গণতান্ত্রিক ক্ষমতার মোহে স্বপ্নিল সওদাগর
এম ওয়াহেদুর রহমান
গণতন্ত্র ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের সমন্বয়ের স্বাভাবিক ফলশ্রুতি হলো স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন। গ্ৰামে ক্ষমতার গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণের প্রতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা হলো পঞ্চায়েত। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক পরিচিতির অভিব্যক্তি ঘটে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের মধ্যে দিয়ে। সুষম বিকাশ ও দীর্ঘস্থায়িত্বের নিরিখে স্থানীয় স্তরে উন্নয়নকে যদি লক্ষ্য হিসেবে ধরা হয় - স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা হলো সেই লক্ষে পৌঁছানোর প্রাতিষ্ঠানিট উপায়। সেজন্যই বর্তমান বিশ্বের ছোট বড় অনেক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রই স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। এক্ষেত্রে ভারত তথা পশ্চিম বঙ্গ ও ব্যতিক্রম নয়। এই পঞ্চায়েতি ব্যবস্থাপনায় মহিলাদের ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ ছাড়া ও খেতমজুর, দিনমজুর প্রভৃতি দিন- আনি - দিন খাই মানুষদের ও প্রতিনিধিত্ব এখন যথেষ্ট। কিন্তু সবক্ষেত্রেই পঞ্চায়েত আশানুরূপ কাজ করে স্থানীয় জনগণের আশা আকাঙ্খাকে সম্পূর্ণরূপে চরিতার্থ করতে সক্ষম হয় নি। গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণের সঙ্গে পঞ্চায়েতি রাজ প্রতিষ্ঠার সার্থকতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পশ্চিমি বঙ্গের পঞ্চায়েতি ব্যবস্থা ত্রি - স্তরবিশিষ্ট - গ্ৰাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদ। পশ্চিম বঙ্গে এই ত্রি - স্তরবিশিষ্ট পঞ্চায়েত নির্বাচনের নির্ঘণ্ট প্রকাশিত হয়েছে। প্যাচ প্যাচে গরমকে উপেক্ষা করে ও মানুষ মেতে উঠেছে স্থানীয় গণতন্ত্রের মহোৎসবে। আর এই সুবাদে রাজনীতিবিদগণ স্বপ্নের সওয়াদাগর হয়ে স্বপ্ন বিক্রির মাধ্যমে নিজেদের ভোটব্যাঙ্ককে সংঘবদ্ধ করে ক্ষমতার মসনদে আসীন হওয়ার পথকে মসৃণ করে। ক্ষমতায় উপনীত হয়ে কিছু কিছু স্বপ্নের বাস্তবায়ন ও ঘটায় , যেন তাদের প্রতি মানুষের আস্থা , বিশ্বাস ও ভরসা অটুট থাকে এবং পরবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতায় ফিরে আসা সম্ভব হয়। এভাবেই ভোট রাজনীতি নিয়ত প্রবাহিত হয়ে চলেছে। ক্রমশঃ সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার চরিত্রকে ক্ষয়িষ্ণু করে তুলেছে। কারণ ধর্মকে যখন রাজনীতির ভোট ময়দানে ক্ষমতা দখলের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তখন গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে উঠে। তাই ধর্মের নামে সংখ্যাগুরুর জয়ধ্বনি কিংবা সংখ্যালঘু তোষণ রাজনীতির অঙ্গনে সম ভাবে বিপদ। সুস্থ সুন্দর রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে চাইলে প্রয়োজন ধর্মমুক্ত রাজনীতি। তাছাড়া দারিদ্র্যতা ও নিরক্ষরতা রাজনীতির অঙ্গনে একটা বড় অশনি সংকেত , এর থেকে আমাদের মুক্ত হওয়া প্রয়োজন। বিভিন্ন নির্বাচনের সময় দেখা যায় উত্তপ্ত পরিবেশ, বোমাবাজি , বিস্ফোরণ কিংবা গুলিচালনার ঘটনা। পরিনামে ঝরছে সাধারণ মেহনতি মানুষের প্রাণ। আসলে দুর্নীতি থাকলে অপরাধ ও হিংসা থাকবে। আবাশ যোজনা , একশো দিনের কাজ ইত্যাদি প্রকল্পের টাকাকে কেন্দ্র করে দূর্নীতি মাঝে মধ্যে মাথা চাড়া দিয়ে থাকে। দুর্নীতি না ঘটলে হিংসা হয়তো আসবে না। দলবদলের রাজনীতি ও রাজনৈতিক আদর্শকে কলুষিত করে তুলেছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে দলবদলের প্রবণতা ক্রমশঃ বাড়ছে। দলীয় রাজনীতির সীমাবদ্ধতা ও পঞ্চায়েতি রাজ ব্যবস্থা সর্বোপরি অন্যান্য ব্যবস্থাপনার সাফল্যের পথে অন্যতম প্রতিবন্ধক হিসেবে প্রতিপন্ন হয়। আজকে জনজীবনের অধিকাংশ বিষয়েরই রাজনীতিকরণ ঘটেছে। জনগণের স্বার্থের পরিবর্তে সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থই প্রাধান্য পাচ্ছে। তবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব অনস্বীকার্য। আজ ও আমাদের গ্ৰামাঞ্চলে কিংবা শহড় গুলিতে দেখা যায় বড় বড় অট্টালিকার নীচে শতশত পরিবার না খেয়ে ফুটপাতের খোলা আকাশের নীচে বিনিদ্র রজনী যাপন করছে। বৃদ্ধ ,জরাগ্ৰস্থ ,চলচ্ছক্তিহীন মানুষগুলো অসহায় হয়ে দিশাহীন ডাস্টবিনের পাশে পড়ে আছে। তারা বেঁচে আছে কি না , জিজ্ঞেস করার মতো কেউ নেই। রাজনীতির আঙিনায় সাম্প্রদায়িকতা কিংবা দুর্নীতিপরায়ণতা জীবন - জীবিকার স্বাভাবিক গতিকে অনেকটাই রুদ্ধ করে তুলছে। তাই মানবীয় মূল্যবোধ, আদর্শ ও নৈতিকতার মৃত্যু ঘটছে। এ অবস্থায় প্রয়োজন মানবিক মূল্যবোধ সমণ্বিত সামাজিক- রাজনৈতিক শক্তির উত্থান , প্রয়োজন আদর্শ মূল্যবোধভিত্তিক রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক সচেতনতার।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct