ঢেউ
এস ডি সুব্রত
এ বছর বর্ষার আগমন একটু দেরীতেই বলতে গেলে। কদিন ধরে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। তাই বর্ষার আগমনী বারতা পাওয়া যাচ্ছে। বর্ষা এলে হাওর নদী কানায় কানায় ভরে উঠে। আর এ বর্ষা নিয়ে শুভ্রর রয়েছে এক দূঃসহ স্মৃতি। ভ্রমন সব সময়ই আনন্দের। তবে কখনো কোন ভ্রমন হয়ে উঠে ভয়াল স্মৃতির। শুভ্রর কাছে ভ্রমন বরাবরই সুখের অনুসঙ্গ নিয়ে ধরা দেয়। বিশেষ করে নৌপথে ভ্রমণটা শুভ্র খুব উপভোগ করে। জলের উপর ভেসে চলার আনন্দ অন্যরকম অনুভূতি জাগিয়ে তোলে শুভ্রর মনে। ধুলোবালিহীন, ধোঁয়া মুক্ত সজীব পরিবেশে যাতায়াত একমাত্র নৌপথেই উপভোগ করা যায়। তদুপরি বাড়তি পাওনা হিসেবে বই পড়ার একটা দারুন সুযোগ পাওয়া যায়। শুভ্রর বড় বোনের বাড়ি বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলায়। বছরে একবার সেখানে যায় শুভ্র। কখনো তার দিদিকে নিয়ে আসে। আবার কখনো গিয়ে দুএক দিন থেকে চলে আসে। চাঁদপুর থেকে সেখানে যাওয়ার একমাত্র বাহন লঞ্চ। রাতে যেতে হয়। চাঁদপুর ঘাট থেকে ১১ টায় লঞ্চ ছাড়ে এবং রাত তিনটার সময় কাংখিত ঘাটে ভিড়ে। শুভ্র যেখানে নামে সেখানে দুটি লঞ্চ থামত তখন। কোকো-১ ও কোকো-২। শুভ্র ঘাটে বসে আছে। সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে, তবু লঞ্চ আসছে না। কাংখিত লঞ্চ ঢাকা থেকে ছেড়ে আসে। আবহাওয়াটাও তেমন ভাল না। লঞ্চ আসতে প্রায় বারোটা বেজে যায়। আজ কোকো-২। শুভ্র লঞ্চে উঠে ডেকে একটা বেডকভার বিছিয়ে ঘুমানোর ব্যবস্থা করে। রাতের লঞ্চ। সবাই আগে থেকেই ঘুমাবার ব্যবস্থা করে রাখে। তা না হলে পরে জায়গা পাওয়া যায় না। ভরা বর্ষায় যতদূর চোখ যায় থৈ থৈ জলরাশি। লঞ্চ চাঁদপুর ঘাট ছেড়ে যাওয়ার বিশ থেকে ত্রিশ মিনিট পর শুরু হয় প্রচণ্ড ঝড়। পাহাড় সমান ঢেউ। এমন ঢেউ এর আগে কখনো দেখিনি শুভ্র। হাওর অঞ্চলে নৌকা যাতায়াতের সময়ও ঢেউ দেখেছে শুভ্র। কিন্তু এত বড় ঢেউ কখনো দেখেনি শুভ্র। লঞ্চের নীচতলায় একদিকে পানি ঢুকে আরেক দিক দিয়ে গড়িয়ে পড়ে। ঢেউয়ের পানি দোতলায় গিয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে মানুষকে। ভয়ে মহিলাদের আর্তনাদ চারিদিকে। পুরুষরা আল্লাহ ভগবানের নাম নিচ্ছে। লঞ্চ কতৃপক্ষ সবাইকে নিজের জায়গা থেকে দোয়া দরুদ পড়ার আহ্বান করছে। লঞ্চ কর্তৃপক্ষ সকল যাত্রীদের নিজের জায়গা না উঠার পরামর্শ দিচ্ছে। কারণ এসব ক্ষেত্রে লঞ্চ একদিকে কাত হয়ে গেলেই সাধারণত লঞ্চ ডুবে। অন্যথায় লঞ্চ সাধারণত ডুবে না। শুভ্র ব্যাগ এক জায়গায় রেখে লঞ্চের কিনারায় গিয়ে বসে যদি লঞ্চ ডুবে যায় তাহলে লাফ দিয়ে বাঁচবে সেই ভরসায়। পাশের একজন যাত্রী শুভ্রর মনোভাব টের পায়। ঐ ভদ্রলোক খেয়াল করে যে, শুভ্রর দু’চোখে জল। তখন ভদ্রলোক বললেন, ভাই এই লাইনে নতুন আসছেন বুঝি। আল্লাহর নাম নেন। তিনি বাঁচাবার মালিক। আর আপনি যে লঞ্চের কিনারায় যাচ্ছেন লাফ দেবার আশায়। লাফ দিয়ে বাঁচতে পারবেন না। মরলে লঞ্চের ভেতর থেকেই মরব। আল্লাহ যদি না বাঁচায় মানুষের কি সাধ্য আছে। ভদ্রলোকের কথায় শুভ্র সান্ত্বনা পায়। বুকে সাহস সঞ্চয় করে। আস্তে আস্তে বাতাসের গতিবেগ কমে আসে। লঞ্চ কালিগঞ্জ নামক জায়গায় ঘাট ধরে। তখন ছোট নদী ধরে লঞ্চ ধীরে ধীরে শুভ্রর গন্তব্য বাবুগঞ্জ ঘাটে পোঁছে। শুভ্র যেন মৃত্যুর দরজা থেকে ফিরে এসেছে। হালকা বাতাস আর বৃষ্টি হচ্ছে। তখন মোবাইল বাজারে আসলেও শুভ্রর মোবাইল ছিলনা। সাড়ে তিনটা বাজে। ঘাট থেকে আলীগঞ্জ বাজারে যেতে হবে। বাজারের পাশেই তার দিদির বাড়ি। আজ কোন রিক্সাও নেই। কোন সঙ্গীও পায়নি। অন্য সময় সঙ্গী পাওয়া যায়। আজ তাও পায়নি। বাজারের কাছে যেখানে কবরস্থান সেখানে শেয়াল ডাকছে। শুভ্র মনে মনে ভয় পাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত দিদির বাড়ি পৌঁছে। তবে এর পর থেকে শুভ্র আর তার দিদির বাড়ি মেহেন্দিগঞ্জ যায় নি। সে রাত্রের কথা মনে পড়লে আজো তার গা শিউরে ওঠে। আর ভাবে সৃষ্টিকর্তার করুনায় সেদিন মৃত্যুর দরজা থেকে ফিরে এসেছে। এমন ঢেউ যেন আর না দেখে শুভ্র মনে মনে সেই প্রার্থনা করে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct