা বলে! শুধু কথায় একটু আলাদা টান। মানুষের মতো মানুষতো হতেই পারে। তাছাড়া ঢাকার মেয়েরা ইদানীং বেশ মর্ডান হয়েছে- হবার চেষ্টা করছে। আমি আকাশ পাতাল ভাবতে থাকি।‘হাপনি কি ভলিতে ফারিবেন ইঠা খোন্ জাইগা।’ক্ষণেক পরে ভাঙা বাংলায় আবারো প্রশ্ন করে মেয়েটি। মনিহার সিনেমা হলের সামনে গাড়িটা দাঁড়িয়ে। জানালা দিয়ে বড় অক্ষরে মনিহার লেখা দেখেও আমাকে প্রশ্ন করছে দেখে বিস্মিত হলাম। বললাম,’যশোর মনিহার।’‘ও আইচ্চা।’মেয়েটি আমার সাথে যেচে কথা বলছে দেখে আমার মনের আড়ষ্টতা কেটে যেতে থাকে। বললাম,’আপনাকে দেখেতো এ দেশীয় মনে হয় না।’মেয়েটি স্বভাব সুলভ ভাঙা বাংলায় বলল,’হাপনি ঠিক ভলিয়াছেন; হামার কান্ট্রি এ্যামেরিকা।’‘ভালইতো বাংলা বলতে পারেন।’বিস্মিত আমি।‘ভেশ খ’বার ভাংলাদেশে হাসিয়াছি। হাস্থে হাস্থে শিখিয়া ফেলিয়াছি।’‘এখানে কী করেন?’‘খ্রিস্টান মিশনারী হসপিটালের জুনিয়র ডক্টর হামি। এইবার হাসিয়াছিলাম খুলনায়।’আমি মনে মনে খুশি হই, যা বাইরে প্রকাশ করি না। বললাম,’খুলনায় কতদিন থাকবেন?’আমার খুশিটাকে ম্লান করে দিয়ে বলল,’ঘতকাল হামার খাজ শেষ হইয়াছে। ঠাইতো পরিবারসহ এ্যামেরিকায় ফিরিয়া যাইতেছি।’‘কে কে আছে আপনার পরিবারে?’‘ফাদার-মাদার হার হামি। ঐ যে বসিয়া আছে।’বাসের প্রথম সিটের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলল কথাটি।‘এবারে কতদিন থাকলেন?’তিন আঙ্গুল দেখিয়ে বলল,’থ্রি মানথ্।’‘আরো কিছুদিন থেকে যেতে পারতেন?’‘হাসলে প্রোজেক্টের খাজ, ঠাকার খোন সুযোগ নাই।’‘আপনার নামটা.....’আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল,’হামি মার্টিনা স্মিথ। হাপনি?’‘নীলম; নীলম বিশ্বাস।’‘নীলম! গ্রেট রিভার; ফাইন।’আমি অর্থটা ভাল বুঝতে না পেরে শুধুমাত্র সামাজিকতা রক্ষা করার জন্যে বললাম,’থ্যাংকউ।’মার্টিনা স্মিথ আমাকে অপ্রস্তুতভাবে প্রশ্ন করলো,’নীলম রিভার খোথায় হবস্থিত ভলিতে পারিবেন?’আমি না সূচক মাথা দুলাই।‘হাফনার ফ্রতিবেশি দেশ।
যেইখানে বছরের হধিকাংশ সময় যুদ্ধ বাঁধিয়া থাকে, সেই কাষ্মীরে। হেই নদী-ই হালাদা খরিয়াছে ভারত হার ফাকিস্তানকে। বহু রক্তের স্বাক্ষী হেই নীলম নদী।’‘আপনি গিয়েছেন সেখানে।’‘হু; থবে নদীর ফানি ছুঁয়ে দেখিবার সাহস হয় নাই। শুধুমাত্র নিকট থেকে দেখিয়াছি।’‘আপনিতো অনেক দেশে গিয়েছেন তাই না?’আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল,’খি জব খরেন হাপনি?’‘তেমন কিছু না, কলেজে পড়ছি এখনো।’‘এক্সসিলেন্ট।’‘মানে!’‘খলেজ স্টুডেন্ট এঠাইবা খম খিসে?’‘বুঝিনি।’‘এ্যামেরিকান সরখার কলেজ স্টুডেন্টদের সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা দিয়া থাকে।’‘আমেরিকাতো স্বপ্নের দেশ।’‘হ্যা, স্বপ্নের দেশ ভলিতে ফারেন। তবে হাপনাদের মত রিলেশনশীপ এ্যাবল এ্যাবল নাই সেখানে।’‘জীবনতো গঠন করা যায়। আমার খুব ইচ্ছা ছিল...।’‘হাপনি যাবেন হামাদের দেশে?’উৎসুক প্রশ্ন মার্টিনা স্মিথের।‘কীভাবে?’বিস্মিত প্রশ্ন আমার।‘সেঠা হামার ওপর ছাড়িয়া দিন।’ঘড়ির কাটা রাত দুটো পার করেছে আরো ত্রিশ মিনিট আগে। এইমাত্র বাসটি আরিচা ঘাটে এসে পৌঁছেছে। ঘাটে তেমন জ্যাম না থাকলেও সামনে শ’দুয়েক গাড়ি ফেরিতে ওঠার অপেক্ষায়। মার্টিনা স্মিথের সাথে কথা বলতে বলতে কখনযে গাড়িটি ফেরির ওপর উঠেছে টেরই পাইনি। যখন বুঝতে পারি তখন গাড়িতে দু’চারজন বাদে আর সবাই নিচে নেমে গেছে। আমি মার্টিনা স্মিথকে উদ্দেশ্য করে বললাম,’ফ্রেস হবার জন্যে নিচে যেতে চাইলে যেতে পারেন। গাড়ি এখন ফেরির ওপর।’আমার কথা শুনে সে সামনের সিটে তাকিয়ে দেখে তার বাবা-মা দুজনেই নেই। আমি বুঝতে পেরে বললাম,’হয়তো তারাও ফ্রেস হবার জন্যে নিচে গ্যাছে।’‘পড়িয়া যাইবো নাতো?’উদ্বেগ উৎকণ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করে মার্টিনা স্মিথ।‘আমি আছি আপনার সাথে। চলুন কোন ভয় নেই।’আমার হাত ধরে নিচে নামে। ওয়াশ রুম দেখিয়ে দিলে সে ফ্রেস হয়ে আসে। আমি ঝালমুড়ি কিনি। সে খায় আমিও খায়। যেন দু’জন দু’জনকে অনেক আগে থেকে চিনি। আমি এই মুহূর্তে ভুলে গেছি আমি আসলে কে? তাছাড়া সেই দুষ্টুমী, মেয়েদের দেখলে বিশেষ দুর্বলতা কোন কিছুই আর কাজ করছে না। তবে মনে হচ্ছে আমি মার্টিনা স্মিথের প্রতি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ছি। হয়তো তারও এমন অবস্থা। তা না হলে সে কেন আমার হাত ধরে বাস থেকে মানবে? কেন সে আমার সাথে এত কথা বলবে?ফেরি পার হয়ে রাস্তায় গাড়ি চলতে শুরু করলে যেচে বলল,’হামি হাগামী সানডে ভিকেলের ফ্লাইটে এ্যামেরিকায় চলিয়া যাইবো।’‘এই তিন দিন কোথায় থাকবেন?’‘হোটেল সোনারগাঁও। সিট বুক খরিয়া রাখা।’হোটেল সোনারগাঁও আমি চিনি। বাবার ওখানে যেতে পথের ডান পাশে পড়ে। তাইতো দ্বিতীয়বার কোন প্রশ্ন না করে বললাম,’ও আচ্ছা।’‘হামার ফোন নম্বরটা রাখুন। আর হ্যাঁ, হাপনি যেইখানে থাকিবেন সে জায়গার ফোন নম্বরটা দিন। হাপনার সাথে যোগাযোগ খরিবো।’আমি কালক্ষেপন না করে পকেট থেকে কাগজ-কলম বের করে বাবা যে হোটেলে থাকে সেই হোটেলের টেলিফোন নম্বরটা লিখে দিলাম। আর মার্টিনা স্মিথের টেলিফোন নম্বরটা নিয়ে মানিব্যাগের গোপন কুঠুরিতে রেখে দিলাম। সায়েদাবাদ বাস ডিপোয় সকাল সাতটায় পৌঁছাই আমরা। সবাই একে একে গাড়ি থেকে নামি। মার্টিনা স্মিথ তার বাবা-মায়ের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেয়। তাঁরাও সুন্দর বাংলা বলতে পারে। হয়তো মেয়ের সাথে এদেশে এসেছে অনেকবার কিংবা তারাও এদেশে চাকুরী করে। তা না হলে এমন শুদ্ধ বাংলা বলতে পারার কথা নয়। তাদের জন্যে আগেই একটা পাজারু গাড়ি অপেক্ষায় ছিল। আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাবা-মায়ের সাথে গাড়িতে উঠে বসে। মিনিট খানেকের মধ্যে আমার চোখের সামনে থেকে যখন অদৃশ্য হয়ে যায় গাড়িটি তখন আর আমার মনের ভেতরে প্রতি সেকেন্ড ঘুর ঘুর করতে থাকে মার্টিনা স্মিথের স্মৃতি। কেন জানি দুনিয়ার সকল চিন্তা এক জায়গায় এসে আটকে গেছে মুহূর্তে।হোটেলে যেয়ে সরাসরি বাবার রুমে চলে যাই। রিসিপশনে কোন কিছু শোনারও প্রয়োজন বোধ করি না। আসলে এই হোটেলের তিন’শ আট নম্বর রুমে বাবা আছে বেশ ক’বছর ধরে। বাবা রুমটাকে বাড়ির মতোই ব্যবহার করেন। এমনকি বাড়িতে তাঁর যেমন একটা কোলবালিশ আছে এখানেও ঠিক তেমনি কোলবালিশ আছে। আর আমি যে কতবার এসেছি তার ঠিক নেই। যে কারণে হোটেলের ম্যানেজার থেকে শুরু করে ঝাড়ুদার পর্যন্ত সবাই আমাকে চেনে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct